ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বুনো পাখি, প্রকৃতি ও পরিবেশ- অনন্য ভূমিকায় ‘নিপো’

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বুনো পাখি, প্রকৃতি ও পরিবেশ- অনন্য ভূমিকায় ‘নিপো’

আবু জাফর সাবু ॥ বুনো পাখি ও প্রকৃতি পরিবেশ সংরক্ষণে ভালবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুককানুপুর ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামের তরুণ যুবক আহম্মদ উল্লাহ এবং তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা (ন্যাচার এন্ড এনভায়রনমেন্ট প্রিজারভেশন অর্গানাইজেশন- নিপো। দেশীয় স্থিতু পাখিদের সংরক্ষণ পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আহম্মদ সে এবং তার গড়া সংগঠনটি এ কাজে নিবেদিত হয়েছে। এদের উদ্যোগেই শুরুতে গোবিন্দগঞ্জের দরবস্ত, তালুককানুুপুর, কোচাশহর ইউনিয়নসহ গোবিন্দগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় পাখি এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে নিবেদিতভাবে কাজের সূত্রপাত করে এই সংস্থাটি ও তার সদস্য নিবেদিত প্রাণ ৩৫ তরুণের একটি দল। ২০০১ সাল থেকে শুরু করে আহম্মদ উল্লাহর নেতৃত্বে এই সংস্থার তরুণরা স্বেচ্ছাশ্রমে প্রশংসনীয় অন্যতম যে কাজগুলো করেছেন সেগুলো- দুটি বিরল প্রজাতির আহত হুতুম ছানাকে সুস্থ করে তোলা। এছাড়া তালুককানুপুর ইউনিয়নে রাঘবপুর গ্রামে ভাঙ্গা রাস্তায় বাঁশের সাঁকো নির্মাণ, ঝড়ের মধ্যে মাটিতে পড়ে যাওয়া বিরল প্রজাতির চিল ছানাকে ছোট থেকে বড় করে অবমুক্ত করা, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কুইজ প্রতিযোগিতা, ধানের জমিতে পাখির দ্বারা পোকামাকড় দমনের জন্য পার্চিং পদ্ধতিতে কঞ্চি পোঁতা অভিযান, রাঘবপুর গ্রামে একজন অতিদরিদ্র ব্যক্তির ঘর নির্মাণ করে দেয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সড়কের পাশে বৃক্ষরোপণসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচীর উদ্যোগ নেয়া হয়। এর বাইরেও নাটোর জেলার রাজবাড়ীতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক অভিযান, বিভিন্ন পাখিদের জন্য মাটির হাঁড়ি ও কলসের নিরাপদ বাসা নির্মাণ এবং অসুস্থ ও বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখিদের রক্ষা করে অবমুক্ত করা অন্যতম। সম্প্রতি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা দরবস্ত ইউনিয়নের মাড়িয়া গ্রাম থেকে বিরল প্রজাতির শকুন উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে আহম্মদ উল্লাহ। পাখির জন্য অনন্য ভালবাসা থেকে মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্র আহম্মদ উল্লাহ নিজের সীমিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজ গ্রামে পাখিদের বাসা তৈরি করার মাধ্যমেই সূচনা করে তার পাখি সংরক্ষণ কর্মসূচী। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে অবাধ বৃক্ষ নিধনের কারণে পাখিরা তাদের নিরাপদ আবাসস্থল হারিয়েছে এবং খাদ্য সংকটের কবলে পড়েছে। ফলে পাখিদের স্বাভাবিক প্রজনন বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া গ্রামগঞ্জের নতুন প্রজন্মের মানুষ পাখিদের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল না হওয়ায় ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে পাখিরা। এছাড়া ফসল উৎপাদনে বিষাক্ত কীটনাশকের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাখিদের মৃত্যুর হারও বেড়েছে। এই প্রতিকূল অবস্থা থেকে পাখিদের রক্ষায় তাই এগিয়ে এসেছে নিপো এবং তার সদস্যরা। শুরুতেই তালুককানুপুর ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী সমসপাড়া, ফকিরপাড়া, কবিরাজপাড়া, কাপাসিয়া, ছোট নাগবাড়ি গ্রামে তারা তাদের পাখি সংরক্ষণ ও তাদের বাসা নির্মাণের কার্যক্রমের সূত্রপাত ঘটায়। এভাবে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিজ খরচে এসব গ্রামে দুহাজার কলস স্থাপন করা হয়। বিশেষ করে অবাধ বৃক্ষ নিধনের কারণে পাখিরা এখন বাসা বানিয়ে প্রজনন করার মত নিরাপদ গাছ পাচ্ছে না। তদুপরি পাখি শিকার বন্ধ না হওয়ায় নানা প্রজাতির দেশীয় পাখি ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত গোবিন্দগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গাছে মাটির হাঁড়ি, কলস স্থাপন ও গাছের শাখায় কৃত্রিম গর্ত করে দিয়ে ছোট ছোট মাটির পাতিল বসিয়ে প্রায় ৫ হাজার পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে বলে আহমেদ উল্লাহ জানান। পাখির হত্যা বন্ধ, তাদের বাসা নির্মাণ করে দেয়া ছাড়াও পরিবেশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণে এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন কাজ করে চলেছে। তাদের উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো- শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম, সামাজিক বনায়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, খাল-বিল ডোবায় প্রাকৃতিক পরিবেশে মৎস্য চাষ, স্বাস্থ্য সেবাসহ অন্যান্য জনসেবামূলক কাজ, ছোট পরিবার গঠনে গ্রামের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন। এর মধ্যে রয়েছে স্বেচ্ছায় বৃক্ষরোপণ, পানি ও নদী দূষণ রোধ ও স্যানিটারি পায়খানা ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যাওয়া। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন নিজ চোখে তাদের পাখি ও পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রম দেখার জন্য গোবিন্দগঞ্জে এসেছেন। তাদের উৎসাহে ইতোমধ্যে গোবিন্দগঞ্জ থেকে নিপো তাদের কার্যক্রম গাইবান্ধা জেলার বাইরেও বগুড়া, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, জয়পুরহাট এবং গাজীপুর, রংপুর জেলায় সম্প্রসারিত করেছে। এ সমস্ত উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য এই পরিবেশবাদী সংস্থা নিপো এবং আহম্মদ উল্লাহ রাজশাহী বিভাগীয় পরিবেশক পদক, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় পরিবেশ সংরক্ষণ সনদপত্র, জাতীয় পরিবেশ স্বর্ণপদক ও সনদপত্র এবং জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক পদক ও সনদপত্র পেয়েছে। উত্তরপাড়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আলাউদ্দিন মিয়া ও গৃহবধূ খুরশিদা বেগমের ছেলে আহম্মদ উল্লাহ ইতোমধ্যে তার এই কাজের জন্য শুধু নিজ গ্রামেই নয়, গোটা গোবিন্দগঞ্জ উপজেলাতেই এখন পরিচিত একটি নাম। আহম্মদ উল্লাহ ও তার সংগঠন নিপো এবং নিপোর নিবেদিত সদস্যদের শুধু একটিই চাওয়া বনাঞ্চল ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা এবং বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় পাখি ও প্রাণীদের সংরক্ষণে সকলে এগিয়ে আসার লক্ষ্যে জনসচেনতা সৃষ্টি করা।
×