ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ মোঃ আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ॥ আধুনিকতা ও ডায়াবেটিস

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ॥ আধুনিকতা ও ডায়াবেটিস

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ১৪ নবেম্বর। বিশে^র প্রত্যেকটি দেশেই কমবেশি ডায়াবেটিসের উপস্থিতি রয়েছে এবং বিশ^ব্যাপী পাটিগাণিতিক হারে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাা (ডঐঙ) ও ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (ওউঋ) যৌথ উদ্যোগে ১৯৯১ সাল থেকে বিশ^ ডায়াবেটিস দিবস পালন শুরু হয়। বিশে^র অনেক জায়গাতেই গোত্রগত, বর্ণগত এবং এলাকাভিত্তিক রোগ রয়েছে যেগুলোর জন্য বিশ^ব্যাপী দিবস নেই। ডায়াবেটিস সারা পৃথিবীতেই সকল বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, সকল বয়সী নারী পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ সবার রোগ। যে কারণে বিশ^ ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়। দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো ডায়াবেটিস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা। এবারে ডায়াবেটিস দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘ফ্যামিলি এবং ডায়াবেটিস’। প্রতিপাদ্য বিষয় বিশ্লেষণ করলে যে মূল বক্তব্যটি বেরিয়ে আসে তা হলো ডায়াবেটিস নামক আজীবনের রোগটি শুধুমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটা গোটা পরিবারের সমস্যা এবং পরিবারের সকলে মিলে এটা মোকাবেলা করতে হবে। ফ্যামিলির সবাইকে রোগীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে হবে এবং সবার সহানুভূতি ও সহযোগিতায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রক্তের সুগার অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে বা অতিমাত্রায় কমে গেলে তার লক্ষণ কি হবে সে সম্পর্কে ফ্যামিলির সকলকে অবহিত করতে হবে যাতে বিপদের সময় যিনি উপস্থিাত থাকবেন তিনি যেন সাহায্য করতে পারেন। এখানেই ফ্যামিলির সঙ্গে ডায়াবেটিস এর মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে। ডায়াবেটিসে বংশগত প্রভাব কাজ করে, তবে বংশে নেই কিন্তু অতিরিক্ত ওজন, শারীরিক পরিশ্রমবিহীন জীবনযাপন, ধূমপান, রোগ-বালাই ইত্যাদি কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে। রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (ময়দা), ফাস্ট ফুড ও পশুর মাংস ওজন বৃদ্ধির সহায়ক। যে কারণে এগুলোকে ডায়-বেটো-জেনিক খাদ্য বলা হয়। যান্ত্রিক সমাজে শারীরিক পরিশ্রমবিহীন জীবনযাপনের ফলে বিশ^ব্যাপী স্থূলতার (অতিরিক্ত ওজনের) হার ও ডায়াবেটিসের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পচ্ছে। যেমন টোকেলাই আইল্যান্ডে স্থূলতার হার ৯০% ও ডায়াবেটিসের হার ৩৭.৫০% ; মার্শাল আইল্যান্ডে স্থূলতার হার ৭৫% ও ডায়াবেটিসের হার ৩৫%; কিরিব্যাটি আইল্যান্ডে স্থূলতার হার ৭৪% ও ডায়াবেটিসের হার ২৯%; টোভালো আইল্যান্ডে স্থূলতার হার ৬৮% ও ডায়াবেটিসের হার ২৮%; কুক আইল্যান্ডে স্থূলতার হার ৯০% ও ডায়াবেটিসের হার ২৬% ; সৌদি আরবে স্থূলতার হার ৬৮% ও ডায়াবেটিসের হার ২৪%; কুয়েতে স্থূলতার হার ৭৪% ও ডায়াবেটিসের হার ২৩%; কাতারে স্থূলতার ৭০% ও ডায়াবেটিসের হার ২৩% । বাংলাদেশে স্থাানীয় পর্যায়ে স্থূলতার সার্ভে সম্পর্কে তেমন কোন রিপোর্ট নেই। তবে ইন্ডিপেনডেন্ট গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ সেন্টার (ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিস্ক এ্যান্ড ইভালোয়েশান) এর সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে স্থূলতার হার ১৭%। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে কৃষিতে ও গৃহস্থালিতে যান্ত্রিক সরঞ্জামাদির ব্যবহার কৃষি ও গৃহস্থালিভিত্তিক শারীরিক পরিশ্রমের (ব্যায়াম) সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার গ্রামীণ জনপদের মানুষকে হাঁটাহাঁটিজনিত পরিশ্রম (ব্যায়াম) করার সুযোগ দিচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশেও শারীরিক পরিশ্রম (ব্যায়াম) কমে যাওয়ার কারণে মানুষের ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সুস্বাস্থ্যের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, দীর্ঘায়ুর জন্য, হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য হাটাহাটি সর্বোৎকৃষ্ট ব্যায়াম । অতীতে কারও ডায়াবেটিস ধরা পড়লে ভেঙ্গে পড়ত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডায়াবেটিস এখন কোন সমস্যা নয়। জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহিমের থ্রিডি নির্দেশিকা অনুযায়ী জীবনযাপন করলে সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা যাবে। স্বস্তিদায়ক তথ্য হলো ৯০% ডায়াবেটিস (টাইপ-২) প্রতিরোধযোগ্য। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মূল কারণ হলো স্থূলতা বা শরীরের ওজন বৃদ্ধি। বাকি ৮% ডায়াবেটিস ইনসুলিন নির্ভরশীল যা প্রতিরোধযোগ্য নয়। অবশিষ্ট ২% ডায়াবেটিস অন্যান্য কারনে হয়ে থাকে। সারা বিশে^ ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসের গড় হার ছিল ৪.৭%, বর্তমানে তা ৮.৫%। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থাার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে প্রত্যেক দেশেই ডায়াবেটিসের হার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন চীনে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিস ছিল ১%, বর্তমানে তা ১০%; ভারতে ১৯৭০ সালে ডায়াবেটিস ছিল ৩%, বর্তমানে তা ৮%; আফ্রিকায় ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিস ছিল ৩.১%, বর্তমানে তা ১৫%; ইউরোপে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিস ছিল ৫.৩%, বর্তমানে তা ৯.৯৫%। সৌদি আরবে ১৯৮২ সালে ডায়াবেটিস ছিল ২.৪%, বর্তমানে তা ২৪%; বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিস ছিল ৪%, বর্তমানে তা ৮.৪%। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এর তথ্য মতে ২০১৫ সালে বিশে^ প্রায় ৪১৫ মিলিয়ন রোগীর পেছনে ব্যয় হয় ৬৬৫ বিলিয়ন ডলার যা তৃতীয় বিশে^র সকল দেশের সম্মিলিত বাৎসরিক বাজেটের চেয়ে বেশি। কারও কারও ধারণা ডায়াবেটিস ধনীদের রোগ, শহরের পেটমোটা ও মোটাসোটা বড় সাহেবদের রোগ। কেউ কেউ মনে করেন শিশুদের, অল্প বয়স্ক বালক-বালিকাদের, দরিদ্র ও পাতলা মানুষদের ডায়াবেটিস হয় না। অথচ শিশু, বালক-বালিকা, যুবক যুবতী, মধ্যবয়সী, বয়স্ক-বয়স্কা, মোটা, পাতলা, ধনী, দরিদ্র সকলেরই ডায়াবেটিস হতে পারে। কেহই এই রোগ থেকে ইনডেমনিটি প্রাপ্ত নয়। আধুনিকতার সুফলের শেষ নেই। আধুনিকতার কুফলও কম নয়। যেমন আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘরে ঘরে ডায়বেটিস বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আজীবনের রোগ, শারীরিক পরিশ্রমবিহীন জীবনযাপনের কারণে তা হচ্ছে। গ্রামীণ জনপদে প্রাতঃকালীন ও বৈকালিক হাঁটাহাঁটির সংস্কৃতি তেমন গড়ে ওঠেনি, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য তো নয়ই। গ্রামীণ জনপদে হাঁটাহাঁটির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বোধ জাগ্রত করতে হবে। সৌদি আরবে মহিলারা একাকী বিদেশ ভ্রমণ করছেন, সামরিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন, ড্রাইভিং করছেন, এমনকি বোরখা পরিধান এখন আর বাধ্যতামূলক নয়। তাহলে বাংলাদেশে গ্রামীণ মেয়েদের প্রাতঃকালীন ও বৈকালিক হাঁটাহাঁটিতে বাধা কোথায়? অতীতে সাধারণত ঈদের সময়, বিয়েসাদি বা মেজবানের সময় পশু জবাই করা হতো। এখন ৩৬৫ দিনই গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয়। পশুর চর্বি শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়। শরীরের ওজন বৃদ্ধির ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। তার উপর ধূমপান, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৪৫% বাড়িয়ে দেয়। চীনে ১৯৯১-২০০৬ সময়কালে শারীরিক পরিশ্রমের হার ৩২% কমে যায়। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার চিত্রও একই। আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে ফাস্ট ফুড (ডায়া-বেটো-জেনিক) খাওয়ার মহোৎসব চলছে। আমেরিকার সামোয়াতে স্থূলতার হার ৯৫% ও ডায়াবেটিসের হার ৪৭.৩০% যা বিশে^র সর্বোচ্চ, সেখানে সব সময় আমেরিকানাইজড জাংফুড (ফাস্ট ফুড) খাওয়ার মহোৎসব চলে । আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ বেনিনে ডায়াবেটিসের হার মাত্র ১.৫% যা বিশে^র সর্বনি¤œ । বেনিনের মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র এবং বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত। সেখানে ফাস্ট ফুডের সঙ্গে মানুষ পরিচিত নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত ও অসচেতন রোগীদের মধ্যে অনেকের ডায়াবেটিস অজানা থেকে যায়। অজানা থাকলেও ডায়াবেটিসের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তো থেমে থাকে না। বরং ভেতরে ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এ জন্যই ডায়াবেটিসকে নিরব ঘাতক বলা হয় । অথচ একটু সচেতন হলেই এহেন ভয়াবহ পরিনতি এড়ানো যায়। প্রতি তিন মাস পরপর রক্তের সুগার টেস্ট করালে ডায়াবেটিস (যদি থাকে) ধরা পড়বে। প্রাণহীন যানবাহনকে সবাই নিয়মিত ওয়ার্কশপে নিয়ে চেক করায়, অথচ অমূল্য দেহটাকে চেকআপের সময় সামনে আবির্ভূত হয় অলসতা, সময় সঙ্কট, নানা কাজের অজুহাত, টাকার অভাব ইত্যাদি। অথচ শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ধূমপান করে অনেকেই প্রচুর টাকা ব্যয় করেন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সার্ভে অনুযায়ী ৬৪টি জেলায় ২৫.৬০% অজানা ডায়াবেটিস রোগী আবিষ্কৃত হয়েছে। দেশে ৫২টি জেলায় গর্ভবতী মহিলাদের রক্ত পরীক্ষা করে ২৬.৪০% গর্ভকালীন অজানা ডায়াবেটিস শনাক্ত করা হয়েছে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস শনাক্তকরণও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থেকে শিশুর শরীরে ডায়াবেটিসের ভিত্তি রচিত হয় এবং মায়েরাও পরবর্তীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। হাঁটহাঁটি আর জগিং ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র। জিম্বাবুইয়ের রাজধানী হারারেতে অফিস ফেরত মানুষ দলবেঁধে জগিং করে বাসায় ফিরে। আগে যানবাহনে করে বাসায় ফিরত আর এখন জগিং করে বাসায় ফিরে। স্বাস্থ্যের প্রয়োজন মিটানোর স্বার্থে সময়ের কৌশলগত ও শৈল্পিক ব্যবহারের এক চমৎকার উদাহরণ সেখানে। এক সময় ঢাকাসহ অন্যান্য শহরেও হয়ত অফিস ফেরত মানুষ জগিং করে বা হেঁটে বাসায় ফিরবে। রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট বা ময়দার পরিবর্তে স্বাস্থ্যা সম্মত ছালসহ লাল আটা গ্রহণ করবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মিক্সড শাকসবজি গ্রহণ করবে, কালে ভদ্রে পশুর মাংস চলবে। মিষ্টির পরিবর্তে মিলাদে গাজর বিতরণ করবে। হয়ত একদিন মানুষ ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা ঠেকাতে ফাস্ট ফুড ও ধূমপান প্রতিরোধ করতে দলবেঁধে রাস্তায় শান্তিপূর্ণ অভিযানে নেমে পড়বে। লেখক : সাবেক পরিচালক প্রশাসন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়
×