ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অসউইজ ও ম্যথসেনের কথা

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

অসউইজ ও ম্যথসেনের কথা

গত ২৭ জানুয়ারি অসউইজে পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ স্মরণার্থে ২০০৫ সাল থেকে পালিত আন্তর্জাতিক হত্যাযজ্ঞ স্মরণ দিবসের ওপর বিবিসি টেলিভিশন কর্তৃক প্রযোজিত ও প্রদর্শিত এক দালিলিক ছবি দেখেছিলাম। এই ছবিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে অসউইজে হত্যাকৃত ১১ লাখ ইহুদী, পোলিশ, ইতালিয়ান ও রাশিয়ানদের স্মরণে বার্ষিক শোকসভায় মিলিত হওয়া ২০০০ দুর্গত মানুষ ও তাদের উত্তরসূরীদের ব্যথা, বেদনা, শোক ও অঙ্গীকার প্রদর্শিত হয়েছে। এই সভায় অসউইজের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া অন্যদের মধ্যে বাইশেভা ভেগান, এলজে বালী, মারিয়ান টাজারস্তি ও এসটানসলিউ জেলেওইসফির স্মৃতিময় বেদনার কথাগুলো শুনতে পেরেছি। ১৯৪০ থেকে ’৪৫ পর্যন্ত নাজি হত্যাযজ্ঞের নিলয় অসউইজের অবস্থান ছিল সেই সময়ে নাজিদের দখলকৃত পোল্যান্ডের কারাকো নগরের ৫০ কিঃমিঃ দক্ষিণ পশ্চিমে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে এ ছিল সৈন্য সামন্তদের ব্যারাক। ১৯৪০ এ জার্মানির নাজিরা পোল্যান্ড দখল করে এখানে তাদের হাতে বন্দী ইহুদী, পোলিশ, সোভিয়েত সেনা এবং নিরপরাধ ছিন্নমূল ভবঘুরেদের জড়ো করে। এ বন্দীশালা স্থাপন করেছিল কুখ্যাত নির্দয় জার্মান সেনা নায়ক রুডলফ হোস। অসউইজের মূল অবস্থানে ছিল ২২টি ইটের তৈরি দোতলা ইমারত। ১৯৪৩ সালে এর সঙ্গে যোগ করা হয় আরও তেমনি ৮টি ইমারত। এসব ইমারত এবং এর সঙ্গে সংলগ্ন মানুষের দেহ জিকলন বি গ্যাসে পোড়ানো অগ্নিশালার পরিচিতি ছিল অসউইজ-১ নামে। ১৯৪৩ এর শেষ দিকে এসব স্থাপনা থেকে ৩ কিঃমিঃ দূরে তেমনি অগ্নিশালাসহ নির্মিত হয় অসউইজ-২। এরপরে মনোউইটজ এ স্থাপিত হয় তেমনি অসউইজ-৩। অসউইজের এই ৩ স্থাপনার অগ্নিশালায় গড়ে প্রতিদিন ১০০০ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হতো। শক্ত সমর্থ বন্দীদের দিয়ে প্রথম কয়েক মাস দুঃসহ অবমাননাকর শ্রম দাসত্বে আবদ্ধ রাখা হতো। অপেক্ষাকৃত অসমর্থ বন্দী- বিশেষত নারী ও শিশুদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাসের অগ্নিশালায় ঢুকিয়ে দেয়া হতো। এখানে বন্দীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৩ লক্ষ্যে। এদের মধ্যে গ্যাস পোড়ানো হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন কমপক্ষে ১১ লাখ মানুষ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী অসউইজে হত্যা করা হয়েছিল ৯৬০০০০ ইহুদী, ৭৫০০০ পোলিশ, ২১০০০ রোমান সম্প্রদায়ের জিপসি ও ১৫০০০ যুদ্ধবন্দী সোভিয়েত সৈন্য। হত্যাকৃত ইহুদীদের মধ্যে ৪৩০০০০ ছিলেন হাঙ্গেরীর, ৩০০০০০ পোল্যান্ডের, ৬৯০০০ ফ্রান্সের, ৬০০০০ নেদারল্যান্ডসের, ৫৫০০০ গ্রীসের, ২৫০০০ বেলজিয়ামের, ১৫০০০ যুগোস্লাভিয়ার, ২৩০০০ জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার, ৭৫০০ ইতালির এবং ৬৯০ জন নরওয়ের। মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা লঙ্ঘনকারী হিসেবে অসউইজের প্রতিষ্ঠাতা রুডলফহোসকে ফাঁসিতে লটকানো হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের লালফৌজ অসউইজের নিকটবর্তী হলে নাজিরা তখনও বন্দীশালায় আবদ্ধ জীবিতদের নির্যাতনের ভয়ে হেঁটে চলা মৃত্যু-মিছিলে ঢুকিয়ে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া থেকে বাইরে পশ্চিমে পাঠিয়ে দেয়। গুলির ভয়ে জোর করে মিছিলে ঢোকান এসব বন্দীদের অনেকে পথিমধ্যেই শীত ও ক্লান্তিতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৫ এর ২৭ জানুয়ারি সোভিয়েত সৈন্যরা অসউইজ বন্দীশালায় প্রবেশ করে মানব ইতিহাসের এই নিকৃষ্টতম হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটায়। অসউইজের নৃশংসতার তথ্য ও সংবাদ মিত্রবাহিনী আগে পেয়েও সোভিয়েতদের আগে বিমান আক্রমণ করে বা দ্রুতগতির রেলে এসে অসউইজ মুক্তকরণের চেষ্টা কেন করেনি জানা যায়নি। ১৯৩৩ সালে জার্মানির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হিটলারের নেতৃত্বে নাজিরা (জার্মান শ্রমিকদের সমাজতান্ত্রিক জাতীয় দল) দখল করে জার্মানদের মূল জাতীয় সত্তা প্রতিরক্ষণের দোহাই দিয়ে ইহুদীদের বিতাড়ণ ও নিশ্চিহ্ন করার কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৯৩৫ সালে তথাকথিত নুরেমবার্গ আইনাবলী জার্মান সংসদ রেগস্টাগ গ্রহণ করে কেবলমাত্র জার্মান বা তাদের রক্ত সম্পর্কিত জনগণকে নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করে এবং এরূপ নাগরিকদের সঙ্গে ইহুদীদের বিবাহ বা অনুরূপ সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ করে। ১৯৩৯ সালে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে পোলিশ নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেয়। ১৯৪০-এর এপ্রিলে অসউইজের বন্দীশালায় পোলিশ রাজনৈতিক বন্দীদের আটক করা হয়। ১৯৪১ এর আগস্টে জার্মানরা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে যুদ্ধে হেরে যাওয়া বন্দী রুশ সৈন্যদের অসউইজে পাঠিয়ে গ্যাস প্রয়োগে হত্যা শুরু করে। ১৯৪২ সাল থেকে মালবাহী বা পশু পরিবহনের ট্রেনে চড়িয়ে জার্মানি দখলকৃত ইউরোপের সকল এলাকা থেকে তথাকথিত ইহুদী প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধানকল্পে নারী-পুরুষ-শিশু ইহুদীদের অসউইজে এবং এর সংলগ্ন বেলজেক, চেলমনো, মাজদানেক, সব্বির ও ট্রোবলিনকায় পাঠাতে থাকে। শেষোক্ত ৫টি বন্দীশালাও শাখা হিসেবে অসউইজ নামের সঙ্গে যুক্ত ও পরিচিত হয়। অসউইজ থেকে এসব নিকটবর্তী বন্দীশালাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হতো। বন্দীশালায় আনীত বন্দীদের মধ্যে প্রায় ৩০% ছিলেন নারী ও শিশু। অসউইজ ও অন্যান্য নিকটবর্তী বন্দীশালায় বন্দী প্রতি ১ বর্গমিটার স্থান দেয়া হয়েছিল। এতটুকু স্থান কোন মানুষেরই বাঁচার স্বল্পতম প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম ছিল না। ফলত দ্রুত গতিতে আনীত বন্দীদের জিকলন বি উৎপাদিত গ্যাস চেম্বারে বা অগ্নিশালায় ঠেলে দিয়ে মারা হতো। অসউইজের বিভিন্ন গ্যাস চেম্বারে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার বন্দীদের হত্যা করা হয়েছিল। যাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে এসব চেম্বারে ঢোকানো হতো না, তাদেরকে শ্রমদাসত্ব, শীত, ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হতে।া যারা তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর শিকার হতেন না, তাদের দিয়ে মানবতার মূল্যবোধ বিবর্জিত জার্মানরা রোগ প্রতিষেধক বিষয়ে পরীক্ষা ও গবেষণা চালিয়েছিল। বন্দীদের শাস্তি হিসেবে গুলি ও বেত্রাঘাত করা ও চাবুক মারা এসব বন্দীশালায় অহর্নিশি চলত। বন্দীবিশেষে কল্পিত বা কৃত অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য জ্বলন্ত চুলায় তাদের মুখ ঠেলে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত করা হতো। বন্দীদের বিষ্ঠা তাদের পরিধেয় যৎসামান্য জামা কাপড়ে মোড়া অপরিচ্ছন্ন দেহে সবসময় লেগে থাকত। তাৎক্ষণিকভাবে অগ্নিশালায় না ঢোকানো বন্দীদের জন্য অসউইজে দিন শুরু হতো ভোর রাতে। তাদের ওপর নির্যাতন এবং শ্রমদাস হিসেবে তাদের ব্যবহার চলত মধ্যরাত পর্যন্ত। অপর্যাপ্ত পানি এবং আরও অপর্যাপ্ত শৌচাগার, পরিধেয় ও জোড়া পাদুকার অপ্রাপ্যতা ও বিষ্টা ত্যাগের সুযোগ ও ব্যবস্থাপনার প্রায় শূন্যতা সকল বন্দীর জীবনকে এখানে পশুর জীবনযাত্রার চেয়েও নিচে নামিয়ে দিয়েছিল। হাঙ্গেরীর এক ইহুদী কিশোর ইলি উইজেল অসউইজের হত্যাযজ্ঞ থেকে কোনক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৬০ এর দশকে অধ্যাপনা করতেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭০ এর দশকে সমাজতত্ত্বে অধ্যয়নরত আমাদের ছোট ভাই ড. আরেফিনের কাছে তার নাম ও পরিচয় জেনে আমি ও স্ত্রী সিতারা পড়েছিলাম ‘অমানিশি’ নামীয় উইজেলের সেই সময়কার স্মৃতিকথা। উইজেল ১৫ বছর বয়সে তার পরিবারের সকল- বাবা সলমো, মা সারা ও বড় বোন হিল্ডা ও বিয়াট্রিস এবং ৭ বছর বয়সী ছোট বোন তিজিপোরাসহ নাগরিকত্ব থেকে বহিষ্কৃৃত ইহুদী বন্দী হিসেবে অসউইজে প্রেরিত হন। অসউইজ পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ মা সারাকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মারা হয়। বোন হিল্ডা ও বিয়াট্রিসকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে অমানুষিক ও অপরিচ্ছন্ন শ্রমে নিয়োগ করা হয়। উইজেল বাবা সলমোর সঙ্গে দাস শ্রমিকের অমানবিক জীবন অসহায় নীরবতার সঙ্গে কাটাতে থাকেন। ১৯৪৫ এ নাজিদের পরাজয় আসন্ন অনুধাবিত হওয়ায় পিতা পুত্রকে নাজিরা আরেক বন্দীশালায় স্থানান্তরের মৃত্যু-মিছিলে ঢুকিয়ে দেয়। তারা মৃত্যুর মুখ থেকে মরতে মরতে বেঁচে যান। বাবা সলমো স্থানান্তরিত বন্দীশালায় আমেরিকানদের দিয়ে মুক্ত হওয়ার ৩ মাস আগে নির্দয় নাজি প্রহরীদের পিটুনিতে মারা যান। বাবাকে পেটানোর সময়ে নিজকে বাঁচানোর জন্য উইজেল মানবতার মূল্যবোধ দূরে সরিয়ে নিশ্চুপ হয়ে নিজের অস্তিত্ব লুকিয়ে রেখেছিলেন। বাঁচার তাগিদে টু শব্দটি পর্যন্ত তিনি করতে পারেননি। উইজেল লিখেছেন- ঐ বন্দীশালায় মানুষের সকল মূল্যবোধ নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। বাবা, ভাই, বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক অবসায়িত হয়েছিল। মানুষ, ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্ম এমনকি সৃষ্টিকর্তাও তার পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। উইজেলের বিবরণীতে মানবতার এরূপ বিপর্যয় অনুধাবন করে আমাদের মনে এসেছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বাঙালীর ওপর সেই অমানবিক অত্যাচারের ঘটনাবলী। একাত্মতা বোধ করেছিলাম সকল অত্যাচারিত মুক্তিকামীদের আত্মার সঙ্গে, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলাম এসব মানবতার অপমানকর অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকল সময়ে রুখে দাঁড়াবার, মানবতার অমানিশার প্রাদুর্ভাবের সকল সম্ভাবনার প্রতিকূলে অবস্থান নেয়ার। প্রায় ২০ বছর আগে আমি ও সিতারা দেখতে গিয়েছিলাম আরেক অসউইজ, অস্ট্রিয়ার ম্যথসেন। আমাদের সঙ্গে ছিলেন অস্ট্রিয়া প্রবাসী নারায়ণগঞ্জের এককালীন ছাত্র নেতা রুবেল ও তার সদা হাস্যমতী স্ত্রী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে অস্ট্রিয়া দখলকারী জার্মানদের স্থাপিত ও পরিচালিত নৃশংস বন্দীশালা ছিল এই ম্যথসেনে। এই বন্দীশালা মুক্তকরণের ৩০ বছর পর ১৯৭৫ সালে এখানে এক স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হিটলারের জন্মনগরী লিনজ থেকে দৃশ্যমান ডানিয়ুব নদীর অপর তীরে ম্যথসেন বন্দীশালায় জার্মানরা মূলত তাদের দখলকৃত ইউরোপীয় দেশসমূহের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের অন্তরীণ এবং শ্রমদাস হিসেবে ব্যবহার করে অধিকাংশকে হত্যা করেছিল। ম্যথসেনে বন্দী ও হত্যাকৃত মানুষের সংখ্যা ৩২০০০০ বলে জানা গেছে। বন্দীশালার বিভিন্ন এলাকা সজল চোখে দেখতে দেখতে জানতে পারলাম ১৯৪৮-এর মে মাসে এডলফ আইকম্যান ম্যথসেনে এসে অসউইজ থেকে ৮০০০ হাঙ্গেরীয় ইহুদীদের স্থানান্তরের ব্যবস্থা করেছিল। ম্যথসেনে প্রায় ৩০০০ নারী ২৫০০ শিশু বন্দী ছিল বলে ১৯৪৫ এ হিসাব করা হয়েছে। ম্যথসেন থেকে ৩ কিঃমিঃ দূরে তেমনি ৩টি উপবন্দীশালা স্থাপিত হয়েছিল। বলা হয়েছে যে এই ৩ উপবন্দীশালায় মূল ম্যথসেনের চেয়ে বেশি সংখ্যক নিরপরাধ মানুষকে বন্দী করে অসহনীয় নির্যাতন করে ও অগ্নিশালায় ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এই বন্দীশালায় অতীব শীতে, নিম্নতম প্রয়োজনীয় খাবার না দিয়ে, স্থানীয় খনি ও কারখানাতে কঠিন পরিশ্রম করিয়ে, প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন করে, বিদ্যুত তারে জড়িয়ে, নির্বিচারে গুলি করে, বরফ শীতে গা ডুবিয়ে এবং গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে বন্দীদের হত্যা করা হতো। এখানকার বন্দীদের নিয়ে নাজি চিকিৎসকরা রোগ প্রতিষেধক উদ্ভাবনমূলক গবেষণাও চালিয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় যক্ষ্মা ও ক্যান্সারের জীবাণু জীবিত বন্দী মানুষের শরীরে প্রবৃষ্ট করেছে বলে জানা গেছে। মহাযুদ্ধকালীন সময়ে ম্যথসেনে প্রেরিত ৩২০০০০ বন্দীদের মধ্যে মাত্র ৮০০০০ যুদ্ধ শেষ হওয়াতক বাঁচতে পেরেছিলেন। ১৯৪৫ সালের ৩-৬ মে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা ম্যথসেন বন্দীশালা মুক্ত করেছিল। মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক যুগ পরে ম্যথসেনের প্রধান নিগ্রহ ও হত্যাকারীকে লাতিন আমেরিকা থেকে ধরে এনে ফাঁসিতে লটকানো হয়েছিল। অসউইজ ও ম্যথসেন মানবতার ওপর নৃশংস অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি না করার সংকল্পবোধ নিয়ে ১৯৪৮ এ গ্রহণ করা হয়েছিল বিশ্ব মানবাধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র। এরপরে ১৯৬৬ সালে গৃহীত হয়েছিল পৃথিবীর সকল অধিবাসীদের জন্য সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা নিয়মপত্র। এই চুক্তিতে জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ ১৯৪৮ সালের বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার ভিত্তি ও প্রেক্ষিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, জাতীয় বা সামাজিক উৎসারণ নির্বিশেষে সকল দেশে সকল মানুষকে সমান আইনী প্রতিরক্ষণ দিতে সংকল্পবদ্ধ। সুস্পষ্ট ভাবে এও বলা হয়েছে যে প্রত্যেক মানুষের জীবনের অধিকার আছে এবং কাউকেই তার জীবন থেকে স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে বঞ্চিত করা এবং কাউকেই অত্যাচার, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অপমানজনক আচরণের আওতায় আনা যাবে না। অসউইজ ও ম্যথসেনে মানুষ সংঘটিত মানবিক বিপর্যয় পরিহার করনের দৃঢ় সংকল্পবোধ আমি ও সিতারা খুঁজে পেয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনে। সেখানে সরকার কেন্দ্রে কেনেডীর নাম ধারক সুউচ্চ ইমারতের লাগোয়া সুড়ঙ্গ-স্মৃতি সবসময় ঝিকিমিকি তারার মতো হাজারও বিদ্যুত-প্রদীপ রাখা হয়েছে নাজি হত্যাযজ্ঞের শিকার পিতৃপুরুষ ও মাতৃ নারীর স্মৃতির ধারক রুপে। এই সুড়ঙ্গের পাশ দিয়ে বারবার সজল চোখে হেঁটে অন্যান্য দেশের মানব মানবীর সঙ্গে আমরাও সংকল্পবদ্ধ হয়েছি আমাদের শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী মানবতার জয় গান নিয়ে সকলের সঙ্গে এগোবার। মনে হয়েছে এই সংকল্পবোধ সকল দেশে যদি আশানুরূপ ভাবে অনুধাবিত ও আলোকিত থাকে তাহলে সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সেখানকার অগণতান্ত্রিক স্বৈর সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার মতো ঘটনা বিশ্ববাসী মেনে নিতে পারবে না। অসউইজ ও ম্যথসেনে মানবতার নৃশংসতম বিপর্যয়ের পটে এবং সকল সম্ভাব্য অমানবিক আগ্রাসন, অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিকূলে ১৯৪৮ সালে ঘোষিত বিশ্ব মানবাধিকারের প্রতীতী এবং ১৯৬৬ সালে গৃহীত সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কভেনান্ট সকল দেশের সকল বিবেকবান নাগরিকদের এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ রাখলে বিবেকবর্জিত অত্যাচার ও অবিচারের অবসান ঘটিয়ে মানবতার পতাকাবাহী হিসেবে আমরা নিজেদের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করতে ও রাখতে সক্ষম হব। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×