ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য ॥ হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

প্রকাশিত: ০৯:০০, ৪ জুলাই ২০১৯

সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য ॥ হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে বছরে ২০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে এসে পড়ছে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান থেকেও এসব প্লাস্টিক বর্জ্য এসে পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অণুজীবের পেটে ক্ষুদ্র আকারের প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এমনকি পরিশোধিত- অপরিশোধিত উভয় প্রকার লবণেই ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের এক যৌথ গবেষণায় সম্প্রতি এই ঘটনা ধরা পড়ে। প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতির কারণে মানব শরীরে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধে বলে জানান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা জানান, মাইক্রো প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক কণা আকারে খুবই ছোট বলে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী এগুলোকে নিজেদের খাবার ভেবে ভুল করে খেয়ে ফেলে। আর প্লাস্টিক খাওয়া সেই মাছ আমরা ভক্ষণ করি। মানে পরোক্ষভাবে আমরাও প্লাস্টিক ভক্ষণ করি। তাই বঙ্গোপসাগরে এই প্লাস্টিক দূষণের ঘটনাকে ভবিষ্যত জনস্বাস্থের জন্য একটি ভয়াবহ ও মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. হারুনুর রশীদ বলেন, প্লাস্টিক কণা বর্জ্যরে কারণে আমাদের বঙ্গোপসাগরে পরিবেশ দূষণের মাত্রা নির্ণয় করতে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে যৌথভাবে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় এ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তা আঁতকে ওঠার মতো, অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আমরা যেখানেই প্লাস্টিকের দূষণ করি না কেন, তা সাগরে গিয়ে পৌঁছে। আর এসব প্লাস্টিকের মধ্যে বড় আকারের যেমন আছে, তেমনি আছে ৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র। আবার বড় প্লাস্টিকও সমুদ্রে গিয়ে ক্ষুদ্র আকারে ভেঙ্গে যায়। সাগরে কিছু প্লাস্টিক ভাসমান আর কিছু প্লাস্টিক তলদেশে থাকে। এ উভয় প্রকার প্লাস্টিকই আমাদের সমুদ্রের প্রাণিকূলের জন্য ক্ষতিকর। ড. হারুনুর রশীদ বলেন, সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের পর তা পানির তোড়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাঙ্গে। ভাঙ্গা অংশগুলো পুনরায় সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে পুনরায় ভেঙ্গে ন্যানো, মাইক্রো ও ম্যাক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। তিনি বলেন, এই ভাঙ্গনের ফলে সৃষ্ট প্লাস্টিকের কিছু উপাদান (ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, যেমন- বিসফিনল-এ নির্গত হয়) মানুষের দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্লাস্টিক-দূষিত মাছ খাওয়ার ফলে আমরা বিসফিনল-এ দূষণ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। মাছ ছাড়াও সমুদ্রের অমেরুদ-ী প্রাণীও মাইক্রোপ্লাটিক ‘ফিল্টার করে’ গ্রহণ করে বলে জানান তিনি। এছাড়া সমুদ্রের ক্ষুদ্র প্রাণীকণা বা জু-প্লাঙ্কটন এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক ভক্ষণ করে। আবার এসব ক্ষুদ্র প্রাণীকণা বিভিন্ন মাছের খাদ্য বলে মাছ এদের ভক্ষণ করে। আর আমরা সেই মাছ খেতে গিয়ে আমরাও মাইক্রোপ্লাস্টিক খাই। বিজ্ঞানী হারুন জানান, মাছের পেটে ছোট-বড় প্লাস্টিক পাওয়া থেকে বোঝা যায়, কিছু কিছু মাছ সরাসরি প্লাস্টিক ভক্ষণ করে থাকে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী বলেন, কক্সবাজারের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণায় বাঁকখালী নদীর মোহনা ও সোনাদিয়ার পাশে সমুদ্রের উপরিভাগের পানি থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে। লাবনী পয়েন্ট সৈকতের ও কাঁকড়া বীচের বালিতে প্লাস্টিকের দূষণ নির্ণয় করা হয়েছে এবং অপরিশোধিত ও পরিশোধিত (বাণিজ্যিক) লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ পরীক্ষা করা হয়েছে। গবেষক দলে ছিলেন- ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর, কক্সবাজারের সন্তান ড. হারুনুর রশীদ, একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কইজার আহমেদ সুমন এবং কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহনুর জাহেদুল হাসান। চলমান গবেষণার এই পর্যন্ত গবেষণালব্ধ ফলাফল সম্পর্কে গবেষক দলের প্রধান ড. হারুনুর রশীদ বলেন, বাঁকখালী নদীর মোহনার পানির উপরিভাগে ভাসমান অবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২০ হাজারেরও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া মহেশখালী, টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে সংগৃহীত অপরিশোধিত লবণে কেজিতে প্রায় ১০০০টি এবং দেশের নাম করা বাণিজ্যিক কোম্পানির পরিশোধিত লবণে প্রতি কেজিতে পাওয়া গেছে ৭০০ থেকে ৯০০টি মাইক্রো প্লাস্টিক।
×