ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পৌষ সংক্রান্তিতে উৎসব

দু’শ’ বছরের ঐতিহ্য, কুশিয়ারা পাড়ে মাছের মেলা

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

দু’শ’ বছরের ঐতিহ্য, কুশিয়ারা পাড়ে মাছের মেলা

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন ॥ বাঙালী সংস্কৃতিতে কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে ‘পৌষ সংক্রান্তি’। বাঙালী জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র-সুরমা বিধৌত এই অঞ্চলে দীর্ঘকালের প্রচলিত ‘বারো মাসে তেরো পার্বণের’ একটি পৌষ সংক্রান্তি। পার্বণ এক ধরনের উৎসব। এসব উৎসব সাধারণত এলাকাভিত্তিক হয়। বাংলা পঞ্জিকার হিসেবে বছরের বারো মাস কোথাও না কোথাও নির্দিষ্ট কোন উৎসব পালন করা হয়। পৌষ সংক্রান্তির সেই অনুষঙ্গ হিসেবে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আমাদের এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ভূখ-ের মধ্যেও একেক এলাকায় একেক ধরনের পালা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ‘পৌষ সংক্রান্তি’ উপলক্ষে মৌলভীবাজার জেলার শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে প্রায় দুই শ’ বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী ‘মাছের মেলা’ রবিবার শুরু হয়েছে। তিন দিনের এই মেলা মূলত শেষ হবে আজ বুধবার দুপুরে। অগ্রহায়ণ মাসের ধান কাটার পর থেকে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। প্রকৃতি-নির্ভর অনেক পার্বণ কালের বিবর্তনে আজ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনও পৌষ সংক্রান্তি ঘিরে আয়োজন হয় মাছ-মেলার। পূর্ব ঘোষণা মতে, এই মেলা তিনদিন চলার কথা থাকলেও মেলা চলে আরও দু’একদিন বেশি। এলাকার বয়োবৃদ্ধ অনেকে এই মেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, সেই ছোটবেলা থেকেই এই মাছের মেলা দেখে আসছেন তিনি। তবে ঠিক কিভাবে এই মেলার গোড়াপত্তন হয় তা তিনি বা তার বয়েসী অনেকেই সঠিক ইতিহাস জানেন না। পৌষের বহমান শৈত্যপ্রবাহে কনকনে শীত উপেক্ষা করে মৌলভীবাজারের শেরপুরে শুরু হয় এই মাছের মেলা। শত শত ক্রেতা-বিক্রেতা আর কৌতূহলী মানুষের আনা-গোনায় প্রতিদিনই জমজমাট থাকে এই মেলা। তিন দিনব্যাপী মেলায় সিলেট বিভাগের বিভিন্ন হাওড় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানের নদ-নদীতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছ কিনতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতা-পাইকাররা এখানে এসে ভিড় জমান। সিলেট ও হবিগঞ্জের সীমানা ঘেঁষে কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণ পারে মৌলভীবাজার জেলার শেরপুর এলাকায় বসে প্রতিবছর বসে এই মাছের মেলা। আর এ অঞ্চলের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষোয় থাকেন কখন বছর ঘুরে আবার শুরু হবে মাছের মেলা। এ বছর মেলায় বড় আকৃতির অসংখ্য দেশীয় মাছ উঠেছে। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মাছের মেলাটি শুরু হলেও এটি এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। মাছের মেলা উপলক্ষে এলাকার দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন আসেন বেড়াতে অথবা বাপের বাড়িতে নাইওর আসেন মেয়েরা। স্থানীয় সূত্র জানায়, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবগিঞ্জ, সুনামগঞ্জরে বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে আড়তের ছোট বড় অনেক জাতের মাছ কিনে নিয়ে যান। মেলায় ছোট আকারের মাছরে দাম হাঁকা হয় ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি সাইজের মাছের দাম হাঁকা হয় ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা এবং বড় সাইজরে মাছের দাম ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়। মেলায় আগত ক্রেতারা জানান, হাওড় ও নদীতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছ ও দেশীয়-প্রজাতির টাটকা, ফরমালিনমুক্ত মাছ পাওয়া যায় বলে অনেকে এই মেলায় মাছ কিনতে আসেন। তবে পছন্দের মাছ বিপুল পরিমাণ পাওয়া গেলেও ‘দাম বেশি’র অভিযোগ অনেকের। বিক্রেতারা জানান, মেলা উপলক্ষে মাছের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় তাদেকে বেশি মূল্যে মাছ সংগ্রহ করতে হয়। মেলার পার্শ্ববর্তী কুশিয়ারা নদী, হাকালুকি হাওড়, কাওয়াদীঘি হাওর, হাইল হাওর ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা রুই, কাতলা, বোয়াল, গজার, বাঘাইড় ও আইড় মাছসহ বিশাল আকৃতির মাছ নিয়ে আসেন মোলায়। এছাড়া এই মেলায় ‘অদেখা’ বড় বড় মাছও দেখতে পাওয়া যায়। এসব অদেখা মাছের দর্শক-ক্রেতারও কমতি থাকে না। মেলায় একসঙ্গে বড় আকারের এত মাছ দেখে আগুন্তুকরা আশ্চর্য হন। তাই বাড়তি কৌতূহল নিবারণে তারা পুরো মাছের মেলা ঘুরে দেখেন। আর মুঠোফোনের ক্যামেরায় নানা দৃশ্য ধরে রাখেন। উঠতি বয়সী তরুণরা বড় মাছের সঙ্গে সেল্ফি তুলেও আনন্দে মেতে ওঠেন। এলাকাবাসী জানান, পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলার নির্ধারিত স্থানে নির্দিষ্ট সময়ের দু’একদিন আগ থেকে জমে ওঠে ইমিটেশন, খেলনা, কাপড়, জুতা, দা, খুন্তি ও গাইলসহ গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় নানা জিনিসপত্রের দোকান। বাদ যায় না চিড়া মুড়ি মুড়কি জিলাপি বাতাশা আর ম-া-মিঠাইসহ মুখরোচক খাবার দাবারে আয়োজন। মেলাস্থল শেরপুর হলেও মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে একেবারেই শেষপ্রান্তে। পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলা, উত্তরে কুশিয়ারা নদী। নদী পেরুলেই সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলা। হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার এই তিনটি জেলার মোহনা শেরপুর। মৎস্য ব্যবসায়ী আর স্থানীয়রা বলেন, এটিই দেশের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা। মেলায় মাছ ছাড়া বেত-বাঁশ, কাঠ, লোহা ও মাটির তৈরি নানা রকম পণ্য, শিশুদের খেলনা, সবজি-আনাজ অনেক ধরনের লোকজ পণ্য, ফার্নিচার, কৃষি পণ্য, গৃহস্থালি সামগ্রী, নানা জাতের দেশীয় খাবারের দোকানসহ থাকে গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা রং ঢং আর প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সহস্রাধিক দোকান বসে। মেলায় জুয়া, পুতুল নাচ, অশ্লীল নৃত্য না থাকায় খুশি পুরো জেলাবাসী। মেলার আয়োজক ও ক্রেতারা এ জন্য প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রশাসনের এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগের কারণে গত ৩ বছর থেকে মাছের মেলা তার ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছে। মেলা আয়োজক ও আড়তদাররা জানালেন মেলায় অন্তত ২ থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ ক্রয় বিক্রয় হয়। তারা জানান, সরকার শত বছর হতে এখান থেকে প্রচুর রাজস্ব পেলেও মেলার জন্য স্থায়ীভাবে কোন জায়গা বরাদ্ধ দিচ্ছেন না। মেলা আয়োজকদের জোর দাবি সরকার ঐতিহ্যবাহী এ মেলার জন্য যেন নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ দেন। মাছের মেলা অয়োজক কমিমিটি সভাপতি মোঃ আশরাফ আলী খান জানান, এটি যদিও মাছের মেলা নামে পরিচিত, তথাপি মাছ ছাড়াও ফার্নিচার, গৃহস্থালি সামগ্রী, খেলনা সামগ্রীসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের দোকান স্থান পায়। বর্তমানে এই মাছের মেলা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মিলনমেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
×