ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরের বিচিত্র মাছ

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

সাগরের বিচিত্র মাছ

বৈদ্যুতিক মাছ সাগরতলের বিস্ময়কর মাছের প্রজাতির মধ্যে বৈদ্যুতিক মাছ অন্যতম। ইংরেজীতে ইলেকট্রিক ফিশ বলা হয়। পৃথিবীজুড়ে ৬৯ প্রজাতির বৈদ্যুতিক মাছ আছে। বৈদ্যুতিক মাছ বিশেষভাবে গঠিত তার বৈদ্যুতিক অঙ্গ থেকে শক দেয়। এই অঙ্গ বেশির ভাগ বৈদ্যুতিক মাছের লেজে অবস্থিত। তবে কোন কোন প্রজাতিতে মাথায়ও দেখা যায়। এই অঙ্গবিশেষ স্থায়ুকোষ দিয়ে গঠিত ইলেকট্রিক লোবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। এ অঙ্গ থেকে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক শক্তিকে ঊষবপঃৎরপ ঙৎমধহ উরংপযধৎমব (ঊঙউ) বলা হয়। শিকারকে বধ করতে ও নিজেকে রক্ষা করতে এরা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বিদ্যুত মাছ এমনই একটি মাছ, যা বিদ্যুত উৎপন্ন করতে পারে। একটি ইলেকট্রিক ফিশ তার বৈদ্যুতিক অঙ্গের শক দ্বারা একটি শক্তিশালী ঘোড়াকে মুহূর্তের মধ্যে কাবু করে ফেলতে পারে। লোনা ও স্বাদু উভয় ধরনের পানিতে বিদ্যুত মাছ পাওয়া যায়। দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাগর ও নদীর স্বচ্ছ পানিতে এ মাছ পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতের বৈদ্যুতিক মাছের মধ্যে একেক জাতের বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা অনেক ধরনের। ইলেকট্রিক ইল নামক মাছ শুধু রাতের বেলায় শিকার খুঁজতে বের হয়। এর ইলেকট্রিক শকের ক্ষমতা এত বেশি যে বড় প্রাণীও ঘায়েল হয়ে যায়। প্রজাতিভেদে এরা ৮ থেকে ২২০ ভোল্ট পর্যন্ত বিদ্যুত উৎপন্ন করতে পারে। এদের কোন কোন প্রজাতি বৈদ্যুতিক অঙ্গের শক দিয়ে একটি শক্তিশালী ঘোড়াকে পর্য কাবু করে ফেলতে পারে। আপাত চুপচাপ ও নিরীহ প্রকৃতির এই মাছ সাগরের লোনা পানিতে ও মোহনায় বসবাস করে। নিজেদের রক্ষার জন্য এদের নিঃসৃত বৈদ্যুতিক শক অন্য প্রাণীর জন্য বিপজ্জনক। তলোয়ার মাছ প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাহ বা যোদ্ধাদের কাছে থাকত তলোয়ার। তলোয়ার দিয়ে তাঁরা যুদ্ধ করতেন এবং আত্ম রক্ষা করতেন। মাছটির ঠোঁট থেকে বের হওয়া একটি শক্ত ধারাল তলোয়ারাকৃতির বিশেষ অংশের জন্য এর এ নাম দেয়া হয়েছে। কোন কোন দেশে মাছটি ব্রডবিল নামেও পরিচিত। যাযাবর প্রজাতির এ মাছটির শিকারি হিসেবে বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। মাছটি তাদের ঠোঁটে থাকা ধারাল অস্ত্র দিয়ে শিকার করে থাকে। তলোয়ার মাছ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে সাঁতার কাটতে সক্ষম। আটলান্টিক, প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এ মাছ বেশি দেখা যায়। তলোয়ার মাছ ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ২২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানির মধ্যেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে তাদের সহ্য ক্ষমতা প্রকট। তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের এদিক-ওদিক হলেও এরা মানিয়ে নিতে পারে। মাছটির গড় দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮ ফুট। এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড়টির দৈর্ঘ্য ছিল ১৪ দশমিক ৯ ফুট, ওজন ছিল ৬৫০ কেজি। মেয়ে তলোয়ার মাছেরা পুরুষদের চেয়ে আকারে বড় হয়। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সের মাছকে প্রাপ্তবয়স্ক বলা হয় এবং এ সময়েই তারা সব দাঁত হারায়। এদের গড় আয়ু ৯ বছর। মাছের প্রায় ২৫ হাজার প্রজাতির মধ্যে মাত্র ২২টি প্রজাতি এদের দেহ থেকে তাপ উৎপন্ন করতে পারে। তলোয়ার মাছ সেই ২২ প্রজাতির একটি। চোখের পাশে থাকা বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে তলোয়ার মাছ তাদের চোখ ও মস্তিষ্কের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। মাছটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তাদের শিকার ধরতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ১০ কোটি বছর আগের সোর্ড ফিশ প্রাণীটি আজকের সোর্ড ফিশ বা তলোয়ার মাছের মতো দেখতে। আজ থেকে ১০ কোটি বছর আগে সাগরতলে ছিল তার বাস। অস্ট্রেলিয়ায় কুইন্সল্যান্ড রাজ্যে সম্প্রতি পাওয়া গেছে ওই প্রাণীর ফসিল অর্থাৎ জীবাশ্ম। উড়ুক্কু মাছ উড়ুক্কু মাছ বা ফ্লাইং ফিশ হচ্ছেÑ ইবষড়হরভড়ৎসবং বর্গের ঊীড়পড়বঃরফধব পরিবারের সদস্য। এসব মাছ সমুদ্রের উপরিভাগে অল্প দূরত্ব অবধি উড়ার ক্ষমতা রাখে । এদের বক্ষ পাখনা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রেণী পাখনাও প্রসারিত হয়ে ডানার মতো গঠন তৈরি করে। এই মাছের অধিকাংশই সামুদ্রিক এবং সাধারণত ঝাঁক বেঁধে চলে। অতি দ্রুত সাঁতার কাটতে গিয়ে এরা অনেক সময়ে জলের একেবারে উপরিভাগে চলে আসে এবং পাখনা মেলে বাতাসে উড়াল দেয়। এদের দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ৩০ সেমি অবধি হতে পারে। এরা মূলত শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই বাতাসে উড়াল দিয়ে থাকে । আকাশে পাখি ওড়ার আট কোটি বছর আগে থেকেই উড়ুক্কু মাছের রাজত্ব। ডাইনোসরের আগে থেকেই এ মাছের অস্তিত্ব ছিল। এখনও রয়েছে গ্রীষ্মম-লীয় সাগরে। উড়ুক্কু মাছ বলতে কিন্তু কোন নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছকে বোঝায় না। বিশ্বজুড়ে ৬৪ প্রজাতির উড়ুক্কু মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে।ওড়ার জন্য উড়ুক্কু মাছের কিন্তু কোনো ডানা নেই। পানির নিচে গড়পড়তা উড়ুক্কু মাছের বেগ হয় ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। তবে পানির বাইরে তাদের গতিবিধি কিন্তু আকাশের চোখ তুলে দেয়ার মতো। পানির ওপরে ৩১২ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত তারা দিব্যি ভেসে বেড়াতে পারে। রং-বেরঙের আলোর প্রতি উড়ুক্কু মাছের রয়েছে মারাত্মক দুর্বলতা। এই আলোর নেশাকে কাজে লাগায় মাছ শিকারিরা। উড়ুক্কু মাছ খেতে সুস্বাদু। বাণিজ্যিকভাবে জাপান, ভিয়েতনাম, বার্বাডোস ও ভারতে এ মাছ প্রচুর ধরা হয়। পাতাওয়ালা সি ড্রাগন পাতাওয়ালা সি ড্রাগনের বৈজ্ঞানিক নাম চযুপড়ফড়ৎঁং বয়ঁবং, এটি ঝুহমহধঃযরফধব পরিবারের প্রাণী। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ , পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে এদের বাস। এদের দেহ থেকে লম্বা পাতার মতো গঠন বের হয়। এগুলো এই মাছের ছদ্মবেশ ধরতে সহায়ক। এদেরকে যে কেউ সামুদ্রিক আগাছা বলে ভুল করতে পারে। এটি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সামুদ্রিক প্রতীক। এদের দেহ ছদ্মবেশ ধরার জন্য চমৎকারভাবে অলংকৃত । সামুদ্রিক আগাছা ও কেল্পের সঙ্গে একাকার হয়ে থাকার জন্য এদের পুরো দেহে পাতা আকৃতির গঠন থাকে । এরা সিহর্স ও পাইপ ফিশের নিকটাত্মীয়। পাতাগুলোর রং সাধারণত বাদামি থেকে হলুদ হয়। পুরুষ সি ড্রাগনের লেজের নিচের দিকের ¯পঞ্জি পট্টির মতো অংশে স্ত্রী সি ড্রাগন তাদের উজ্জ্বল গোলাপী বর্ণের ডিম সঞ্চয় করে রাখে। ডিম স্থানান্তরের সময় ডিমের নিষেক ঘটে । পুরুষ সি ড্রাগন ডিমে তা দেয় এবং চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে সি ড্রাগনের বাচ্চারা সমুদ্রের পানিতে মুক্ত হয়। কাঁকড়া , চিংড়ি জাতীয় প্রাণী এই সি ড্রাগনের খাদ্য। দূষণ ও আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে এরা হুমকির মুখে । ঘোড়া মাছ ঘোড়া মাছের ইংরেজ নাম হলোÑ ঝবধযড়ৎংব। সামনের অংশ দেখতে ঘোড়ার মতো ও পেছনে বাঁকানো লেজ ওয়ালা এই প্রাণীটিকে মাছের মতো দেখা না গেলেও এটি সত্যিকারেই একটি অস্থিময় মাছ। লম্বায় প্রায় ১.৫ সে. মি. থেকে ৩৫ সে. মি. পর্যন্ত হতে পারে। এখন পর্যন্ত ৫০ প্রজাতির নামকরণ হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে এরা ১-৫ বছর বাঁচে। অস্থিময় মাছ হলেও এদের কোন আঁইশ নেই, তবে অস্থিময় পাতের ওপর পাতলা চামড়ার আবরণ রিং এর মতো সাড়া দেহে আবৃত। প্রতি প্রজাতির জন্য রিং এর সংখ্যা আলাদা। মাথায় মুকুটের (পড়ৎড়হবঃ) মতো আছে যা আবার একই প্রজাতির প্রত্যেকটি প্রাণীর জন্য আলাদা। একটি মাত্র পৃষ্ঠীয় পাখনা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৫ বার ঝাপটিয়ে খাড়াভাবে খুব ধীরে চলাচল করে। বাঁকানো লেজের সাহায্যে এরা সামুদ্রিক আগাছা ও শৈবালের সঙ্গে আঁকড়ে থাকে ও আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে গায়ের রং পরিবর্তন করে; কখনও কালচে-বাদামি, কখনো ধূসর বা উজ্জ্বল হলদে। এরা এদের চোখ আলাদাভাবে নাড়তে পারে। প্রাণী পুরুষরা বাচ্চা প্রসব করে। বছরজুড়ে প্রজননকালে স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের পেটের দিকে অবস্থিত বিশেষ থলেতে ডিম পাড়ে এবং ২-৪ মাস গর্ভকালীন সময় শেষে পুরুষ মাছ ৫-১৫০০টি জীবন্ত বাচ্চা প্রসব করে। গর্ভকালীন সময়ে স্ত্রী মাছ প্রতিদিন সকালে একবার করে পুরুষ মাছটিকে দেখতে আসে ও সেবাযতœ করে যায়। পুরুষরা মূলত রাতেই বাচ্চা প্রসব করে। কারণ, পরবর্তী দিন সকালে যখন স্ত্রী মাছ তাকে দেখতে আসবে তখন যেন নতুন করে ডিম গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। বাচ্চারা জন্মের পরপরই স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে। চীনে ‘সামুদ্রিক ঘোড়াকে’ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। উড়ন্ত গার্নার্ড এটি একটি সামুদ্রিক মাছ। এই মাছ হেলমেট গার্নার্ড নামেও পরিচিত। এই মজার প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম উধপঃুষড়ঢ়ঃবৎঁং াড়ষরঃধহং, এটি উধপঃুষড়ঢ়ঃবৎরফধব পরিবারের সদস্য । এই মাছের বক্ষের দুপাশের পাখনা প্রসারিত হয়ে বড় ডানার মতো হয় কিন্তু এরা উড়তে পারে না । আটলান্টিক মহাসাগরের গ্রীষ্মম-লীয় এলাকা থেকে নাতিশীতোষ্ণ এলাকার তলদেশে এই মাছ বাস করে । এই মহাসাগরের আমেরিকান অংশের ম্যাসাচুসেটস ও আর্জেন্টিনা, আফ্রিকীয় অংশে ইংলিশ চ্যানেল থেকে এঙ্গোলা এবং ক্যারিবীয় উপসাগর ও মেক্সিকো উপসাগরে উড়ন্ত গার্নার্ড মাছের বাস। এই মাছ বাদামি, সবুজাভ, লালচে, হলুদাভ ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের হয়। উত্তেজিত হলে এই মাছ তার ডানা মেলে ধরে। পাখনা অর্ধস্বচ্ছ এবং শীর্ষে উজ্জ্বল নীল রং থাকে। এই মাছের একজোড়া বড় চোখ থাকে। উড়ন্ত গার্নার্ড দৈর্ঘ্যে ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে এবং ওজন ১.৮ কেজি হতে পারে। ছোট মাছ, কাঁকড়া ও চিংড়ি জাতীয় প্রাণী এদের খাদ্য। সমুদ্রের বালুময় তলদেশে এদের হাঁটতে দেখা যায়।
×