ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মায়া

প্রকাশিত: ১৩:০৯, ১১ অক্টোবর ২০১৯

মায়া

দেবীর বিদায়ের ক্ষণ চলে আসে। লক্ষ্মীর হাতে মায়ের নৈবেদ্য। ফুল-ফল-মিষ্টি, সিঁদুর, ধান-দূর্বা দিয়ে সাজানো। দেবী দুর্গা সুন্দর পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। গাছের পাতারা নুইয়ে পড়েছে। পাখিদের কণ্ঠে কান্নার সুর। তারা এ ডাল থেকে ও ডালে যাচ্ছে। লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে অন্যদের মাঝে। ক্লিক, ক্লিক! দীপঙ্করের গলায় ক্যামেরা। আলোর ঝলকানিতে চারপাশ জ্বলে উঠছে। এ এক জ্বালা। পূজা অঙ্গনের প্রায় অন্ধকারকে আলোয় টানা নয়। দুঃখের মধ্যে ঘৃতাহুতি দেয়ার মতো। ভারাক্রান্ত মন লক্ষ্মীর। তরুণী মনে করে, সেই আগেও অন্যরকম পথে চলেছে তার কিশোরী মন। কিন্তু এমনটিতো হয়নি ! তার পা শির শির করে। জীবনে পূজা বাদ যায়নি। ঢাক কুড় কুড় শুরু হতো ঘুম ভাঙার আগে। আর ঘুম ভেঙে মুখ না ধুয়েই দে ছুট পূজাম-পে। কত চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। খুড়িমা কেমন আছে? আঁচলে ঘাম মুছে মাসিমা লক্ষ্মীর পাশে এসে বসে। তারপর হাতে আসে খই, নাড়ু। না তেমন ভাল কই! এখন একটু হাঁটতে পারে। লক্ষ্মী বেতের ডালাটি পাশে রাখে। খাও। ওই সেরে যাবে, বয়স হয়েছো তো! তা হোক মাসিমা ! কিন্তু... বৃদ্ধ বয়সে গুরুজনরাও শিশু হয়ে যায়। মাসিমা ওর মুখের কথা কেড়ে নেয়। টেনে টেনে বলে, গুরুজনদের সেবা করলে আশীর্বাদ পাওয়া যায়। মহিলা চটের ভাঁজ খোলে। ধামায় গোলার ধান এনে ঢেলে দেয় । এই বন্ধে দীপঙ্কর আসছে বাড়িতে। তোমার কথা লিখেছে সেদিন। আমার কথা! কিছুটা বিস্ময় আর কিছুটা আনন্দের ঝিলিক লক্ষ্মীর চোখে। এবার সবাইকে নিয়ে পূজা দেখবে! মুকসুদপুর নারায়ণপুর ঘুরবে। ভাঙ্গা হয়ে ফরিদপুর ... কতকি ভাবনা ওর! কী নিচ্ছো না যে- নাড়ু মোয়ার ডালাটি তার হাতে উঠিয়ে দেয় মাসিমা । একেবারে ময়রা পাড়ার কোলের মধ্যে ছিল দীপঙ্করের বাড়ি। ওইদিন সকালও নয় আবার দুপুরও হয়ে উঠেনি, মিষ্টি নিতে আসে লক্ষ্মী। মা এ জন্য বরাবর ওকেই পাঠায়। মাসিমা তাকে দেখেই উৎফুল হয়ে ওঠে। এসো এসো মা! এগিযে আসে লক্ষ্মী। সে বারান্দায় ওঠে। বসো বসো। খোলা বারান্দায় সারি সারি কয়েকটা চৌকি। লক্ষ্মী ওখানেই বসে পড়ে। ক্ষান্ত বর্ষণ। তারই ফাঁকে আসা। কাকা ডাকা সেই লাজুক রোদ্দুর। মা হাতে তুলে দেয় টাকা। ও আর তাকায়নি। জাম আর দেবদারুর পাতার চিকচিক রং দেখতে দেখতে চলে আসে ময়রা বাড়ি। সেখান থেকে নিজের চাওয়া জানিয়েই এখানে। আমি এক ফাঁকে তোমাদের ওখানে আসব। টানা বারান্দায় বিছানো ধান। মাসিমা ধামায় ভরে সেসব এক পাশ থেকে আরেক পাশে নেয়। ঠিক ঠাক করে গোলায় ওঠাতে হবে। কথা বলে তারই ফাঁকে। বেলা কম হয় না। গল্প গড়ায় ধানের সমান। উঠি তাহলে মাসিমা ! মাসিমাও কয়েক পা এগিয়ে যায়। দৌড় দেয় লক্ষ্মী। সময় কম হলো না। লেখা পড়া শেষ হতে না হতে বিয়ে। প্রথম দিকে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। তারপর আটসাট করে সংসার সাজানো। সবার জন্যই যা হয়। ভালবাসার সারসংক্ষেপ যে দুই কন্যা তারা আজ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এই বয়সে মুকসুদপুরের ঊষা, গৌরীরা অনেকখানি ঢলে পড়েছে। বয়স নয় কেবল, চিন্তায়ও। কিন্তু লক্ষ্মী— সে হাঁটে শিউলিতলায়, ফুল তোলে আগের মতোই। আলোর ঝলকানি তাকে ওই মুখো করে। নিজে বুঝি বন্দী হয় সময়ের ক্যামেরায়। ক্লিক ক্লিক! জ্বলে ওঠে নিস্তব্ধ সময়। ছবি শিকার করে দীপঙ্কর এক পাশে গিয়ে বসে। দেবীর বিদায়ী লগ্ন কাছাকাছি চলে আসে। নৈবেদ্য হাতে সারিবদ্ধ মহিলারা। তাদের মতো লক্ষ্মীও এগোয় পা পা করে। সেই মুখ, সেই চেহারা। এখনও বয়সে কাটেনি তার দাঁত। কিংবা জোছনার ফাঁকে দেখা কচুরির ধাপের মতো চুলগুলোও কমেনি তেমনটি। পিনপতন নীরবতা। এরই মধ্যে সে আটকা পড়ে মাটির কোনো গাঁয়। একই কোন বিচ্ছিন্নতা, নাকি তার মনের ঘুরপাক। মায়ের পায়ে ঢেলে দেবে ভক্তির অর্ঘ্য। কপালে সিঁদুর পরিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসবে আরো কিছুদূর। লক্ষ্মী ভাবে, যাওয়ার মুহূর্ত যা তাকে ভারি করে তুলেছে তার সঙ্গে কি যুক্ত হলো আরও কোন প্রস্তর! পা চলে না, হাঁটে না এখানকার মানুষগুলো। কত কথা... বিজলির মতো চমকে আসে সেসব মুহূর্ত। লক্ষ্মী দীপঙ্করের সঙ্গে গান গাইতে চেয়েছিল। বাংলার পথ ঘাট মাঠ প্রান্তরে বাধা ছিল সে সুর। ইচ্ছে ছিল অন্তর্লোকে পৌঁছে যাওয়ার। দ্রোহে, প্রেমে টেনে নেয়ার আকাক্সক্ষা ছিল প্রগাঢ়। ভালবাসার বসতিতে নিজেকে সমর্পণ করার ষোলোআনা বাসনা নিয়ে সে ছুটেছে। পায়নি, তবে কোন আক্ষেপ করেনি। নিজের অজান্তে দু’একবার ঋতুর বাটখারায় মাপতে চেয়েছে তার ক্ষরণ। কিন্তু এগোয়নি। নীরব কিছু ভালবাসা কিংবা শুদ্ধ সতেজ প্রেমে সিক্ত হয়েছে। বলা যায়, পিপাসা মেটেনি। কী আর করবে! অন্তরে যার প্রেমের চাওয়া তার আর জোড়াতালিতে কাজ হবার নয়। রিপু করা জীবন ছিঁড়ে যায় বুঝি! তরুণী ভাবে, ওকি দীপঙ্কর, নাকি অন্য কেউ? নাকি তারই পক্ষে ঘূর্ণিপাকে ফেলানোর জন্য কোন মায়া? লক্ষ্মী হাঁপিয়ে ওঠে। এ তার কলেজ জীবনের কথা। মেঘ-বৃষ্টি পেছনে ঠেলে ক্যাফেটেরিয়ায় প্রবেশ করে। ভেতরে অনর্গল কলকাকলি। গুঞ্জরণ গর্জন। কারও খিলখিল হাসি। এ জায়গাটি পৃথিবীর হয়েও যেন অন্য কোন গ্রহের। এখানকার মানুষগুলো এখনই কবি হয়ে উঠলো তা নয়, এরা তো কবিই। এ এক কবিতার রাজ্য। এখানে মন কেমনের উৎসব রোজই। গা করেনি। কিন্তু আজ! সেটা বেশি বেশিই টের পাচ্ছে লক্ষ্মী। দীপঙ্কর সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত কি? হয়তোবা হ্যাঁ, হয়ত বা না। তবে সাংবাদিকের মর্যাদায় আঘাত এলে জোর প্রতিবাদ ওর। কিন্তু নিজের জন্য এতটা হিসেবি নয়। কোথাও মঞ্চে বসানোর জন্য আহ্বান করলেও বিনয়ের সঙ্গে এড়িয়ে যায়।এখানে সবাই যখন আসনে বসতে খুন-পণ তখন সে কেন মঞ্চ ভাঙার দায় নেবে! কিংবা নষ্টদের মহিমা দেবে! না এমন কথা তার মুখে শোনেনি কেউ, বলে তার বন্ধুরা। ছবি তোলা হয়ে পড়ে তার সংগ্রহ। কিংবা সময়মতো সামাজিক মাধ্যমে তুলে দেয়া। সাংবাদিক, ফটো সাংবাদিক, চিত্র গ্রাহক, কোনটা সে? নাকি ফেসবুকার! এ সবের হয়ত কোনটাই নয়। সব ছাপিয়ে সে লেখক। আবুধাবি আল আইন ঘুরে সে তার ভ্রমণ তুলে ধরে। আহা সে কি নিবেদন! লেখক লেখকভাব তো তার আগে থেকেই। লেখকরা কি পিছু হটে, আত্মসমর্পণ করে? দীপঙ্কর আপস করেনি। কিন্তু অন্যরা! বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর হতাশায় পড়ে সংখ্যালঘুরা। সে যাত্রায় মানিয়ে নিলেও বাবরি মসজিদের ঘটনার জের সব কিছু ওলট-পালট করে দেয়। লক্ষ্মীর বাবা সহায় সম্পদ বিক্রি করে চলে আসে বনগাঁ। এক বনগাঁ ছেড়ে আরেক বনগাঁ। কিন্তু দীপঙ্কররা ঠিকানা বিহীন! অতিরিক্ত বলে ফেলল নাকি! ভাবে তরুণী। নিজ পরিবারের ওপর লক্ষ্মীর প্রচ- অভিমান। তার চোখ দুটো ছলছল করে। লক্ষ্মীকে দাহ করে তার চেয়েও বেশি ওই দীপঙ্কর। ওরা কেন থেকে গেল দেশে ! আরে বাবা আজ না হোক দুদিন পরত দেশ ছাড়তেই হবে। তবে এখন নয় কেন! ওর দম নিতে কষ্ট হয়। লক্ষ্মী যখন বঙ্গবাসী কলেজে পড়ে, তন্য তন্য করে খুঁজেছে ওকে। কবিতার আড্ডা গানের ভুবন কোথাও পায়নি। আচ্ছা ওকি কবিতা লেখে কিংবা গান গায়, যে চর্চাগুলো তার চোখের সামনে ভাসে। এমন কবিতা তো সবাই লেখে একটা সময়। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যবহার করেন ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ শব্দ কয়টি। সেটা কাজে লাগালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপর এই আমরা কিংবা আমাদের সন্তানেরা। এইভাবে চলবে বংশানুক্রমে। অন্যদিকে গান, তাও ছোটবেলায় সবাই একটু শেখে। এইসব যুক্তি এক সময়ে আবার ধপাস করে বসে পড়ে। লক্ষ্মীর ভুবন বদলে যায়। পাখিরা তার বন্ধু। একান্তই কাছের মানুষ। কবিতায় তারা এলে জানালায় আসে অচিন পাখি। অচেনা রঙে ভরে যায় শহর। আকাশের হৃদে মেঘ জমলে প্রচ- বিদ্যুত চমকায়। বৃষ্টি হয়, লক্ষ্মীর মন ভাল হয়ে যায়। সে নীল রঙা শাড়ি পরে। বন্ধুরা তাকে বলে সে নাকি রবীন্দ্র জগতের বাসিন্দা। ঘুঙুর পরা ময়ূরও জেনে গেছে তার গোপনতা। দুইপা এগোয় লক্ষ্মী। বারে, সে কী ভাবছে এখন? আমি কি সেই আগের মতোই আছি! নাকি অনেকখানি বদলে গেছি। যা বাবা। আমাকে কি দীপঙ্কর শাড়ি পরতে দেখেছে। পূজা হয়ত করত, সে মা যখন অসুস্থ কিংবা ব্যস্ত থাকত অন্য কাজে। তাড়াতাড়ি আমেশ্বর ছিঁড়ে আনত। দৌড়ে নদীর জলে ধুয়ে দেবীর ঘটে বসাত। ধূপদীপ জ্বালিয়ে ঘরের লক্ষ্মী, দেবী লক্ষ্মীর পূজা দিত। তার মধ্যে কী ভাবান্তর এসেছিল মনে নেই। তরুণী আজও কোন দিশা পায় না। ক্লিক ক্লিক ছবিতে ভরে যায় ইমেজ বক্স। আবার সেই জায়গা, সেই মানস। ক্লান্ত মানুষ সারাদিন খেটে বাড়ি ফেরার পথে কুমারের হাঁটু জলে শরীর ভিজিয়ে নেয়। শুদ্ধ হয়ে প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। সূর্যটাও ডুবে যেতে যেতে নানা কথা বলে যায় তীর তীর করে বয়ে যাওয়া জল ছুঁয়ে। ‘আমাদের ছোট নদী’... এ কি কোপাই না কি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর ঘেঁষা কুমার নদী। আদুরে আলোয় ডাগর বনগাঁ দাঁড়িয়ে থাকে তার সব রূপ গায়ে মেখে। লক্ষ্মী, সে ডাগর মেয়ে লক্ষ্মীই তো। তরুণী ফিরে যায় গাঙ পারে বট তলায়। হাতের ফুলদানির হাত বুলিয়ে ঠিক করে নেয় উপাচার। অনুভবে মনকে নাড়া দেয় প্রিয় কথা। মহাসপ্তমী পূজাতে কলাবউ তৈরির সময়টাতে দেবীর রূপ নিয়ে লক্ষ্মী এবারই ভাবল। একটা সপত্র কলাগাছের সঙ্গে আরও আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে নবপত্রিকা বানানো। এ কৌশল আপ্ত করল গভীর মনোযোগে। লালপাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা দিয়ে দুর্গাকে নয় যেন নিজেকে সাজাল। এমন চিন্তা মাথায় ভর করেনি তখন। কুমারী পূজাতেও সাজানোয় ভূমিকা রাখে লক্ষ্মী। দেবী জ্ঞানে পূজা করার রীতি আছে। ষোলো বছরের কম বয়সী কোন কুমারী বালিকাকে। কুমারীকে সাজানো হয় ফুলের গহনা ও নানাবিধ অলঙ্কারে। পায়ে আলতা, কপালে সিঁদুর তিলক, হাতে ফুলের বাজুবন্ধ দিয়ে যুতসই সজ্জ্বা। আসনে বসিয়ে পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য আর পূজার নানাবিধ উপাচার। লক্ষ্মী নিজেকে ভাবে স্বর্গের কুমারী। তখন কিছু মনে হয়নি তার। আসেনি দীপঙ্কর তার আঙ্গিনায়। কেন এমন হচ্ছে এখন? কিছু কি হারিয়েছে লক্ষ্মী ! হারিয়েছে ঠিক, তবে সেটা কি এতই অপূরণীয়? কী এক প্রশ্ন নতুন করে আগলে ধরে তাকে। কী এমন ক্ষতি হতো যদি সে আসত সীমান্ত পেরিয়ে! কোন কি বাধা ছিল তার! ছিলোই তো, তবে তা তার লেখনী। লেখকরা অপরাজেয়। পরাজয়ে ডরে না বীর। চিরজয়ীর আরেক নাম লেখক। পরক্ষণে কে যেন বলে ওঠে পাশ থেকে। দেশান্তরি তো হয়েছেই। আবুধাবি কোন্ দুঃখে, তা কি দেশে পাকাপোক্ত কিছু করা সম্ভব হয়নি বলে! সেই জায়গায় লক্ষ্মীও এর চেয়ে বেশি কোন বিশ্লেষণ আনতে পারে না। তরুণী জানে, তুমুল খরা এখন। জলে আর কাজলে। উপচে ওঠা জোয়ারে রোজ পাড় ভাঙার শব্দ। ঝুপঝাপ ঝুপঝাপ কখনও বা একবারে মটমট শব্দে নুইয়ে পড়ে পাড়। চোখ ভিজে আসে তার। না সে তো এ নিয়ে কখনও কোন বাড়াবাড়ি করেনি। নাকি এখন এটি তার অতিরিক্ত সংযোজন! দীপঙ্কর কি মনে করে, লক্ষ্মী নামের মেয়েটি তারই কথা ভাবে এ বিরলে! এখনও কি সকাল হলে স্নানটি সেরে পূজার ফুল তুলে পূজার ছলে বসে। যুবকের কথা মনে করে হারিয়ে যায় একান্ত ভুবনে। তরুণী কেন আঁকবে পথের ছবি! সে অধ্যায় অনেক আগেই শেষ। বৃষ্টি নামে, কেউ একজন বলে, ও মেয়ে পথগুলো ভাঁজ করে রেখে দাও আলাদা নামে। লক্ষ্মী তাই করে । দীপঙ্করের কি এমনটি হয়েছে কখনও! সে তাল পায় না। তরুণী দেবীর সামনে যায়। পাদপদ্মে হাজির করে নৈবেদ্য। সিঁদুর এঁকে দেয় মায়ের কপালে। ধূপ দীপ জ্বলে। ধান দূর্বা দিয়ে মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। নিজেই দেখে নিজেকে, ছোট সেদিনের সেই মানুষটা আজ যে শুধু বড় হয়েছে তাই নয়। পথও গেছে দূর বহু দূরে। দুইজন পাশে দাঁড়ায়। দীপঙ্কর —তারও দুই কন্যা, স্ত্রী। কী কথা তার মনে, তার সনে! কেউ সংজ্ঞা দিতে পারে না। ভেতরে বাজে পুরনো সেতার। লক্ষ্মীর বাবা দেরি করেছিল। সেটা তার ঠাকুরমার কারণে হলেও। একটু নয় যথাসম্ভব সুস্থ করেই বৃদ্ধা মাকে বনগাঁ নিয়ে আসে ওর বাবা। কিন্তু ওরা তো এলো না। আজ পর্যন্ত না। দীপঙ্কর রয়ে গেল তার জায়গায়।... এবার লক্ষ্মী পা বাড়ায় সামনে। দীপঙ্করও তার পথে। লক্ষ্মী কৈশোর পান করে দুহাতে। মুকসুদপুর, সেই কুমার, সেই জঙ্গল তারই মধ্য দিয়ে যায় মহারাজপুর, ঘুরে আসে চাঁদহাট । ভাবে, ফেলে ছড়ানো সেই নির্বিষ আনন্দের উপলব্ধিতে কেন এত মিশ্রণ! অনিবার্য তার স্বামী কন্যা। মনে মনে কত ছোট বড় পথে- হেঁটে পূজা দেখে। কান্নায় ভেসে যায় দুচোখ। বিগলিত কণ্ঠ লক্ষ্মীর। দাঁড়ায় মায়ের সামনে। দুহাত জড়ো করে বলে, মহামায়া, আমায় সবই তো দিয়েছো মা। মায়ার বন্ধনেই আছি। তবে এত মায়া কেন দিচ্ছো অন্তরে!
×