ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিষ্টির নাম সাবিত্রী দেড় শ’ বছরের ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ১১:০১, ২২ আগস্ট ২০১৯

মিষ্টির নাম সাবিত্রী দেড় শ’ বছরের ঐতিহ্য

মোরসালিন মিজান, মেহেরপুর থেকে ফিরে ॥ সাবিত্রীর এখন বয়স দেড় শ’ বছর! দেড় শ’ বছর বলেই অনুমান করা হয়। বয়স অনেক হলেও আকর্ষণ এতটুকু কমেনি। বরং বেড়েছে। বেড়েই চলেছে। কেউ মেহেরপুর বেড়াতে যাবেন অথচ সাবিত্রীর খোঁজ করবেন না, এমনটি যেন হতেই পারে না। অনেকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। আর স্থানীয়রা সারা বছরই মিষ্টি করে এই মিষ্টির কথা বলেন। হ্যাঁ, সাবিত্রী একটি মিষ্টির নাম। একবার খেলে স্বাদটা জিবে লেগে থাকে। সময়ের ব্যবধানে এত কিছু বদলেছে, হারিয়ে গেছে, সাবিত্রী আছে আগের মতোই। স্থানীয়দের বিয়েতে, উৎসব অনুষ্ঠানে, অতিথি আপ্যায়নে সাবিত্রী থাকা চাই। চাই-ই। জেলা সফরে যাওয়া মন্ত্রী এমপি রাষ্ট্রীয় অতিথি কূটনীতিকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করার হয়। এ রীতি বহু দিন ধরে চালু আছে। এভাবে সারা দেশেই সাবিত্রীর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকায় বসেও নামটি শোনা যায়। প্রচুর শোনা হয়েছে। কিন্তু সাবিত্রীর স্বাদ আসলে কেমন? দেখতে কেমন সাবিত্রী? কেন এত নাম ডাক? কী করে এতকাল টিকে আছে? সম্প্রতি মেহেরপুরে গিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সুযোগ হয়। মিষ্টির কারখানা বা দোকান শহরের ঠিক কোথায় অবস্থিত তা আগে থেকে জানা ছিল না। তবে স্থানীয়দের প্রায় সকলেই এ মিষ্টি সম্পর্কে অবগত। কেউ ঠিকানা বুঝিয়ে দিলেন। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন কেউ। মেহেরপুর প্রধান সড়কে অবস্থিত দোকানের নাম বাসুদেব গ্র্যান্ড সন্স। মধ্য দুপুরে সেখানে হাজির হয়ে দেখা গেল, সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা রয়েছে ‘বাসুদেব।’ পাশে ছোট করে ‘গ্র্যান্ড সন্স’ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। জানা গেল, সাবিত্রী তৈরির মূল কারিগর ছিলেন বাসুদেব সাহা। শুরুটা তিনি করেন। তার নামেই দোকানের নামকরণ করা হয়েছে। বাবার কাছ থেকে বিদ্যাটি রপ্ত করে ছেলে রবীন্দ্রনাথ সাহা এ মিষ্টি তৈরি করেছেন। তার যুগও শেষ হয়েছে। এখন নাতিরা লালন করছেন সাবিত্রীকে। হ্যাঁ, তিন পুরুষের চর্চা। পরম যতেœ ভালবাসায় একে টিকিয়ে রেখেছে বর্তমান প্রজন্ম। নাম ডাক বেশি হলেও, ছোট্ট একটি দোকান। সাইনবোর্ড থেকে চোখ সরাতেই দেখা গেল, ছোট্ট সে দোকানে তালা দেয়া। তবে কি সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে আসা হলো? প্রশ্ন চোখে আশপাশে তাকাতেই অন্য এক দোকানি এগিয়ে এলেন। ঢাকা থেকে এসেছি জানার পর তিনি বললেন, আরও অনেকেই আসেন। কিন্তু সাবিত্রী তো পাবেন না। একদিন আগে অর্ডার দিতে হয়। আজ যা অর্ডার ছিল সবই বোধহয় সরবরাহ করা হয়ে গেছে। তাই দোকান বন্ধ। তার পরও বিকেলে এসে আরেকবার খোঁজ করার পরামর্শ দিলেন তিনি। কথা অনুযায়ী বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, দোকান আগের মতোই বন্ধ। পাশের দোকানিটি এবার কিছুটা বিব্রত। বললেন, আমি ফোন নাম্বার ম্যানেজ করে দিচ্ছি। আপনারা কথা বলে দেখতে পারেন। এবার কাজ হলো। আমাদের ফোন পেয়ে এক বিনয়ী ভদ্রলোক এসে দোকান খুললেন। জানা গেল, বাসুদেব সাহার নাতি হন তিনি। নাম বিকাশ। বিকাশ কুমার সাহা। তার দুই ভাই অনন্ত ও লালন। আশার কথা যে, সকলেই পৈত্রিক পেশা ধরে রেখেছেন। নিজ হাতে তৈরি করছেন সাবিত্রী। বাইরের মতো দোকানের ভেতরটাও অতি সাধারণ দেখতে। গ্লাস শোকেস বা এ জাতীয় কিছু নেই। পাশের একটি টেবিলে পাঁচ প্যাকেট মিষ্টি। প্রতি প্যাকেটে এক কেজি করে মিষ্টি রাখা আছে। সেদিকে দেখিয়ে বিকাশ বললেন, গতকালের অর্ডার। কয়েক কেজি ডেলিভারির বাকি আছে। কথা শেষ হতে না হতেই এক ক্রেতা এসে হাজির হলেন। তার হাতে তুলে দেয়া হলো তিনটি প্যাকেট। জানা গেল, ক্রেতার নাম সোহরাব। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আমি দুবাইয়ে কাজ করি। ছুটিতে দেশে এসেছিলাম। ফেরার পথে বিদেশী বসদের জন্য সাবিত্রী নিয়ে যাচ্ছি। এভাবে দেশীয় ঐতিহ্য হিসেবে এই মিষ্টি আরও অনেক দেশে পৌঁছে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। কিন্তু আমাদের হাতে কি পৌঁছবে না সাবিত্রী? তরীটা তীরে এসে এভাবে ডুবে যাবে? মনে মনে আক্ষেপ করতেই আমাদের দিকে শেষ দু’ প্যাকেট সাবিত্রী এগিয়ে দিলেন বিকাশ। বললেন, আপনারা এত দূর থেকে এসেছেন। অতিথি। তাই খালি হাতে ফেরালাম না। এর কিছু সময় পর স্থানীয় যুবক সুমন এসে সাবিত্রীর খোঁজ করলেন। পেলেন না। অগত্যা আগামী দিনের জন্য অর্ডার দিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে বললেন, সাবিত্রী আমাদের এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। নিজেরা খাই। অন্যদের খাওয়াতে পছন্দ করি। মেহেরপুরে যেই আসুক তাকে সাবিত্রী দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এটা আমরা ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি। এদিকে, প্যাকেট হাতে পেয়ে আমাদের আর তর সইছিল না। একটি প্যাকেট খোলা হলো দোকানের ভেতরেই। লম্বা আকৃতির ১৮টি মিষ্টি। সুন্দর সাজানো। আগুনে পোড়া গায়ের রং। ভাল করে খেয়াল করে দেখা গেল, প্রতিটি মিষ্টির ওপর রিলিফ ওয়ার্কের মতো করে লেখা রয়েছে ‘সাবিত্রী!’ প্রত্যেকে একটি করে মুখে পুড়লাম আমরা। হাতে নেয়ার সময় মনে হলো তেমন রস নেই। শুকনো মতো মিষ্টি। কিন্তু মুখে তুলতেই অমৃত! রসে মুখ ভরে গেল। খুব বেশি মিষ্টি নয়। খুব কমÑ তাও নয়। আদি একটা ঘ্রাণ। স্বাদটাও অকৃত্তিম। স্থানীয় ইতিহাস ঘাটতে গিয়েও পাওয়া গেল সাবিত্রীকে। ঠিক কবে এই মিষ্টি তৈরি শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য নেই। তবে বলা হচ্ছে, ব্রিটিশ আমলে ১৮৬১ সালে বাসুদেব সাহা নামের স্থানীয় বাসিন্দা বিশেষ এই মিষ্টি উদ্ভাবন করেন। জমিদার সুরেন বোসের নামটিও এ মিষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে গেছে। সুরেন বোসের বাড়ির সিংহ ফটকের সামনে ছিল বাসুদেবের মিষ্টির দোকান। দোকান বলতে, খড় টালি ও টিন দিয়ে নির্মিত বসতবাড়ি। বাড়ির একাংশে মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি করা হতো। একই স্থানে নির্মিত নতুন ভবনে এখন তৈরি হচ্ছে সাবিত্রী। এখানেই দাঁড়িয়ে মিষ্টি খেতে খেতে কথা হচ্ছিল বিকাশ সাহার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, আমরা ঘোষ নই। কিন্তু ছয়-সাত পুরুষ ধরে মিষ্টি তৈরি করে আসছি। তিন জেনারেশন আগে আমাদের গ্র্যান্ড ফাদার বাসুদেব সাহা সাবিত্রী উদ্ভাবন করেন। তার কাছ থেকে শিখেছিলেন আমার বাবা। এখন আমরা ভাইয়েরা তৈরি করছি। সাবিত্রীতে বিশেষ কী আছে? জানতে চাইলে কিছুটা অবাক করে দিয়ে তিনি বলেন, বিশেষ কিছু নেই। দুধ চিনি জাল দিয়েই করা। হাতের গুণাগুণ থাকতে পারে। অবশ্য পরের আলোচনায় প্রবেশ করতেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। বোঝা হয়ে যায়, পূর্ব পুরুষের সততা শুদ্ধতা ধরে রাখার আন্তরিক চেষ্টাই সাবিত্রীকে অন্য মিষ্টি থেকে আলাদা করেছে। সরাসরি সে কথা না বললেও, বিকাশ উল্লেখ করেন, ‘সতী-সাবিত্রী’ বলতে যা বোঝায়, সেই অর্থে সাবিত্রী নামকরণ করা হয়েছিল। বড় অর্থ। নামের অর্থের মতোই এই মিষ্টি নির্ভেজাল। শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মান নিয়ে আপস করা হয়নি বলে জানান তিনি। বহুকালের সুনাম অক্ষুণœ রাখার সচেতন প্রয়াস হিসেবে নিজ হাতে মিষ্টি তৈরির কাজ করছেন তারা। কাজে সহায়তা করার জন্য দু’ একজন কর্মচারী আছে বটে, মূল কাজ করেন পরিবারের লোকেরাই। শুধু মিষ্টি তৈরি নয়, প্যাকেট করা, দোকানে বসে বিক্রি করা সবই নিজেরা করেন। বিকাশ জানান, মিষ্টি তৈরির কাজ হয় প্রতিদিন সকালে। গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা খাঁটি দুধ ব্যবহার করেন তারা। এক কেজি ভাল দুধে ৬ থেকে ৮টা সাবিত্রী তৈরি করা যায়। মূল উপকরণ দুধ এবং চিনি। প্রথমে লাকড়ির আগুনে দুধ ভাল করে জাল দিয়ে গুটিছানা করা হয়। পরে কয়েক ধাপে তৈরি হয় সাবিত্রী। দিনে মাত্র ১০ থেকে ২০ কেজি মিষ্টি তৈরি সম্ভব হয়। আর প্রতি কেজি সাবিত্রী বিক্রি হয় ৩০০ টাকা করে। এত কম মিষ্টি তৈরি এবং অল্প দামে বিক্রি করে চলে? টেকা যাচ্ছে? জানতে চাইলে বিকাশকে কিছুটা বিষণœ মনে হয়। তিনি বলেন, মাঝখানে হতাশ হয়ে আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কয়েক মাস বন্ধ ছিল দোকান। আসলে আজকের বাজারে ব্যবসা ধরে রাখা খুব কঠিন। কিন্তু ব্যবসা তো করি না। সাইনবোর্ডের ব্যবসা করলে করাই যায়। কিন্তু পূর্ব পুরুষের এতদিনের স্মৃতি, এলাকার ঐতিহ্য ধরে রাখা আমাদের দায়িত্ব। দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি। একইভাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সাবিত্রী নাম দিয়ে মিষ্টি বিক্রির খবরে আহত বোধ করেন তিনি। বলেন, অনলাইনে আমাদের নাম ব্যবহার করে মিষ্টি বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা লেখাপড়া শিখি নাই। দামী মোবাইল ব্যবহার করি না। তাই অনলাইনে কী হচ্ছে, বুঝিও না। এ প্রসঙ্গে আরও একটি কষ্টের কথা জানান বিকাশ। বলেন, একবার কোন একটি পত্রিকায় আমাদের মিষ্টি নিয়ে খুব ভাল ভাল কথা লেখা হলো। পরদিনই ফল পেয়ে গেলাম আমরা। ট্যাক্স অফিসের এক কর্তাব্যক্তি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ঐতিহ্যটি কত সমস্যার মধ্যেও ধরে রেখেছি, বাপ দাদার সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়েছে, এ জন্য কোন ধন্যবাদ নেই। উল্টো বলা হলো, আমি বিরাট ব্যবসা করছি। সরকারের টেক্স দেই কিনা, জানতে চাইলেন! শিক্ষিত বড় কর্তাদের এমন ঐতিহ্যপ্রেমের গল্প শুনে আমাদেরও মন খারাপ হয়ে গেল। কিছুটা লজ্জাও পেলাম। মিষ্টির প্যাকেটের সঙ্গে এই লজ্জা নিয়ে ফিরতে হলো ঢাকায়!
×