ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে মাছ চাষে নীল বিপ্লব

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ২৮ অক্টোবর ২০১৯

 বাংলাদেশে মাছ চাষে নীল বিপ্লব

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বাংলাদেশে পুকুরে মাছ চাষে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গত ১৫ বছরে পুকুরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণেরও বেশি। এ সময়ে দেশে মোট মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুরে মাছ চাষের পরিমাণ ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি চাষকৃত মাছের দামও দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে। গত ১৫ বছরে চাষকৃত মাছের দাম কমেছে ১২ শতাংশ। ফলে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই মাছ খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। এই মাছ খাওয়ার পরিমাণ মাথাপিছু ১৩.৪ কেজি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.১ কেজিতে। পুকুরে মাছ চাষ বৃদ্ধির কারণে তা সরাসরি কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ১০ বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই মাছ চাষে। এতে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার বাইরে চলে এসেছে। আর দেশে এই চাষকৃত মাছের বাজার বেড়েছে ২৫ গুণ। যার ৯০ শতাংশেরই ভোক্তা দেশের মানুষ। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ (ইফপ্রি) এর নতুন গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই গবেষণা প্রতিবেদনটি রবিবার আনুষ্ঠানিকভবে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের এই মৎস্য বিপ্লবকে ‘ব্লু রেভ্যুলুশন’ বা নীল বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, মূলত নতুন প্রযুক্তি ও উন্নত অবকাঠামো ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে মাছ চাষে এই বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে টানা কয়েক বছর ধরে অর্জিত টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই অভ্যন্তরীণ মৎস্য বিপ্লবে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে মাছের চাহিদা বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে মাছ পরিবহনের খরচও অনেক কমে গেছে। ফলে মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে মৎস্যজীবীরা। যা মাছের অভ্যন্তরীণ বাজার বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। মাছ চাষ বৃদ্ধির কারণে এর সঙ্গে জড়িত উপকরণ ব্যবসারও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে হ্যাচারি, ফিড মিলস, ফিড ডিলার ও মাছ ব্যবসায়ীর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই সময়ে মাছচাষীর সংখ্যা ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর পুকুরে চাষকৃত মাছের উৎপাদন ৫ লাখ টন থেকে ৩ গুণেরও বেশি বেড়ে ১৭ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। মূলত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পুকুরে মাছ চাষের কারণেই চাষকৃত মাছের উৎপাদনে এই বিপ্লব সাধিত হয়েছে। যা মাছ চাষকে লাভজনক করেছে। গত ১৫ বছরে মাছ চাষের এই অগ্রগতি সত্ত্বেও হেক্টর প্রতি মাছের উৎপাদন আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে মাছের উৎপাদন ৬০-৭০ টন। আর ভিয়েতনামে প্রতি হেক্টরে মাছের উৎপাদন ৩০০ টন। ফলে বাংলাদেশে চাষকৃত মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্ধেক পুকুরে যদি মাছের উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ১০০ টনেও উন্নীত করা যায়, তাহলেও দেশে মাছের উৎপাদন ১২ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশে নীল বিপ্লবের কারণে মানুষের আয় ও খাদ্যাভাসে উন্নতি ঘটেছে। এখন সময় এসেছে মৎস্য খাতে বিনিয়োগের। মৎস্য খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ মাছের উৎপাদন ১২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে এ সময়ে মাছের দাম খুব একটা আর কমবে না। এই মূল্য বড়জোর ১ শতাংশ কমতে পারে। প্রতিবেদনে তিন সমস্যার কথা উল্লেখ করে তা সমাধানের জন্য নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এগুলো হলো, মাছের খাদ্য সংক্রান্ত। মাছের খাবারের উচ্চমূল্য, যথাসময়ে খাদ্য না পাওয়া এবং মাছের খাবারের নিম্নমান। রবিবার বিকেলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এই ‘দ্য মেকিং অব এ ব্লু রেভ্যুলুশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান। সম্মানিত অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিদ্যুত বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. কেএএস মুর্শিদ। এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন বইয়ের দুই লেখক চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির প্রফেসর ড. জিয়াওবো জাং এবং ইফপ্রির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. সহিদুর রশিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রইসুল ইসলাম মন্ডল। পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান বলেন, আমাদের কৃষক খাদ্যশস্য, মাছ ও সবজি চাষে বিপ্লব সাধন করেছেন। অভ্যন্তরীণ মাছ চাষে এই নীল বিপ্লব আমাদের পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মাছের এত উৎপাদন বাড়লেও আমরা এখন মাছের উৎপাদনশীলতায় পিছিয়ে আছি। আমরা যেখানে হেক্টরে ৭০ টন মাছ উৎপাদন করতে পারি, ভিয়েতনাম সেখানে ৩০০ টন উৎপাদন করছে। এক্ষেত্রে আমাদের মাছের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রতি জোর দিতে হবে। আমরা এখন ড্রাইভিং সিটে আছি। আশা করছি, মাছ চাষে আমরা আরও পরিবর্তন আনতে পারব। তিনি বলেন, সমুদ্র সম্পদ কিভাবে আমাদের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। এ সময় ভিয়েতনামের উদাহারণ টেনে বলেন, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই এ খাতে দ্রুত অবদান রাখবে। সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, অর্থনীতির ইতিবাচক পরিবর্তনের মূলে রয়েছে জলজ সম্পদের অবদান। গ্রন্থটি নিয়ে মন্তব্যকালে ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, উন্নয়নের মূলে রয়েছে কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম। কৃষকদের নিজস্ব উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা এবং সরকারের সহযোগিতা- এই নীল বিপ্লবে অনন্য অবদান রেখেছে।
×