ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জবির প্রথম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি

ভার্সিটি শিক্ষকদের যত অনীহা নির্ধারিত ক্লাস নেয়ার ক্ষেত্রে

প্রকাশিত: ১১:১১, ১২ জানুয়ারি ২০২০

ভার্সিটি শিক্ষকদের যত অনীহা নির্ধারিত ক্লাস নেয়ার ক্ষেত্রে

জবি সংবাদদাতা ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, এক শ্রেণীর শিক্ষক রয়েছেন যারা বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। শনিবার জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, তারা সান্ধ্যকালীন কোর্স ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে সপ্তাহব্যাপী ব্যস্ত সময় পার করেন। এ সমস্ত কাজের বিষয়ে তারা খুবই আন্তরিক। যত অনীহা শুধু বিশ^বিদ্যালয়ের নির্ধারিত ক্লাস নেয়ার ক্ষেত্রে। তবে এসব শিক্ষক সিলেবাস শেষ করার ক্ষেত্রে খুবই সিরিয়াস। তাই তারা একসঙ্গে তিন থেকে চার ঘণ্টা ক্লাস নিয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক সময় ছুটির দিনে ছাত্রছাত্রীদের ডেকে এনে কয়েক ঘণ্টা ক্লাস নেন। শিক্ষার্থীরা কতটুকু বুঝল বা মাথায় নিতে পারল সে ব্যাপারে তাদের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। সেমিস্টার ও সিলেবাস শেষ করেছেন এ সাফল্যে তারা গর্ববোধ করেন। এ বিষয়টি কঠোরভাবে দেখতে হবে। প্রধান নির্বাহী হিসেবে উপাচার্যকে প্রশাসনিক ও বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে কিনা তাও ঠিকমতো দেখভাল করতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যদের উদ্দেশ্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, আপনারা হলেন বিশ^বিদ্যালয়ের মূল চালিকা শক্তি। পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি নিজস্ব আইন। তাই আপনারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে দায়িত্ব পালন করবেন। উপাচার্যগণ হলেন বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনাদের সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। আর আপনারা নিজেরাই যদি অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তাহলে বিশ^বিদ্যালয়ের অবস্থা কি হবে? তাই এ ব্যাপারে নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে অন্যদের সতর্ক করতে হবে। এ সময় তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, শিক্ষকতা অত্যন্ত মর্যাদাশীল পেশা। আপনারা যারা পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তারা মেধাবী ও বিশেষ গুণে গুণান্বিত। তাই আপনারা চাইলে অন্য যে কোন লোভনীয় চাকরি বা পদ-পদবি জোগাড় করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তাই কোন ধরনের লোভ লালসা ও মোহের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পেশার প্রতি মর্যাদাশীল থাকবেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আরও বলেন, তিনি জীবনে অনেক পরীক্ষায় ফেল করেছেন, তবে কখনও পাস করার জন্য নকলের মতো অনৈতিক পথ অবলম্বন করেননি। এমনকি পাশের কাউকে জিজ্ঞেসও করেননি। এটা তার জীবনের অহঙ্কার এবং এটা নিয়ে তিনি গর্ববোধ করেন। আক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, কিন্তু আজ শুনি শিক্ষকরা ছাত্রদের কাছে নকল সাপ্লাই করেন। অনেক জায়গায় শোনা যায় অভিভাবকরা নকল সাপ্লাই করে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। এদের কী শাস্তি হতে পারে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। পরীক্ষায় নকল প্রবণতা ও অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের কারণে দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে এর বিরুদ্ধে সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান জানান রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্রপতি জনগণকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। ফুটওভার না উঠে যত্রতত্র রাস্তা ক্রস করা ঠিক না। যেখানে ব্যবস্থা নেই সেখানে অন্য কথা। সবাইকে নিজে সচেতন হতে হবে এবং অন্যদেরও সচেতন করতে হবে। বিদেশীরা এসে আমাদের চাল-চলন দেখে যেন মনে করেন আমরা সুশৃঙ্খল জাতি। শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেন, আমাদের শুধু একাডেমিক শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। আমাদের জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রচলন শিখতে হবে। যখন যে বিষয় আসবে সেই বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গীবাদ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে এবং অপরকে বিরত রাখতে হবে। সততা, মানবিকতা, পরমতসহিষ্ণুতা দেশ প্রেম এসব ধরে রাখতে হবে। সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. অরুণ কুমার বসাক বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে একই সঙ্গে সমস্যা ও সম্ভাবনার দেশ। সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত থাকে সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী গর্ভধারিণী মা, জনগণ-নির্দেশক দেশমাতৃকা এবং মানুষের আবেগ ধারণকারী মাতৃভাষার মর্যাদার মাধ্যমে। বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ করতে আমি বিনীত নিবেদন রাখছি। দেশের সমস্ত কর্মকা-ে শিক্ষিত মানবশক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সরবরাহ অতএব দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক অপরিহার্য। প্রভাষক সহকারী অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের প্রথম প্রবেশদ্বার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সবর্দা সদয় নির্দেশনা ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতি প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন উপচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ১৫ বছর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন অগ্রগতি মূল্যায়নের যথেষ্ট সময় নয়। তারপরেও আমাদের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাল অবস্থানে ঠাঁই পাচ্ছে। দেশের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ফলাফলে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থান অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে রেজিস্ট্রেশন করেছেন ১৮ হাজার ৩১৭ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে স্নাতকোত্তর ৪ হাজার ৮২৯ জন, স্নাতক ১১ হাজার ৮৭৭ জন, পিএইচডি ছয়জন, এমফিল ১১ জন ও ইভেনিং প্রোগ্রামের ১৫৭৪ শিক্ষার্থী রয়েছেন। এসব গ্র্যাজুয়েটদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন আয়োজন করেছেন। বিকেলে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান সমাপ্তি হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘মনে রাখবেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট খরচের সিংহভাগই আসে সরকারী কোষাগার থেকে, আর কোষাগারে টাকা আসে আপামর জনগণের পকেট থেকে। তাই যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকতা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ পেশা। আপনারা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তারা অত্যন্ত মেধাবী ও বিশেষ গুণে গুণান্বিত ও দক্ষ। তাই কোন ধরনের লোভ-লালসা বা অন্য কোন মোহের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পেশার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখবেন। তাহলেই শিক্ষার্থীরা আপনাদের আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করবে।’ বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি বলেন, ‘বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখছে তা বাস্তবে রূপায়িত করতে সমাজের সকল স্তরের অংশগ্রহণ জরুরী। আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানাচ্ছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ও ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানবসম্পদ উন্নয়ন সব চাইতে জরুরী।’ তিনি বলেন, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এখন সেই লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশ আনন্দময় হতে হবে, যাতে শিক্ষার চাপে আমাদের শিক্ষার্থীদের আনন্দ তিরোহিত না হয়। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মানসম্মত শিক্ষকের বিকল্প নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় অটোমেশন, রোবটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নয়নের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষকদের নিয়োগবিধির খসড়া তৈরি করছে, প্রতিটি জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়াও আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে।’ এ সময় তিনি গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে বলেন, ‘চাকরি প্রত্যাশার চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার আকাক্সক্ষা বেশি দেখাতে হবে, যাতে সেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।’ সমাবর্তন বক্তা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. অরুণ কুমার বসাক বক্তব্য প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ। উল্লেখ্য, প্রায় ১৯ হাজার গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল চারুকলা বিভাগের প্রদর্শনী, নাট্যকলা বিভাগের উদ্যোগে নাটক পরিবেশনা, সঙ্গীত বিভাগের উদ্যোগে সংগীতানুষ্ঠান এবং বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের গানের কনসার্ট। বেলা পৌনে তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন একাডেমিক ভবনের নিচতলায় চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রদর্শনী, দুপুর ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পরিবেশনায় ৫টি নাটক (দ্য ম্যারেজ প্রপোজাল, মৃৎপাত্র, দুই জল্লাদ, সোয়ান সঙ্গ ও দ্য গেম) ধারাবাহিকভাবে পরিবেশনা, এছাড়াও কলা ভবন সংলগ্ন কাঁঠালতলায় বিকেল ৩টা থেকে ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গীত পরিবেশনা এবং বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের গানের কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়।
×