ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুম্বাইয়ের ‘দাবাং লেডি’র জীবন জয়ের কাহিনি ভাইরাল

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ১০ জুলাই ২০১৯

মুম্বাইয়ের ‘দাবাং লেডি’র জীবন জয়ের কাহিনি ভাইরাল

অনলাইন ডেস্ক ॥ জীবন সব সময় সরল রেখায় চলে না। নানা ধরনের সঙ্কট আসে। সঙ্কটগুলো কাটিয়ে জীবনটাকে জয় করা কঠিন। লড়াই করে সেগুলো দূর করতে হয়। এভাবেই জীবনের নানা সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ভারতের মুম্বাইয়ের শিরীন। একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু, বিবাহ বিচ্ছেদ, তিন সন্তান, যাদের মধ্যে একজনের বয়স মাত্র তিন মাস, তাদের নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে অটোরিকশা চালিয়ে জীবন চালানো কঠিন কাজই বটে। তিনি সেই কঠিন কাজটিই করছেন। শিরীনের কোনো পদবি নেই। মুম্বাইয়ের রাস্তায় অটোরিকশা চালান তিনি। সম্প্রতি ‘হিউম্যানস অব বোম্বে’ নামে একটি ফেসবুক পেজে শিরীনের জীবনের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে নিজের ভাষায় নিজের জীবন যুদ্ধের গল্প বলেছেন তিনি। শিরীন লিখেছেন- ‘এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে আমার জন্ম। প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া লাগতো। আমার বয়স যখন ১১, তখন বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের পর মা আবার বিয়ে করেন। মা যা ঠিক মনে করতেন তাই করতেন। আর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য মাকে চারপাশের পুরুষদের তীব্র কটাক্ষের মুখে পড়তে হতো। একবার ভাইকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছিলেন মা। সেখানে ওদের ঘিরে ধরে আমাদের সম্প্রদায়ের কিছু লোক। তীব্র কটাক্ষ করে তারা। এমনকি মায়ের চরিত্র নিয়ে অপমান করে। ওই লোকগুলো আমার ভাইকেও গালিগালাজ করে, যা আমার মায়ের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। মায়ের মানসিক অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সে রাতেই নিজের গায়ে আগুন দেন। মাকে হারানো জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি ছিল। তাও আমরা বাঁচার চেষ্টা করি। এক বছরের মধ্যেই আমাদের দুই বোনের বিয়ে দিয়ে দেন বাবা। পণের জন্য আমার বোনের ওপর তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা চাপ দিতে থাকে। বোন যখন গর্ভবতী ছিল তখন তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে বিষ খাইয়ে দেয়। এই ঘটনা পুরোপুরি আমাকে ভেঙে দেয়। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দুজনকে হারালাম। আমি তখন গর্ভবতী। কিছুদিন পরই আমার ছেলে জন্মায়। তার জন্যই আমাকে বাঁচতে হতো। স্বামীর সঙ্গে আমার ঝগড়া শুরু হতে লাগলো। তৃতীয় সন্তানের জন্মের পর আমার স্বামী আমাদের দেখভাল করতে অস্বীকার করে। সে শুধু আমার সঙ্গে সহবাস করতে চেয়েছিল। যখন তার সেই চাহিদা মিটে যায় সে তিন তালাক দিয়ে দেয় আমাকে। আমাকে তিনটি সন্তান নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। তিন সন্তান নিয়ে আমি তখন রাস্তায় একা। একটি বিরিয়ানির দোকান দিলাম। কিন্তু একদিন পৌরসভা সেটাও ভেঙে দেয়। আমার স্বামী অটোরিকশা চালাতো। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমিও অটোরিকশা চালাবো। অটোরিকশা থেকে ভালোই আয় হতে লাগল। তবে সেই সঙ্গে বহু মানুষের হেনস্থা, নির্যাতন, অপমান সহ্য করতে হতো। নারী বলে অনেকেই আমাকে ভরসা করতে পারতেন না। অন্য অটোচালকদের হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে। কিন্তু কোনো কিছুকেই গুরুত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। গত এক বছর ধরে আমার আয়ে সংসার চলছে। আমার সন্তানদের সব আবদার মেটাই আমি। আমি তাদের একটা গাড়ি কিনে দিতে চাই, হয়তো শীঘ্রই সেটা দিতে পারবো। আমার অটোরিকশার অনেক যাত্রীর আচরণে গর্বিত। কেউ আমার জন্য হাততালি দেয়, এমনকি কেউ কেউ বুকে জড়িয়ে ধরে। একবার আমার মনে আছে, এক ব্যক্তি অটোতে উঠে আমাকে নারী বলে বুঝতেই পারেননি, ভাই বলে সম্বোধন করেন। কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারেন, আমাকে ‘দাবা লেডি’ বলে সম্বোধন করেন। আমি নিজেও জানি আমি তাই। আমি চাই আমার মতো অন্য নারীরাও এমন দবং হোক। নারীরা সবকিছু করতে পারেন। অন্যের তৈরি করা নিয়মে তাদের বাঁচার প্রয়োজন নেই। আমি চাই না আমার মা বা বোনের মতো কষ্ট কেউ পাক। তাই যখন কোনো যাত্রী আমার সন্তানদের জন্য দোয়া করেন, আমার প্রশংসা করেন, তখন আমি ভাবী, আমি যা করছি তা আমার জন্য নয়, এটা সেই সব নারীর জন্য যারা মুখ বুঝে সবকিছু সহ্য করছেন।’ শিরীনের জীবন জয়ের এ কাহিনী এখন ইন্টারনেটে ভাইরাল। হাজার হাজার মানুষ তার প্রশংসা করছেন। তার জন্য দোয়াও করছেন অনেকে।
×