ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিনিয়র নেতারা তারেকের তোপের মুখে

বিএনপি এক পা এগিয়ে ফের দু’পা পিছিয়েছে

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ৩০ নভেম্বর ২০১৯

বিএনপি এক পা এগিয়ে ফের দু’পা  পিছিয়েছে

শরীফুল ইসলাম ॥ কিছুতেই আন্দোলনের পথে এগোতে পারছে না বিএনপি। বহু হাকডাক করে এক পা এগিয়ে আবারও দুই পা পিছিয়ে গেছে দলটি। এদিকে বার বার নির্দেশ দেয়ার পরও বিএনপি নেতাকর্মীরা আন্দোলনের জন্য মাঠে না নামায় নাখোশ হয়েছেন লন্ডন প্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ পরিস্থিতিতে দলের ক’জন সিনিয়র নেতা তারেক রহমানের তোপের মুখে রয়েছেন। বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলনের হুমকি দেয়ার পর সম্প্রতি হাইকোর্টের সামনে রাজপথ অবরোধ করে বিশৃঙ্খলা করতে গিয়ে বিএনপির ৫০১ নেতাকর্মী মামলার আসামি হন। এর পর ক’জন সিনিয়র নেতাসহ বেশ ক’জনকে আটক করা হলেও পরে তারা জামিনে মুক্ত হন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে থাকার কারণে তারা এখন দলীয় কর্মকান্ড থেকে দূরে। আর সিনিয়র নেতাদের এ অবস্থা দেখে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েন। এর ফলে আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি এক পা আগালেও এ ঘটনার পর আবারও দুই পা পিছিয়ে গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দলের সিনিয়র নেতারা আন্দোলন কর্মসূচী দেয়ার হুমকি দিলেও পরে চুপসে যান। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চরম হতাশ থাকায় এবং তারা এভাবে শোচনীয় পরাজয়ের জন্য কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের দায়ী করার পাশাপাশি কোন অবস্থাতেই আন্দোলনে অংশ নেয়ার বিষয়ে সায় দেয়নি। আর এ কারণেই তখন বিএনপি কোন আন্দোলন কর্মসূচী দিতে পারেনি। তবে বিগত এক মাস আগে থেকে আবারও নতুন করে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের কথা বলতে থাকে। সম্প্রতি বিএনপির এক সমাবেশ থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দেন এখন থেকে তাদের দল আর রাজপথে কর্মসূচী পালনের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন অনুমতি নেবে না। তাঁর এ ঘোষণার দুদিন পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে দলের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী হঠাৎ করে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে মিছিল নিয়ে হাইকোটের সামনে গিয়ে রাজপথ দখল করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এতে পুলিশ বাধা দিলে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কিন্তু পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও বেশ ক’জনকে আটকের পর পরিস্থিতি শান্ত করে। পরে পুলিশ ৫০১ বিএনপি নেতাকর্মীর নামে মামলা দিয়ে ক’জনকে আটক করলে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির কার্যক্রম আবারও স্থবির হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচী পালনের বিষয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছিল। তবে ৫০১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলার পর সে গতি আবার থেমে গেছে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। তিনি বলেন, হাইকমান্ডের ভুলের কারণে বার বার দলকে মাসুল দিতে হচ্ছে। অতীতে দেখা গেছে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করে সিনিয়র নেতারা বাসায় অবস্থান করেন। আর তৃণমূল নেতাকর্মীরা রাজপথে কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে মামলা-হামলার শিকার হন। কিন্তু তাদের আশানুরূপ সহযোগিতা করা হয় না। সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচী দিতে চাইলে খালেদা জিয়া নিজেই আন্দোলন থেকে বিরত থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করতে দলের নেতাদের নির্দেশ দেন। এর ফলে বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতীকী অনশন কর্মসূচী ছাড়া আর কোন কর্মসূচী পালন করেনি। তবে এক পর্যায়ে লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নেতাকর্মীদের আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার নির্দেশ দিলে সিনিয়র নেতারা এ বিষয়ে তৎপর হয়ে উঠেন। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কাছাকাছি চলে এলে আন্দোলন ও খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা বাদ দিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। বিএনপি মহাসচিব বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের কাছে ধর্ণা দেন। এই দুই প্রবীণ নেতাই বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর নির্বাচনী জোট করতে সম্মত হন। তবে বি চৌধুরী শর্ত দেন বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে আসতে হবে। কিন্তু জামায়াত ত্যাগ না করায় বি চৌধুরী সরে গেলে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। এ জোটে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের শরিকরা ছাড়াও আসম রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না শামিল হন। তবে নির্বাচনের পর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এ জোট থেকে সরে দাঁড়ান। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা চাঙ্গাভাব ফিরে আসলেও খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে পারেনি তারা। ড. কামাল হোসেন রাজি না থাকায় এ জোট খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাজপথে নামতে পারেনি। এ নিয়ে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতার মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি ২৪০ আসন রেখে জামায়াতকে ২৫ সহ জোটের শরিকদের ৬০টি আসন ছেড়ে দেয়। তবে জামায়াতকে ধানের শীষ দিয়ে নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে পড়ে দলটি। খোদ বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরাও হাইকমান্ডের এ সিদ্ধান্ত মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। এ ছাড়া যেসব আসনগুলো জামায়াতকে ছাড়া হয় সেসব এলাকার তৃণমূল নেতারা দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা ভর করে। এ কারণে তারা ভোটের মাঠেও নিষ্ক্রিয় ছিল। একই কারণে নির্বাচনের পর আন্দোলনে সায় দেয়নি তারা। তাদের যুক্তি দলীয় হাইকমান্ডের মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে বিএনপির অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা দল থেকে মনোনয়ন পাননি। কেন তাদের মনোনয়ন দেয়া হয়নি কারণও জানানো হয়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশাপাশি অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি নাখোশ হন। তারেক রহমান বিদেশে বসে যেভাবে দল চালাতে চাচ্ছেন সেভাবে দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে কিছু সিনিয়র নেতা তাকে বেশ ক’বার জানিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে তারেক রহমানও সিনিয়র নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তবে প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। নির্বাচনের পর এ পর্যন্ত দলের সিনিয়র নেতাদের বেশ ক’টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রতিটি বৈঠকেই তারেক রহমান স্কাইপিতে তাদের সঙ্গে কথা বলে কিছু দিকনির্দেশনা দেন। কিন্তু তারেক রহমান যেভাবে দল পরিচালনা করতে চাচ্ছেন সেভাবে দল পরিচালনা করতে সিনিয়র নেতারা একমত পোষণ করতে পারেননি। বিশেষ করে রাজপথে নামার বিষয়ে তারেক রহমানের নির্দেশনা তারা মানতে পারছেন না বলেও মাঠে নামেননি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীই চান জাতীয় কাউন্সিল করে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের নিয়ে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করা হোক। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও এমনটিই চায়। বিশেষ করে সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত যেসব নেতা এখনও কমিটিতে স্থান পাননি, তারা চান নতুন কাউন্সিলের পর কমিটি পুনর্গঠন করা হোক। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন কাউন্সিলের বিষয়ে মাথা ঘামাতে চাচ্ছেন না। আর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা নিয়ে বিএনািপ চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখন কারাগারে থাকায় তারেক রহমানের মতামত উপেক্ষা করে অন্য সিনিয়র নেতারাও এ ব্যাপারে অগ্রসর হওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সার্বিক কর্মকান্ড এখন স্তিমিত হয়ে গেছে। তারেক রহমানের কারণে কাউন্সিল হচ্ছে না বুঝতে পেরে দলের নেতাকর্মীরাও তার নির্দেশে রাজপথের আন্দোলনে নামতে সম্মত হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির আরেক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, তারেক রহমান দেশের বাইরে তাই তিনি দেশের বাস্তবতা বুঝছেন না। তিনি যেভাবে রাজপথের আন্দোলন চাচ্ছেন সেভাবে আন্দোলন করতে আপাতত দেশে অবস্থান করা নেতাকর্মীরা প্রস্তুত নয়। তাই আন্দোলনের ব্যাপারে দলের নেতাকর্মীরা কিছুটা অগ্রসর হলেও ৫০১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর সেই অবস্থা আর নেই। এখন দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে চলছে।
×