ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হামলাকারী ৬ জনই শনাক্ত

বাড়ির তলা গুনতে ভুল হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান ডাঃ সারওয়ার আলী

প্রকাশিত: ১১:৪২, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

বাড়ির তলা গুনতে ভুল হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান ডাঃ সারওয়ার আলী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হামলাকারীদের তলা গুনতে ভুল হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ও ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সারওয়ার আলী প্রাণে বেঁচে যান। হত্যাচেষ্টায় অংশ নেয়া পলাতক ছয়জনই ইতোমধ্যেই শনাক্ত হয়েছে। তাদের বাড়িঘরসহ যাবতীয় তথ্য এখন মামলাটির তদন্তকারী সংস্থার হাতে। যে কোন সময় তারা গ্রেফতার হতে পারে। ইতোমধ্যেই গ্রেফতার ফরহাদ হামলায় অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। পলাতক নাজমুল হামলার আগে রীতিমতো ম্যাপ এঁকে ডাঃ সারওয়ার আলীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ম্যাপ মোতাবেক কার কোথায় অবস্থান হবে তাও স্পষ্ট করে দেয় নাজমুল। ডাঃ সারওয়ার আলীর ওপর হামলার ধরনের সঙ্গে রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির খালাত ভাই ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যার মিল আছে। তবে হামলাকারীরা জঙ্গী সংগঠনের সদস্য কিনা বা কি উদ্দেশে হামলা চালিয়েছিল তা পরিষ্কার নয়। নাজমুলকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেই সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পলাতক নাজমুল এক বছর আগে ডাঃ সারওয়ার আলীর গাড়ি চালক হিসেবে কাজ নিয়েছিল। মাত্র চার মাস কাজ করার পর চাকরি ছেড়ে দেয় নাজমুল। এরপর নাজমুল কি করত তা স্পষ্ট নয়। নাজমুল উত্তরার আজমপুরের লেবার মার্কেট এলাকায় বসবাস করত। ঘটনার পাঁচদিন আগে লেবার মার্কেট থেকে গ্রেফতারকৃত ফরহাদকে টার্গেট করে। ফরহাদ মার্কেটটিতে দিনমজুরের কাজ করত। কুলির কাজ থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রির কাজ, রং করাসহ নানা ধরনের কাজ করত। নাজমুল ফরহাদকে দিনমজুর হিসেবে নেয়। প্রতিদিনই নাজমুল ফরহাদকে দিয়ে ছোট খাটো কাজ করাত। আর দিন শেষে পাঁচ শ’ টাকা করে দিত। নাজমুল ২-৩ দিনেই ফরহাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে। ফরহাদকে তার খুবই ভাল লেগেছে বলে নাজমুল জানায়। গত ৪ জানুয়ারি নাজমুল, ফরহাদসহ আরও পাঁচজন রাজধানীর আশকোনা এলাকায় হাজী ক্যাম্পের সামনের একটি রোজ ভ্যালি হোটেলে একত্রিত হয়। হোটেলটিতে তারা নাস্তা করে। রোজ ভ্যালি হোটেলের ৩০৩ নম্বর কক্ষে তারা একত্রিত হয়। সেখানে নাজমুল ডাঃ সারওয়ার আলীর ওপর হামলার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক নাজমুল ডাঃ সারওয়ার আলীর বাড়ির কোথায় কি আছে এবং হামলায় অংশ নেয়া সাতজনের কোথায় কার অবস্থান হবে তা ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দেয়। বিকেলে তাদের উত্তরার জম জম হোটেলের সামনে যেতে বলে। বিকেল পাঁচটার দিকে সবাই জম জম হোটেলের কাছে একত্রিত হয়। সেখান থেকে সবাই মিলে ডাঃ সারওয়ার আলীর বাসা রেকি করে। এরপর সবাইকে পাঁচ শ’ টাকা করে দিয়ে বিদায় দেয় নাজমুল। পরদিন ৫ জানুয়ারি নাজমুল সবাইকে আবারও নির্দেশনা মোতাবেক জম জম হোটেলের কাছে যেতে বলে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তারা ডাঃ সারওয়ার আলীর বাসার আশপাশে অবস্থান নেয়। এ সময় সেখানে একটি ব্যাগ নিয়ে হাজির হয় নাজমুল। নাজমুল প্রত্যেককে একটি করে সুইচ গিয়ার ধারাল চাকু দেয়। তার ব্যাগে সাতটি চাপাতি ছিল। সেগুলোও প্রত্যেককেই একটি করে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু যে দু’জন ওপরে যাবে বাড়তি ঝামেলার কারণে তাদের আর চাপাতি দেয়া হয় না। নিচে অবস্থান নেয়া পাঁচজন পাঁচটি সুইচ গিয়ার চাকু নিয়ে অবস্থান করতে থাকে। আর ব্যাগে সাতটি চাপাতি নিয়ে নিচে অবস্থান করতে থাকে নাজমুল। ওইদিনই ৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে দশটার দিকে ঢাকার উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের বাসায় লিফটে করে ওঠে দুই হামলাকারী। হামলাকারীদের নাজমুল ডাঃ সারওয়ার আলীর বাসা তিন তলায় বলে জানিয়ে দেয়। নাজমুল হামলাকারীদের লিফটের তিন বলতে ভুলে যায়। এজন্য দুই হামলাকারী তিন তলা ভেবে লিফটের দুই তলায় অর্থাৎ তিন তলায় নেমে যায়। তারা বাসার কলিং বেল চাপে। আগে থেকেই তারা অস্ত্র পেছনে লুকিয়ে রেখেছিল। দরজা খোলা মাত্রই তারা অস্ত্র বের করে ফেলে। এতে করে বাসার লোকজন চিৎকার দেয়। তাদের চিৎকার থামাতে হামলাকারীরা ডাঃ সারওয়ার আলীর মেয়ে ড. সায়মা আলী, তার স্বামী মোঃ হুমায়ুন কবির ও এই দম্পতির মেয়ে অহনা কবিরের গলায় ছুরি ধরে। তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তাদের কাছে হামলাকারীরা ডাঃ সারওয়ার আলীর বাসা কোথায় জানতে চায়। এমন ঘটনায় হতভম্ব হয়ে তারা ওপরের তলার কথা বলে। সে মোতাবেক একজন হামলাকারী ডাঃ সারওয়ার আলীর বাসার দরজায় নক করে। দরজা খোলা মাত্রই তার গলায় ছুরি ধরে। ডাঃ সারওয়ার আলী ও তার স্ত্রী চিৎকার দিলে তৃতীয় তলায় থাকা অপর হামলাকারী নিচ তলার লোকজনদের ছেড়ে ওপরে উঠে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া মেজর (অব) সাহাবুদ্দিন চাকলাদার ও তার ছেলে মোবাশ্বের চাকলাদার সজিব চতুর্থ তলায় যান। সাহাবুদ্দিন চাকলাদার দুর্বৃত্তদের একজনকে ঝাপটে ধরেন। কিন্তু অস্ত্রের মুখে আর তাকে ধরে রাখতে পারেননি। সাহাবুদ্দিন চাকলাদারের ছেলে সজিব অপর হামলাকারীকে লক্ষ্য করে একটি গ্লাস ছুঁড়ে মারেন। তখন দুর্বৃত্তরা দ্রুত বাসার ভেতর থেকে নেমে যায়। এদিকে ডাঃ সারওয়ার আলীর মেয়ে ট্রিপল নাইনে ফোন দিলে দ্রুত উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ সেখানে হাজির হয়। পরে পুলিশ সেখান থেকে হামলাকারীদের ফেলে যাওয়া একটি মোবাইল ফোন, ব্যাগে থাকা সাতটি চাপাতি, সিমবিহীন একটি মোবাইল, আইপ্যাড, নাইলনের দড়িসহ বিভিন্ন মালামাল জব্দ করে। গত ৬ জানুয়ারি ডাঃ সারওয়ার আলী তার বাসার দারোয়ান মোঃ হাসান ও আগের গাড়িচালক নাজমুলসহ অজ্ঞাত ৪-৫ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১০। মামলায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। ওইদিন পুলিশ হাসান ও ডাঃ সারওয়ারের বর্তমান গাড়িচালক হাফিজকে আটক করে। পুলিশের পাশাপাশি মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআই। গত ১৩ জানুয়ারি পিবিআই ভোর ছয়টার দিকে ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে হামলায় অংশ নেয়া ফরহাদকে (১৮) গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ফরহাদের পিতার নাম মোঃ শহীদুল্লাহ। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানাধীন আনন্দপুর গ্রামের কাশেম মোড়লের বাড়িতে।
×