ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বার বার কেন বস্তিতেই আগুন

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৪ আগস্ট ২০১৯

 বার বার কেন বস্তিতেই আগুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্বামী-সন্তানদের নিয়ে গার্মেন্টসকর্মী আকলিমা আক্তার ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি ভোলায়। ফেরার কথা ছিল ১৮ আগস্ট (রবিবার)। কিন্তু এর আগেই হন্তদন্ত হয়ে ঢাকায় ফিরতে হয়েছে তাকে। ঢাকায় ফিরলেও সব হারিয়েছেন তিনি। রক্ত পানি করা পরিশ্রমে বাঁশ-কাঠের মাচায় গড়া সংসার পুড়ে ছাই হয়েছে আগুনে। শুধু আকলিমা নন, চলতিবছর এমন লাখো বস্তিবাসীর স্বপ্ন পুড়েছে। রূপনগর বস্তির আগুনে সব হারানো আকলিমা বলছেন, এর আগেও একবার আগুনে পুড়েছি। সব হারিয়েছি। ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে সব গুছিয়েছিলাম। কিন্তু আবারও আগুনে সব হারিয়ে রাস্তায় ঠাঁই হবে ভাবিনি। বস্তির ধ্বংসস্তুপের মধ্যে অবশিষ্টাংশও মেলেনি। ঈদের সময় বস্তিতে আগুন লাগাটা কাকতালীয় নয়। কোন মহল সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে আগুন লাগিয়েছে বলে মনে করেন রূপনগর চলন্তিকা বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা। ফায়ার সার্ভিসের দেয়া তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর সর্বশেষ রাজধানীর রূপনগর চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগা পর্যন্ত সারাদেশে ২৮টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। বস্তিতে লাগা এসব আগুনে শিশু-নারীসহ মারা গেছেন ১৮ জন। বস্তিতে বারবার আগুন লাগার নেপথ্যে বস্তিবাসী নাশকতা, দখলবাজি, উচ্ছেদের কৌশলকে দায়ী করলেও সরকারী মহল কিংবা ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কখনও আলোর মুখ দেখেনি। সাময়িক খাওন-থাকার বন্দোবস্ত করা হলেও পুনর্বাসন করা হয়নি তাদের। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশের ১৬৫ বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায়ই ৩৩ বার বস্তিতে আগুন লাগে। এসব আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে শত কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ মার্চ উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যেই কাওরানবাজার রেললাইন বস্তিতে আগুন লাগে। রহস্যজনক ওই আগুনে সব হারিয়ে তিন শতাধিক ঘরের বাসিন্দাদের জায়গা হয় খোলা আকাশের নিচে। ওই ঘটনার চারদিন আগে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় ভাসানটেকের আবুল ও জাহাঙ্গীর বস্তি। ওই আগুনে তিন শিশু মারা যায়। ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ওই একই বস্তি পুড়েছিল আগুনে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকায় ভেড়া মার্কেট বস্তিতে লাগা ভয়াবহ আগুনে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যান নয়জন। এখানেও পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানোর অভিযোগ বস্তির বাসিন্দাদের। ১০ বছরে কড়াইল বস্তিতে ১৭ বার আগুন ॥ আগুনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সখ্য যেন বনানীর কড়াইল বস্তির। গত ১০ বছরে বস্তিটি পুড়েছে ১৭ বার। গত তিন বছরে ছয়বার পোড়ে আগুনে। এর মধ্যে এক বছরেই পোড়ে তিনবার। এসব আগুন স্বাভাবিক কারণে লেগেছে- এমনটা মানতে নারাজ বস্তিবাসী। তাদের অভিযোগ, এসব আগুন নাশকতার অংশ। গতবছর ১১ মার্চ ভোরে রাজধানীর পল্লবীর ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় প্রায় দুই হাজার ঘর। ওই আগুনেও নাশকতার অভিযোগ করেন বাসিন্দারা। কড়াইল বস্তিতে ৩০ বছর ধরে বসবাস করছেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটা বস্তিতে এক বছরে যখন তিনবার আগুন লাগে তখন আপনাকে বুঝতে হবে এটা স্বাভাবিক কোন আগুন নয়। আগুন লাগার কারণ যা-ই হোক না কেন, আগুনটা যে লাগানো হচ্ছে- এটা বস্তিবাসী বিশ্বাস করে ফেলেছে।’ সর্বশেষ রূপনগরের চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগার পর জানা গেছে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই দীর্ঘদিন ধরে বস্তিটি নিয়ন্ত্রণ করছিল একটি প্রভাবশালী চক্র। তাদের প্রভাবের কারণে বস্তিতে অবৈধভাবে গ্যাস-বিদ্যুত ও পানির সংযোগ দেয়া হয়। বস্তির নিয়ন্ত্রণকারীদের পরিচয়, তারা স্থানীয় কাউন্সিলর ও এমপি ইলিয়াস মোল্লার লোক। তবে ভয়ে বস্তিবাসী নাম প্রকাশে নারাজ। বস্তিটিতে আগুন লাগার কারণ হিসেবে উঠে আসে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বিষয়টি। প্লাস্টিকের গ্যাসের লাইনে দ্রুত ছড়ায় রূপনগর বস্তির আগুন- এমন ধারণা ফায়ার সার্ভিসের। এ ঘটনায় উপ-পরিচালক (এ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি। বাকি সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক (অপারেশন্স) আব্দুল হালিম ও উপ-সহকারী পরিচালক (ঢাকা জোন-২) নিয়াজ আহমেদ। কমিটির সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক (ঢাকা জোন-২) নিয়াজ আহমেদ বলেন, তদন্ত চলছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবে। বস্তিতে কেন বারবার আগুন লাগে- জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান একটি অনলাইনকে বলেন, নানা কারণেই বস্তিতে আগুন লাগে। এর আগে তদন্তে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও গ্যাসের পাইপের লিক থেকে আগুনের কারণ উঠে এসেছে। তবে আগুন যে লাগানো হয়, তা-ও অমূলক নয়। বস্তিতে আগুন লাগার পেছনে কোন মহলের ইনফ্লুয়েন্স তো থাকেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দুর্ঘটনাজনিত কারণে বস্তিতে বারবার আগুন লাগে না। বরং বস্তিতে আগুন লাগানো হয়। এতে কারও কোন সন্দেহ নেই। বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানকার জমিতে অন্যকিছুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সবগুলো আগুনেই কায়েমি স্বার্থন্বেষী মহল, প্রশাসন ও সরকারদলীয় লোকজন জড়িত বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, এখানে ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল না হওয়া পর্যন্ত বারবার আগুনের ঘটনা ঘটবে। এখানে আমাদের দাবি হলো, পুনর্বাসন ছাড়া কাউকে উচ্ছেদ নয়। রূপনগর বস্তির যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের আগে ওই জায়গাতেই বসবাস ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
×