ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের অন্তিম শ্রদ্ধা আজ

কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের চিরবিদায়

প্রকাশিত: ১১:০৭, ২৭ নভেম্বর ২০১৯

কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের চিরবিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিভৃতি আনে মধুরিমা বিপন্ন মনোভূমিতে/একটু অবহেলা অকুল সাগরে ডুবে যায়/দূরে আকাশ ঝুলে আছে শূন্যতার প্রামেত্ম/তবুও দৃশ্যমান অতলের কালে বিষণœতা বিদায় ...। নিজের লেখা এই কবিতার কথামতোই বিষাদের সুর তুলে চিরবিদায় নিলেন কবি রবিউল হুসাইন। একুশে পদকজয়ী এই কবি ও স্থপতি মঙ্গলবার সকাল সাতটা ৫৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই ট্রাস্টির বয়স হয়েছিল ৭৬। বিপতœীক কীর্তিমান মানুষটি রেখে গেছেন ছেলে রবিন হুসাইনসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী। রক্ত সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। গত দুই সপ্তাহ ধরে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার তাকে সিসিইউতে নেয়া হয়েছিল। রবিউল হুসাইনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়সহ সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এছাড়া শোক প্রকাশ করে বাণী দিয়েছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সভাপতি-মলীর চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা পান্না কায়সার শোক জানিয়েছেন। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বুধবার বেলা এগারোটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে রবিউল হুসাইনের মরদেহ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে নাগরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে ঢাবি কেন্দ্রীয় মসজিদে তার জানাজা হবে। এরপর মরদেহ নেয়া হবে তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রবিউল হুসাইনকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী। এর আগে মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল থেকে রবিউল হুসাইনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার ধানম-ির বাসভবনে। পরিবারের মানুষদের ভালবাসা নিবেদনের পর রাতে মরদেহ হয় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের হিমঘরে। রবিউল হুসাইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মঙ্গলবার দুপুরে তার ধানম-ির বাসায় যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় আধাঘণ্টা কবির বাসায় উপস্থিত থেকে তিনি কবির চিকিৎসার বিষয়ে এবং তার পরিবারের খোঁজখবর নেন। ধানম-ির বাসায় নেয়ার আগে রবিউল হুসাইনকে শেষবারের মতো দেখতে বিএসএমএমইউতে আসেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবল্লাহ সিরাজী, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরসহ অনেকে। এসময় আসাদুজ্জামান নূর বলেন, নিভৃতচারী এক মানুষ ছিলেন রবিউল হুসাইন। আচরণে ছিলেন খুবই আন্তরিক। সহজ-সরল ও প্রাণবন্ত এই মানুষটির সান্নিধ্য সহজেই যে কারও মন ভাল করে দিত। তার চলে যাওয়া আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্দোলনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ। তার মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক সক্রিয় সৈনিককে হারাল। রবিউল হুসাইনের চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য ডাঃ হারিসুল হক জানান, রবিউল হুসাইন ‘এ প্ল্যাস্টিক এ্যানিমিয়ায়’ ভুগছিলেন। এটি এক ধরনের ‘বোন ক্যান্সার’। এতে শরীরে রক্ত উৎপাদন হয় না। তার রক্ত কমে যাচ্ছিল। ১৬ নবেম্বর রবিউল হুসাইন বিএসএমএমইউতে হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা বেগমের অধীনে ভর্তি হন। ১৮ নবেম্বর তার চিকিৎসায় মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। বিএসএমএমইউতে ভর্তি আগে তিনি দেশের বাইরে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ’১৮ সালে একুশে পদকপ্রাপ্ত রবিউল হুসাইন নিবেদিত কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্রের ট্রাস্টি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী পরিষদের সদস্য। ষাটের দশকে ছাত্র থাকাকালেই তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলিয়ে দুই ডজনের বেশি বই রয়েছে তার। একুশে পদক ছাড়াও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও সার্চ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই কবি ও স্থপতি। রবিউল হুসাইনের কবিতাগ্রন্থগুলো হলো সুন্দরী ফণা, কোথায় আমার নভোযান, কেন্দ্রধ্বনিতে বেজে ওঠে, আমগ্ন কাটাকুটি, কবিতাপুঞ্জ; উপন্যাস : বিষুবরেখা; প্রবন্ধ-গবেষণা : বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি; শিশুসাহিত্য : কুয়াশায় ঘরে ফেরা, দুর্দান্ত। সম্পাদনা : কবিতায় ঢাকা। বাঙালি জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যভুবন। বিংশ শতাব্দী ষাটের দশকে না ছোটকাগজের মধ্য দিয়ে এদেশের ছোটকাগজ আন্দোলনেও তিনি তাঁর অঙ্গীকারের প্রমাণ রেখে গেছেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। স্থপতি রবিউলের ঝোঁক ছিল ইট নিয়ে নক্সা ও ডিজাইনের প্রতীকে। তার প্রিয় কাজের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি) ভবন। এছাড়াও ঢাবির মুক্তি ও স্বাধীনতা তোরণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গেট, ভাসানি হল, বঙ্গবন্ধু হল, শেখ হাসিনা হল, খালেদা জিয়া হল, ওয়াজেদ মিয়া সায়েন্স কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অডিটরিয়াম ও একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে রবিউল হুসাইনের নক্সায়। বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য রবিউল হুসাইন শিশু কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিক এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ঝিনাদহের শৈলকুপায়। কুষ্টিয়ার সিরাজুল ইসলাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক (১৯৫৯), কুষ্টিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (১৯৬২) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক (১৯৬৮) সম্পন্ন করেন। জীবনের নানা পর্বে স্থপতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বাংলা একাডেমির ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউসসহ বিভিন্ন স্থাপনা সংস্কার ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা বিন্যাসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, জাতীয় কবিতা পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
×