ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞ অভিমত

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা অশুভ ইঙ্গিত

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২২ আগস্ট ২০১৯

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা অশুভ ইঙ্গিত

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ প্রত্যাবাসন বিষয়টি নিয়ে আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সরকার এবং এনজিওর দায়িত্বরত লোকজনের দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের চেয়ারম্যান, টিম লিডার, হেড মাঝি, ব্লক মাঝি, মাস্টার, ইমাম, মুরব্বি ও রোহিঙ্গা নারীদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য বোঝানো হয়েছে। বৈঠকে সরকার তথা প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, কোন রোহিঙ্গাকে জোর করে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না। এত সহজভাবে বোঝানোর পরও মন গলছে না রোহিঙ্গাদের। নিজ দেশে ফিরে যাবার বিষয়ে হ্যাঁ বলছে না। প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের বুধবারও সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাতকার নেয়া হয়। তারা সবাই একবাক্যে বলে দিয়েছে যে তাদের দাবি- তথা পাঁচ দফা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। এদিকে বার বার প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্থ হওয়া আমাদের দেশের জন্য অশুভ ইঙ্গিত বলে মত প্রকাশ করে বুদ্ধিজীবীরা বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়টি এখন অনেকটা জটিল হয়ে গেছে। কারণ তারা নিজ ভিটাবাড়িতে নেই। বাংলাদেশে আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দাবি করা রোহিঙ্গাদের বোকামি বলে মন্তব্য করেন তারা। যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের। সমাধানও দেবে মিয়ানমার। সম্প্রতি দেশটির ১৯সদস্যের প্রতিনিধিদল সরেজমিনে এসে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হওয়ার অনুরোধ করে গেছেন। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু শর্তসাপেক্ষে নাগরিকত্বের দাবি পূরণ করার কথা দিয়েছেন তারা। এর আগে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণমন্ত্রীও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে একই কথা দিয়েছিলেন। এ জন্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হওয়া উচিত। তা না হলে রোহিঙ্গারা দেশটির সব সুযোগ হারাবে বলে জানান তারা। জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রত্যাবাসন নিয়ে মুখ না খোলার জন্য লিফলেট বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। তিনদিন ধরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রতিটি ক্যাম্পে রাখাইন ভাষায় লেখা লিফলেট বিতরণ করছে। এ কাজে তারা গাড়িও ব্যবহার করছে। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন হলে সেদেশে রোহিঙ্গাদের কি পরিস্থিতি হবে, তা নিয়ে উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে রাখাইন ভাষায় লেখা লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এই লিফলেটের ওপর মিয়ানমারের সরকারের মনোগ্রামও দেখা গেছে। গত রবিবার থেকে এসব লিফলেট বিতরণ করে চলছে রোহিঙ্গারা। এই লিফলেটে চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানে রোহিঙ্গাদের জীবন-যাপন কেমন হবে, তা এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যাতে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে একজন রোহিঙ্গাও সহজে মুখ না খোলে। লিফলেটে লেখা আছে, প্রত্যাবাসনকারী রোহিঙ্গাদের প্রথমে এনভিসি কার্ড নিতে হবে। তারপর নাকফুরা শিবিরে রাখা হবে। সেখান থেকে ছয় মাসের আইডিবি ক্যাম্পে নেয়া হবে। তাই কোন রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব ও সমঅধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার ফেরত যাবে না। কারণ মিয়ানমার সরকার মিথ্যাবাদী। তাদের কোনভাবে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। সচেতন মহল বলছে, রোহিঙ্গারা শরণার্থী বা উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করার কথা, তারা রঙ্গিন প্রেসে ছাপানো ডিজিটাল লিফলেট পেল কোথায়? কারা এসব লিফলেট সরবরাহ করেছে? টেকনাফের প্রতিটি ক্যাম্পে গাড়িতে করে লিফলেট বিতরণ করার সময় ওই গাড়িতে বসা ছিল কারা? লিফলেট, ফেস্টুন, ব্যানার ইত্যাদি ডিজিটাল প্রেসে ছাপানোর এত টাকা রোহিঙ্গারা পেল কোথায়? উস্কানিমূলক লিফলেট বিতরণ করে প্রত্যাবাসন কাজ ভ-ুল করার পেছনে জড়িত কারা? এসব বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করার দাবি জানানো হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। তারা আরও বলেন, প্রশাসন প্রত্যাবাসনের পক্ষে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, আর ষড়যন্ত্রকারীরা গোপনে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রত্যাবাসনে রাজি না হওয়ার উস্কানি দেবে এটা মেনে নেয়া যায় না। প্রত্যাবাসন কাজে প্রশসনের তৎপরতা উপলব্ধি করতে পেরে ক্যাম্প ত্যাগ করে রোহিঙ্গারা আশ্রয় ঠিক করে রাখছে বিভিন্ন স্থানে। অনেকে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। প্রধান সড়কে চেকপোস্ট রয়েছে বলে তারা বিভিন্ন মেঠোপথ ধরে ছুটে চলছে শহরে। গিয়ে উঠছে শহর-বন্দরে প্রতিষ্ঠিত স্বজনদের বাসাবাড়িতে। কেউ কেউ শহরে বাসা ভাড়া ঠিক করে রাখছে। তবে ত্রাণের আসায় দুয়েকজন থেকে যাচ্ছে ক্যাম্পে। এনজিওর শেখানো বুলি ॥ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সম্মানের সঙ্গে তাদের ফেরত পাঠাতে ঘুমধুমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতু ও টেকনাফের কেরুনতলীতে উন্নত ব্যবস্থায় কাঠের সেতু (জেটি) নির্মাণ করেছে। তবুও গতি পাচ্ছে না প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। এর মূলে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে একটি চক্র। নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত গড়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে প্রত্যাবাসন না হওয়ার আহ্বান করে যাচ্ছে তারা। এনজিওর প্রভাব বিস্তার ॥ উখিয়া ও টেকনাফে মোট ৩২ রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে বর্তমানে এসব ক্যাম্পে বসবাস করছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আর এদের ভরণপোষণসহ যাবতীয় জিনিসের ব্যবস্থা করে আসছে প্রায় দু’শ’ আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিও। তন্মধ্যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী (জঙ্গী) আরএসও নেতারাও বিভিন্ন এনজিওর অধীনে রোহিঙ্গা সেবার নামে কাজ করে থাকে। নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে যেতে নিরুৎসায়িত করে আসছে তারা। প্রতিটি ক্যাম্পে অর্ধশতাধিক ব্লক রয়েছে।
×