ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অপারেশন ভুয়াপুর থানা ॥ ৭ অক্টোবর, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ৭ অক্টোবর ২০১৯

অপারেশন ভুয়াপুর থানা ॥ ৭ অক্টোবর, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। মুক্তিফৌজের গেরিলারা ছাগলনাইয়া বিলোনিয়া সড়কের একটি সেতু উড়িয়ে দেয় যাতে পাকসেনারা বিলোনিয়াতে অবরুদ্ধ হয়ে যায়। সেতুটি হাল্কা অস্ত্র, এলএমজি ও মেশিনগান সমৃদ্ধ পাকসেনারা পাহারায় রেখেছিল। প্রচন্ড গোলাগুলির পর গেরিলারা সফল হয়। ওইদিন গেরিলারা রাধানগর তহসিল অফিস গুঁড়িয়ে দেয় এবং মকামিয়াতে পাকসেনাদের আক্রমণ করে। ২ জন পাকসেনা সেখানে নিহত হয়। কাদেরিয়া বাহিনী ভুয়াপুর থানায় অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা ভুয়াপুর থানা পাকসেনা মুক্ত করে। এতে ৭০-৮০ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। যুদ্ধে ২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখলের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকসেনা ঘাঁটি বড়দাসুয়া, চাঁদলা, কায়েমপুর এবং গোবিন্দপুর আক্রমণ করে। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর নায়েব সুবেদার সিরাজ, সুবেদার মঙ্গল মিয়া এবং সুবেদার বেলায়েত স্ব-স্ব প্লাটুন নিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিক সামনে রেখে পূর্ব দিকে অবস্থান নেন। রাজশাহীর মাগুরাপাড়ায় মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের বিরুদ্ধে এক সফল অভিযান চালায়। এই অভিযানে ৩ জন পাকসৈন্য ও ৪ জন পাকপুলিশ নিহত হয়। দিনাজপুর ও লালমনিরহাটের মোগলহাটে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। মেজর আফছার একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রাত ৮-৪৫ মিনিটে ময়মনসিংহের ভালুকায় হানাদারদের মল্লিকবাড়ী ঘাঁটি আক্রমণ করেন। ২ ঘণ্টাকাল গুলি বিনিময়ের পর ১৯ জন পাকসেনা ও ১৪ জন রাজাকার নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিফৌজের নৌকমান্ডোরা ১৫ আগস্টের পর প্রথম অপারেশন করেছিল ২৩ সেপ্টেম্বর। এই দিন নৌকমান্ডো ফারুক-ই-আজম গ্রুপ দ্বিতীয় অপারেশনের প্রস্তুতি নেয়। ‘মানা’ নামক তেলবাহী জাহাজকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মাত্র দুইজন কমান্ডো রাত ৯.৩০ মিনিটে গুপ্তখালীর বার্মা ইস্টার্নের বাংলো ও তেল ডিপোর মধ্যবর্তী খালের ভেতর দিয়ে এসে কর্ণফুলী নদীতে নেমে পড়ে। ভাটার কারণে ‘নামা’ নামক তেলবাহী জাহাজ ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। তাই গ্রিক তেলবাহী জাহাজ ‘এবলস’-এর গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে ক্ষতি সাধন করে। ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে। কর্ণফুলী নদীর পানিতে তেলের ভাসমান দৃশ্য দেখা গেছে বহু দূর থেকে। ডাঃ এএম মালিক তার মন্ত্রী সভায় আরও তিনজন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত করেন। নতুন মন্ত্রীরা হচ্ছেন- পিডিপির একে মোশারফ হোসেন, জসিম উদ্দিন আহমদ ও কাইয়ূম, মুসলিম লীগের মুজিবুর রহমান এ্যাডভোকেট। বিশ্বব্যাংকের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি শিগোমটস্থ কারিয়ামা খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী নওয়াজেশ আহমদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। লে. জেনারেল নিয়াজী সৈয়দপুরের নবনির্মিত বিমান ঘাঁটির উদ্বোধন করেন। দালাল ও সেনাবাহিনীর একতাবদ্ধতার নিদর্শন হিসেবে বিমান ঘাঁটিটি সম্মিলিতভাবে তৈরি করা হয়। বিমান ঘাঁটি উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে নিয়াজী বলেন, ‘যারা ভাষাভিত্তিক প্রশ্ন তুলে আমাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করতে চায় তারা পাকিস্তানের শত্রু। আমরা ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জাতি হিসেবে টিকে থাকব এবং শত্রুর দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দেব। সিরিয়ার প্রতিনিধি জাতিসংঘে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘সিরিয়া পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখতে আগ্রহী।’ লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মরহুম এইচএস সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং আশা করেন যে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে পূর্ণ বিজয় ছিনিয়ে আনতে সফল হবে। ‘যখনই আমি পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা কমিটির ব্যাপারে জানতে পারি তখন বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আমার সহমর্মিতা ও সম্পূর্ণ সমর্থনছিল। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকার কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজের বিবৃতির প্রয়োজন বোধ করিনি, কিন্তু যেহেতু এটি স্পষ্ট যে, আমার শ্রদ্ধেয় পিতা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মৃতি আমার পরিবারের একজন সদস্য তাঁর বিবৃতির মাধ্যমে অলঙ্কৃৃত করতে চাইছেন, সেহেতু আমার এ ব্যাপারে মুখ খোলা কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। আমি দৃঢ়কণ্ঠে নির্দ্বিধায় বলতে চাই যে, আমি বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাত্মক সফলতা কামনা করি। বিগত ২৪ বছর যাবত তারা পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত ও রাজনৈতিকভাবে অবদমিত হয়ে আসছে এবং এখন তারা পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত গণহত্যা ও অন্যান্য ঘৃণ্য অনাচারের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে সফল হবে। নিকট ভবিষ্যতে আমি একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে যেতে চাই, যেখানে সকল বিশ্বাস ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার মানুষ সুখ-সমৃদ্ধিতে বাস করবে। এ ছাড়াও আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সম্ভাষণ জানাই, যার সদস্যরা আমার পিতার সহকর্মী এবং অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম নয়াদিল্লীতে বলেন, আমরা বাংলাদেশ প্রশ্নের একটি রাজনৈতিক সমাধান বলতে একমাত্র ‘স্বাধীনতা’ বুঝি। আমরা বিশ্বাস করি, বাঙালীরা একদিন স্বাধীনতা লাভ করবে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাবে। কেননা, তারা ন্যায় ও সত্যের জন্য লড়াই করছেন। দৈনিক স্টেটসম্যান-এর সংবাদে বলা হয়, জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়। বাংলাদেশের সমস্যা শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়-এই কথায় ভারত সকল দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। সেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সমস্যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে।’ তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা এর ভেতরে আসতে চাই না।’ ‘আমরা এটার ভেতরে ঢুকতে পারি না এবং আমাদের আসা উচিত নয়। যারা মনে করে যে, এক্ষেত্রে ভারতীয় সহযোগিতার প্রয়োজন তাদের উপলব্ধি করা উচিত যে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সহযোগিতা সবসময় স্বাগত জানানো হয়। পাকিস্তান যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে মানবাধিকার বিলুপ্তির পথে সেই কাজে ভারত অংশীদার হতে পারেনা। পাকিস্তান কাশ্মীর সম্পর্কে এবং সেখানকার নৃশংসতার ব্যাপারে কখনও কথা বলতে আসেনি। পাক প্রতিনিধি আলি সংবাদ সম্মেলনে এবং পরে সাধারণ পরিষদে বলেন, যে ভারত ২৯ সেপ্টেম্বর আগরতলার সীমান্তজুড়ে ১০০০ শেল নিক্ষেপ করেছে। নয়া দিল্লীর একটি টেলিগ্রাম তিনি পাঠ করেন, যাতে বলা আছে শেলিং আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ভারতীয় ভূখ-ের ওপরে করেছে এবং গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিপুল মানুষ হত্যা করছে। টেলিগ্রামে উল্লেখিত ৪০০টি অভিযোগ করেছিল ভারত। সেন বলেন- আলীর অভিযোগে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তান আগ্রাসী প্রয়াস চালাচ্ছে। তার বক্তব্যে পাকিস্তানের প্রতিনিধি কাশ্মীরের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সমার্থক বোঝাতে চেয়েছিলেন। ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার ‘পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী কোণঠাসা’ শিরোনামের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের সামরিক শাসনামল খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরের জনগণ দ্রুত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের চাপ দিচ্ছে। দেউলিয়া অবস্থা এড়াতে ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা এবং বেসামরিক লোক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গবর্নরকে প্রতিস্থাপনের ঘোষণা ভারতে অবস্থিত ৯ মিলিয়ন শরণার্থীদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ সৃষ্টি করেনি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মূল সমস্যাকে স্পর্শই করেননি। শরণার্থীদের ব্যাপারেও কোমল মনোভাব দেখাননি। তিনি গত ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের পর পাকিস্তানের ভবিষ্যত আইনসভা কি হবে সে সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেননি। এই সমস্যা এড়িয়ে গেলে পাকিস্তানের সঙ্কট এক ইঞ্চিও সমাধান হবে না। এদিকে, স্পষ্ট রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া পাকিস্তানের দুর্দশা আরও অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আর্থিক দেউলিয়াত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। এমনকি ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের সবচেয়ে আশাবাদী সমর্থক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন না যে এই সমস্যা কতদিন স্থায়ী হবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা নিয়ে কথা বলে বিশ্ববাসীর সহানুভূতি আদায়ের পাকিস্তানী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আজ না হোক কাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে এবং সাধারণ নির্বাচন অনুসারে পদক্ষেপ নিতে হবে। যত দ্রুত তিনি এটা করবেন তত দ্রুত স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×