বিশ^বিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর অনেকের চোখেই রঙিন স্বপ্ন থাকে। অনেকে মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়ায়। তেমন রঙিন দৃষ্টি তানিয়ারও ছিল। নিয়মিত ক্লাসে যেত, বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিত। সিনিয়র ভাইয়া, আপুদের যথারীতি মান্যও করত। কিন্তু বিশ^বিদ্যালয়ের জীবন তো আর সব সময়ই সুখকর হয় না। মাঝে-মধ্যে নানা রকম হেপাও এসে দেখা দেয়। কিছুদিন আগে এক ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়ায়। হঠাৎ করে তা মারামারিতেও গড়ায়। শাকিলকে ভীষণ মার দেয় রাজিবের সমর্থক ছেলেরা। এ নিয়ে ভার্সিটি বেশ উত্তপ্ত। শাকিলকে ভর্তি করা হয় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। শাকিল স্থানীয় ছাত্র নেতা। আবার রাজিব বাইরের জেলার। শাকিলকে মার দেয়ার পরপরই রাজিব এবং তার সমর্থকরা গা ঢাকা দেয়। পানেরদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর শাকিল সুস্থ হয়ে বিশ^বিদ্যালয়ে আসে। তখন ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ নেয় শাকিলের সমর্থকরা। এবার প্রতিশোধ নেয়ার পালা। শাকিল তার সমর্থকদের নিয়ে বিশ^বিদ্যালয় চত্বরে মহড়া দেয়। খোঁজে রাজিব বা তার সমর্থকদের । কিন্তু ওদের কারও খুঁজে পায় না। তখন খুঁজে সেই ছেলেকে, যে শাকিলের অবস্থান বলেছিল। কে সেই ছেলে। হ্যাঁ, শাকিলের সমর্থকদের একজন নিশ্চিত করে বলে যে, মাহিয়ান শাকিলকে দেখিয়ে দিয়েছিল। আর যায় কোথায়, মাহিয়ান তো রাজিবদের দলেরও কেউ না। শাকিলের কথা জিজ্ঞেস করলে সরল মনে মাহিয়ান দেখিয়েছিল শাকিলকে। সেজন্যই শাকিলের সমর্থকরা রাগের মাথায় মাহিয়ানকে পেয়ে আটক করে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে শাকিলকে খবর দেয়। তখন তানিয়া বান্ধবীদের নিয়ে সেদিক দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সহপাঠী বান্ধবীরা মাহিয়ানকে গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় দেখে, চমকে উঠে। বান্ধবীদের কাছে জিজ্ঞেস করে তানিয়া জানতে পারে যে, শাকিলের সমর্থকরা তাকে বেঁধে রেখেছে। শাকিল এসে ওকে মার দেবে।
এর কারণ জানতে চাইলে বান্ধবীদের একজন বলে, কারণ, শাকিলকে কিছুদিন আগে যে মার দিছিল, তখন নাকি মাহিয়ান দেখাইয়া দিছিল ওকে।
তানিয়া বলে, মাহিয়ান কি রাজিবদের দলের।
-না।
-মাহিয়ান কি জানত শাকিলকে মার দেয়ার জন্য ওরা খুঁজচ্ছে। নিশ্চয়ই না। যদি তাই হতো, তাহলে তো ভয়ে সে ভার্সিটিতেই আসত না। আর সেজন্যই বোধ হয় মাহিয়ানের মনে কোন ভয় কাজ করেনি। কারণ, তার মনে তো অপরাধবোধ ছিল না।
এটা তানিয়ার কাছে অন্যায় বলে মনে হয়। এ ব্যাপারে মাহিয়ানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয় তানিয়া। আর তথনি তার মনে হয়, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা দরকার। এমন ভেবেই সে মাহিয়ানের কাছে দাঁড়ায়। কিন্তু ততক্ষণে একটা লম্বা রামদা নিয়ে উদ্যত শাকিল এসে হাজির হয়। রামদা হাতে মারমুখো শাকিলকে দেখে ভয়ে তানিয়ার বান্ধবীরা একে একে সটকে পড়ে। কিন্তু তখন তানিয়া নির্বিকার দাঁড়িয়েই থাকে। রামদা উঁচিয়ে আসা উদ্যত শাকিলের সামনে রুখে দাঁড়ায় তানিয়া। বলে, শাকিল ভাই! মাহিয়ানের কী দোষ?
-শোন নাই, ও-ই আমারে দেখাইয়া দিছিল। আর ওরা আইসা আমারে মারছে।
-তখন এই কথা আমারে কেউ জিগাইলে, আমিও তো তেমনই বলতাম। সরল মনে কেউ কোন কথা বললে কি তারে দোষী সাব্যস্ত করা যায়?
-এই মেয়ে তোমারে এইখানে ডাকছে কে? এখান থেকে যাও তুমি।
-সে কি আপনাকে মারছিল?
-না।
-সে কি আপনার প্রতিপক্ষের দলের?
-তোমাকে এতকিছুর জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। আগেও বলছি, এখনও বলছি-এখান থেকে তুমি যাও-
কর্কশ স্বরে এ কথা বলে তানিয়াকে পাশ কাটিয়ে শাকিল যখন ক্রোধোন্মত্ত হয়ে মাহিয়ানের প্রতি রামদা তুলে কোপ দিতে উদ্যত হতে চায়, তখন একমাত্র বাঁ-হাতে ওড়না পেঁচিয়ে সেই দায়ে সজোরে ধরে ফেলে তানিয়া। না, কোনভাবেই সেই দা ফসকাতে পারেনি শাকিল। যেনো তানিয়া প্রাণে বেঁচে থাকতে কিছুতেই এ অন্যায় করতে দেবে না। ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে তানিয়ার যে ডান হাতি খোয়া গেছে-এ কথা শাকিল জানে। অসম হাতে চলে উভয়ের ধস্তাধস্তি। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে ভার্সিটির সাধারণ ছেলে-মেয়েরা। কিন্তু কাছে কেউ এগিয়ে আসে না। ততক্ষণে পুলিশ আসতে শুরু করে। হয়ত বা প্রসাশনের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়েছে। পুলিশ দেখে শাকিল রামদা তানিয়ার হাতে রেখেই পালিয়ে যায়। পুলিশ এসে মাহিয়ানকে উদ্ধার করে এবং রামদা নিয়ে যায়। পুলিশ দেখে নিরাপদ ভেবে তানিয়ার দুজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আড়াল থেকে আসে। ওরা তানিয়াকে নিয়ে দ্রুত হলের দিকে যায়। পথে কেউ কিছু বলেনি। হলের গেট পার হয়ে বান্ধবী সুহানা বলে, তানিয়া! এভাবে জীবনের ঝুঁকি নেয় কেউ?
-জীবনের ঝুঁকি মানে! আমি তো অতসব ভাইবা এসব করি নাই। আমি মনে করছি-একটা নির্দোষ ছেলেকে রামদা দিয়া কোপাবে- তা হয় কেমনে! তাই প্রতিবাদ করলাম।
-কিন্তু যেভাবে হাতে ওড়না পেঁচিয়ে রাম দা ধরছিলি, তাতে যদি তোর হাত কেটে যেতে পারত!
জবাবে তানিয়া বলে, মরচেপড়া ভোতা রামদাতে হাত কাটব কেমনে?
-শাকিল যদি অন্য কিছু করত...। ভগ্যিস পুলিশ আইসা পড়ছিল, নাইলে কী যে হইতো...! আমরা তো ধুকপুক বুকে আড়াল থাইক্যা ঐ দৃশ্য দেইখ্যা ভয় পাইতেছিলাম।
সুহানার পর এবার লায়লা বলে।
এসব বলাবলির মাঝেই ওরা গিয়ে হলের কক্ষে প্রবেশ করে। নিজের বিছানায় বসে বান্ধবীদের কথার অর্থ উদ্ধার করায় সত্যি সত্যি তানিয়ার বোধোদয় হয়। সে বুঝতে পারে, ঘটনার সময়ে সে জটিল মনোব্যাধি ‘ওসিডি’(অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসওয়ার্ডার) এর কবলে পড়েছিল। তাই সে যা ন্যায়সঙ্গত মনে করেছে, তা করতে বাধ্য হয়েছিল। এবার বাস্তবতা অনুধাবন করে কেমন যেন ভয় পেয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে, অথচ ঘটনার সময় কোন ভয় তার মাঝে দেখা দেয়নি। কারণ, অলঙ্ঘনীয় এক কর্তব্যবোধ তাকে কেমন যেন নির্ভীকভাবে সে কাজ করতে বাধ্য করে। তখন সেই কাজের পরিণতি কী হতে পারে সে সম্পর্কে কোন ভাবনাই তাকে তাড়া করে না।
দুই.
ঘটনাটা ঘটার পর তানিয়ার নাম ওই বিশ^বিদ্যালয়ের সব ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী মুখে মুখে ফিরতে থাকে। ওই একটি মাত্র কর্ম রাতারাতি তাকে সবার কাছে পরিচিত করে তুলে। ওদিকে ওই ঘটনার পর থেকে মাহিয়ান ক্লাসে বা ক্যাম্পাসে তানিয়ার দেখা পেলেই সমীহ করে সালাম ঠুকে বলে, স্লামালেকুম আপু।
তানিয়া জবাব দেয়। মাহিয়ান যে এতটা সমীহ করে, তা তানিয়াকে অবাক করে। হয়ত বা তানিয়া প্রতিবাদ না করলে শাকিলের রামদার আঘাতে অনেক কিছুই হতে পারত মাহিয়ানের। হয়ত বা মাহিয়ান এটাকে তার পুনর্জন্ম হিসাবেই ভাবতে পারে। কিন্তু একই ক্লাসে পড়ে এতটা সমীহ করা তো তানিয়ার কাছে বেশ বেমানই মনে হয়।
কিছুদিনের মাঝে অবশ্য বিবদমান দুটি গ্রুপের মাঝে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমজোতা হয়। আলোচনা সভায় ডাকা হয় তানিয়াকেও। সেই থেকে তানিয়াকে নারী নেত্রী হিসাবে ছাত্র সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শাকিল-রাজিব ছিল ছাত্র সংগঠনের মাঝারি মানের নেতা। তাদের উপরের স্তরে অবস্থান ছিল সাগরের। এ সংগঠনের শীর্ষস্থান যে দখল করে আছে, সে-ই তো হলো সাগর। সাগরের উদ্যোগেই বিবদমান দুটি দলের মাঝে সমঝোতা হয়। তানিয়াকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকে যখনই কোন সভা আহ্বান করা হয়, তখন তানিয়াকে ডাকা হয়। তানিয়ার পরামর্শ বা বক্তব্য আবশ্যই শোনা হয়। বিশ^বিদ্যালয়ে সংগঠনের সেমিনার, সাধারণ সভা, জনসভা ইত্যাদিতে তানিয়ার মঞ্চকাঁপানো বক্তব্য সবাইকে আশান্বিত করে, স্বপ্ন দেখায়। নানা কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের ফলে তানিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনেও অপরিহার্য কর্মী হয়ে দাঁড়ায়। তবে সংগঠনে সে কখনও ওপরে ওঠার সিঁড়ি মাড়ানোর জন্য নিজের ব্যক্তিত্বকে খাটো করে না। কারও তোয়াজ-তোষামোদ তার স্বভাবজাত নয়। তার এসব গুণাবলিতে ভেতরে ভেতরে মুগ্ধ হতে থাকে সাগর।
গ্রামের এক গরিব কৃষকের শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে তানিয়া। প্রতিনিয়ত জীবন-সংগ্রাম যার নিয়তি, বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ তো তাকেই যোগাড় করতে হবে। এ তাড়ায় প্রাইভেট পড়াতে চায় সে। এ কথা সে বান্ধবীদের আগেই জানিয়ে রেখেছিল। এ সময়ে ওই এলাকার সাংসদ-কন্যার জন্য একজন নারী শিক্ষক খোঁজা হচ্ছিল। তানিয়া সেই সাংসদ-কন্যার প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োজিত হয়। প্রথম যেদিন পড়াতে যায়, সেদিন সাংসদ বলেন, আমার স্বপ্ন আমার মেয়েটা ভাল ফলাফল করবে। ছেলেটা পড়াশোনায় তেমন ভাল না। এখন আমার ভরসা- মেয়টাই। তুমি আমার মেয়ের মতো। আশা করি তুমি আমার মেয়ের স্বপ্ন পূরণে সহায়ক হবে।
জবাবে তানিয়া বলে, আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
সেই থেকে তানিয়া নিয়মিত সাংসদ-কন্যাকে পড়াতে যায়। তার প্রচেষ্টায় কিছুদিনের মাঝে পরিবর্তন আসতে শুরু করে সাংসদ কন্যার পড়াশোনায়। সেখান থেকে মাসে মাসে যে টাকা পায়, তা দিয়ে তানিয়া পড়াশোনার খরচ চালিয়ে গ্রামের বাড়িতে ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ বহনেও সহায়তা করতে পারে।
তবুও জীবন সব সময় ছন্দময় থাকে না। নানা কারণে ছন্দোপতন ঘটে। এই তো সেদিন বিশ^বিদ্যালয়ের বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের এক উল্লেখযোগ্য কর্মী তানিয়ার হলেরও এক মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেছে। ভার্সিটির ক্যাম্পাসে দেখা হলে কিংবা মোবাইল ফোনে মেয়েটিকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করে। ছেলেটা নেশাখোর। এ ঘটনায় ছাত্রী হলের কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। কিন্তু তানিয়া তো চুপ করে থাকতে পারে না। হলের বান্ধবীদের নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, ছেলেটার মুখোমুখি হতে হবে। ছেলের মোবাইলফোন সংগ্রহ করে কথা বলে তানিয়া। বলে আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। বিশেষ করে আমাদের হলের একটা মেয়ে, নাজনীনকে তো আপনি পছন্দ করেন, তাই না।
-হ্যাঁ করি।
-তার সম্পর্কেই আপনার সঙ্গে কথা আছে।
-কিন্তু কেথায়?
-আপনি তো ময়মনসিংহ শহরে থাকেন, তাই না! গ্রামের বাড়ি হালুয়াঘাট।
-জি।
-ময়মনসিংহ শহরেই আপনার সঙ্গে কথা বলব। আগামী শুক্রবার, সকাল এগারোটায়, ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে হিমু আড্ডায় দেখা হবে।
-আচ্ছা।
-ঠিক আছে, তাহলে- এই কথা রইল।
এই বলে মুঠোফোন রাখে তানিয়া। শুক্রবার নির্ধারিত সময়ে তানিয়া গিয়ে উপস্থিত হয়। ছেলেটিও সময়মতো আসে। তানিয়া বলে, আপনিই তাহলে তারেক ভাই!
-জি।
-ঠিক আছে, চলুন রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে বসি।
এক টেবিলে মুখোমুখি বসে। তানিয়া দু’কাপ কফি দিতে বলে। কফি খেতে খেতে তানিয়া বলে, আপনি নাজনীনকে খুব পছন্দ করেন।
-জি।
-কিন্তু নাজনীন আপনাকে পছন্দ করে না। এটা কি আপনি বুঝেন?
জবাবে তারেক কোন কথা বলে না। তানিয়া তখন আবার সরব হযে বলে, নাজনীন আপনার প্রস্তাবে রাজি হয় না বলে তাকে উত্ত্যক্ত করেন।
-কে বলছে?
-নাজনীন বলছে।
-যদি করেই থাকি, আপনি বলার কে?
-আমি তার বান্ধবী। এ অধিকারেই তো বলতে আসছি। আজকের পর থেকে সাক্ষাতে বা মোবাইল ফোনে তাকে উত্ত্যক্ত করবেন না।
-হুমকি দিতেছেন নাকি?
-সাবধান করে দিতেছি।
-যদি করি...
-এই ছেলে স্বর নামাইয়া কথা কও।
-আমি তোমার ওপরের ক্লাসে পড়ি। আমাকে তুমি বলতে পার না।
-তুমি আমার বান্ধবীর সঙ্গে যে কাজটা করছ, তাতে তোমার সিনিয়রিটির অবস্থান তুমি নষ্ট করছ। এই জন্যই তুমি বলতেছ। আর এরপর যদি নাজনীনকে উত্ত্যক্ত কর তাহলে ভার্সিটির ক্যাম্পাসে গেলে তোমার কিন্তু খবর আছে।
- একটা মেয়ে মানুষ হয়ে তুমি কি আমাকে হুমকি দিতেছ?
-হ্যাঁ, যদি হুমকি মনে কর, তাহলে তাই।
-ভার্সিটি ক্যাম্পাসে গেলে তুমি কী করবে...?
-নাজনীনকে উত্ত্যক্ত করে ভার্সিটিতে গেলে, ক্যাস্পাসেই তোমাকে মেরে ফেলব।
-একজন মেয়ে মানুষ হয়ে...
-আমার খবর তো নিশ্চয়ই কিছুটা জান। নাকি ভাবছ, তুমি ছেলে মানুষ, আর আমি মেয়ে...। তোমার দুটি হাত, আর আমার একটা। লাগতে যাবে আমার সঙ্গে- ...এখানেই...!
তারেক কোন কথা বলে না। কারণ, কথা বললেই রেস্টুরেন্টে একটা সিন ক্রিয়েট হতে পারে। তাতে পরিস্থিতি তানিয়ার অনুকূলেই যাবে। এসব ভেবেই নীরব থাকে তারেক। তখন তানিয়াই আবার সরব হয়ে বলে, নেশা করে একটা মেয়েকে ডিস্টার্ব কর, তোমার লজ্জা করে না! বাবা-মা টাকা পাঠায় পড়াশোনার জন্য। আর সে টাকায় নেশার উপকরণ কিনতে বিবেকে একটুও বাঁধে না!
তারেক একটি কথাও বলে না। বিবেকে কাঁটার তো বিঁধে তানিয়ার প্রতিটি কথা। কিছুক্ষণ একতরফাভাবে কথার ধোলাই দিয়ে তানিয়া বলে, এখন উঠব। চল আমার সঙ্গে, এগিয়ে দেবে।
বলে তানিয়া বিলের টাকা পরিশোধ করে তারেককে নিয়ে বের হয়। কাচারিঘাটে এসে রিক্সায় উঠে বলে, উঠে বসো, আমাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দেবে।
-আমি মেয়েদের সঙ্গে এক রিক্সায়...
-আমি আবার মেয়ে কেমনে...। তোমাকে ভাই বলিনি!
তারেক বাধ্য ছেলের মতো ঠিকই বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত তানিয়াকে এগিয়ে দেয়। তানিয়া বাসে চলে যায় ভার্সিটিতে। কিন্তু তারেক বিষয়টা নিয়ে সারাদিন নিজের সঙ্গে বেশ বোঝাপড়া করে। রাতে সে তাদের ভার্সিটির ছাত্র সংগঠনের সভাপতির কাছে ফোন করে সব খুলে বলে।
প্রতিক্রিয়ায় রাত একটায় বিরোদীদলের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি তানিয়াকে ফোন করে। বলে, হ্যালো।
জবাবে তানিয়া কর্কশ স্বরে বলে, কে তুই রাত একটার সময় আমাকে ফোন করছিস।
-তুমি জান কার সঙ্গে কথা বলতেছ?
-রাত একটার সময় অপরিচিত মেয়ে মানুষের সঙ্গে যে কথা বলে, সে আর যাই হোক, ভদ্রলোক হতে পারে না।
-আমি ছালেক, অমুক ছাত্র সংগঠনের সভাপতি। তানিয়া, তুমি নাকি আমাদের সংগঠনের তারেককে হুমকি দিছ।
-হ্যাঁ। আমার হলের এক বান্ধবীকে উত্ত্যক্ত করবে, আর আমি চুপ করে থাকব!
-এই মেয়ে, জান তুমি কার সঙ্গে কথা বলতেছ?
-এই ছেলে, রাত একটার পরে তোর সঙ্গে কি বিনয়ের কথা বলতে হবে?
-জানস আমি কী করতে পারি!
-যা পারস করবি। ওসব হুমকিকে সবাই পরোয়া করে না। কিছু করে যদি টিকে থাকতে পারস, তাহলে করিস।
-ঠিক আছে, আগামীকালই তার প্রমাণ পাবি।
-আচ্ছা করিস।
এই বলে তানিয়া চিল্লাতে চিল্লাতে ফোন রাখে। হলের বান্ধবীদের মাঝে যারা জেগে ছিল, তাদের কেউ কেউ তানিয়ার কাছে এসে তার চিল্লানোর কারণ জানতে চায়। তানিয়া সব খুলে বলে। ওসব শুনে বান্ধবীদের কেউ কেউ তো ভয়ে আৎকে উঠে। সুহানা বলে, তাইলে আগামীকাল তুই কেমনে ক্লাসে যাবি!
জবাবে তানিয়া বলে, দেখা যাক, কী হয়? ওরা হুমকি দেবে, আর আমি ভয়ে ঘরে বসে থাকব। ওদের আমরা মোকাবেলা করব। ওদের সংগঠন আছে, আমাদের কি নাই?
বান্ধবীরা তানিয়ার সাহসের তারিফ করে। তারপর ঘুমের রাজ্যে চলে যায়। তানিয়া পরদিন সকালে সাগরের সঙ্গে বিরোধীদলের ছাত্র সংগঠনের সভাপতির হুমকির বিষয়ে কথা বলে। সাগরের কাছ থেকে আশ^াস পেয়ে তানিয়া একটা রিক্সা নিয়ে ক্লাসের উদ্দেশে রওনা হয়। ভার্সিটির গেটের কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পায়, সালেকসহ প্রতিপক্ষের কিছু সদস্য বটমূলে বসে আছে। তানিয়াকে দেখেই তাদের একজন ডাকে, এই তানিয়া!
-জি ভাইয়া।
-তোমার সঙ্গে কথা আছে। একটু এদিকে আসবে!
-রাতে তো মনে হয় আপনারা ঘুমান নাই। না হলে এত সকালে এখানে আসেন কী করে? আমাদের তো ঘুমাতে হয়। কারণ, আমরা নিয়মিত ক্লাস করি। এখন ক্লাসে যাচ্ছি, দুঃখিত আসতে পারছি না।
তানিয়ার এ কথা শুনে তাদের কেউ আর কোন কথা বলেনি। কারণ, তানিয়াদের সংগঠনের কিছু ছেলেকে আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। ওকে কিছু করতে গেলে নিজেদের অস্তিত্বও যে হুমকিতে পড়বে, তা তৎক্ষণে ওরা বুঝ গেছে। নিরাপাদে তানিয়া রিক্সা নিয়ে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকে। তারপর আর কেউ কখনও তাকে কিছু বলেনি। নাজনীনকেও আর তারেক কখনও উত্ত্যক্ত করেনি।