ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমার স্বামী যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?

প্রকাশিত: ১২:১০, ৩ জুলাই ২০১৯

আমার স্বামী যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আমার স্বামীর যদি কিছু হয়ে যায়। যদি আমার স্বামী আর কোন দিন স্বাভাবিক হতে না পারে, তাহলে আমি ছোট ছোট দুইটি বাচ্চা নিয়ে কোথায় দাঁড়াব। আমি গৃহিণী। আমার কোন রোজগার নেই। আমার স্বামীর রোজগারে সংসার চলে। ভাড়া বাসায় থাকি। স্বামীর কিছু হওয়া মানেই আমাদের পথে বসা নিশ্চিত। গার্মেন্টসে চাকরি করে আমার স্বামী। এভাবে কয়েক মাস বসে থাকলে হয়তো আমার স্বামীর চাকরিটাই চলে যাবে। তখন কি হবে। কোথায় যাব কি করব। আমার স্বামীর সঙ্গে তো কারও কোন বিরোধ নেই। আমার স্বামী রাজনীতি করে না। আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরোধ থাকলে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমাদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজনদের থাকতে পারে। তার জন্য কি আমার স্বামীকে চিরতরে পঙ্গু হতে হবে? আমি এমন পৈশাচিক হামলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। বলেই কেঁদে ফেলেন আহত সৈকত খানের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম সোমা। এ ঘটনায় সোমবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ কেউ গ্রেফতার হয়নি। সোমবার দুপুরে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সাবেক পঙ্গু হাসপাতাল) নিচ তলার পোস্টঅপারেটিভ কক্ষে গিয়ে দেখা যায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সৈকত খান (৩৪)। পাশে বসে স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন সোমা। কাঁধ থেকে দুই হাত আর কোমর থেকে দুই পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত মোটা ব্যান্ডেজ করা। একা নড়াচড়া করতে পারেন না। তাকে ধরে তুলতে হয়। চোখে চশমা। চমশার ফাঁক দিয়ে চোখের কোণে কষ্টের কান্না জমে আছে। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতেই যেন আবেগ বিদ্যুত বেগে বেরিয়ে এলো। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বললেন, দেখতেই তো পারছেন কেমন আছি। ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো সকাল সাতটার দিকে উঠে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকি। আমি ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় আন্ডার গার্মেন্টস নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করি। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে শাহআলী থানাধীন দিয়াবাড়ির তুরাগ সিটির ৫ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ি থেকে বের হই। বাড়ি থেকে মাত্র ১০/১৫ গজ সামনেই রাস্তার মাঝ বরাবর পাঁচ যুবক পুরো রাস্তা জুড়ে এলোমেলোভাবে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি বার বার মোটরসাইকেলের হর্ন দেয়ার পরও তারা রাস্তা ছাড়ছিল না। এক ফাঁকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেই তারা আমার মোটরসাইকেল আটকায়। বলে দেখে চলতে পারো না। কেন শরীরে মোটরসাইকেল লাগিয়ে দিয়ে ব্যথা দিলে। প্রকৃতপক্ষে আমার মোটরসাইকেল তাদের কারও গায়েই লাগেনি। এটি ছিল উছিলা মাত্র। এরপর আর কোন কথা নেই। চার কোনা শক্ত কাঠের লাঠি আর লোহার রড দিয়ে আমার পায়ে প্রথমে আঘাত করে। পর পর কয়েকটি আঘাত করার পর আমি পড়ে যাই। মোটরসাইকেলটিও পাশে পড়ে যায়। এরপর তারা আমার দুই হাত আর দুই পা লাঠি আর লোহার রড দিয়ে পেটাতে পেটাতে থেঁতলে দেয়। সকাল থাকায় রাস্তায় লোকজন কম ছিল। আমার চিৎকারে কোন লোকই এগিয়ে আসেনি। এ সময় এক সন্ত্রাসী একজনকে ফোন করে বলে, নাবিল ভাই কাজ হয়ে গেছে। এরপর আরও কিছু কথা বলার পর তারা চলে যায়। আমাকে যখন পেটায়, তখন আশপাশের রাস্তার মোড়ে মোড়ে অনেক যুবক দাঁড়িয়ে ছিল। তারা কেউ এগিয়ে আসেনি। ধারণা করি, তারা সন্ত্রাসী দলের সদস্য। তারা হামলাকারীদের সহযোগী বলে মনে হচ্ছিল। সৈকতের দাবি, নাবিল খানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন বিরোধ বা ঝামেলা নেই। কারণ আমি চাকরিজীবী। আমি কাউন্দিয়ায় থাকি না। আমি তুরাগ এলাকায় থাকি। আমার মামা কাউন্দিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে নাবিলের চাচা কাউন্দিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খানের সঙ্গে বিরোধ থাকতে পারে। তাতে আমার কিছু যায় বা আসে না। কারণ আমি এসবের মধ্যে নেই। তাহলে আমাকে কেন এভাবে মারল। মূলত আপন মানুষকে মেরে মামা বা তার পরিবারকে প্রত্যক্ষভাবে হুমকি দেয়ার জন্যই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা দুই ভাই দুই বোন। আমি সবার বড়। সৈকতের স্ত্রী বলছিলেন, আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমরা পুরো পরিবার নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছি। স্বামীর এমন হামলার ঘটনায় আমার সাত বছরের একমাত্র মেয়ে রুবাইয়াত খান লিরা কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা। আমার দুই বছরের একমাত্র ছেলে সা’দাত। দুধের অবুঝ সন্তানকে বাসায় রেখে আমাকে স্বামীর কাছে থাকতে হচ্ছে। এমন কষ্ট ভোলার মতো নয়। রবিবারের ওই হামলার ঘটনায় ওইদিনই শাহআলী থানায় আহত সৈকতের পিতা মিজানুর রহমান খান বাদী হয়ে মুরাদ, শাহ আলম, সুসময়, মানিক, মেসি, দীপু, রাজু, টগরসহ ১০/১২ জনকে আসামি করে শাহআলী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। আসামিরা শাহআলী থানা লাগোয়া তুরাগ নদের পাড়ে অবস্থিত সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির সাবেক নেতা সাইফুল ইসলাম খানের ভাতিজা নাবিল খানের বন্ধু। নাবিল খানের নির্দেশেই পারিবারিক ও আদর্শের দ্বন্দ্বের জের সৈকতকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়। আহত সৈকত খানের মামা সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শান্ত খান বলেন, সৈকত আমার বড় বোনের ছেলে। সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম খান তার সঙ্গে নির্বাচন করে হেরে যান। এরপর থেকেই তিনি আমার ওপর ক্ষিপ্ত। এছাড়া তিনি বিএনপি করায় আর আমি আওয়ামী লীগ করার কারণে তার সঙ্গে আমার আদর্শিক বিরোধ আছে। সেই বিরোধের জেরে আমার নিরীহ ভাগ্নেকে এমন নির্মমভাবে মারা ঠিক হয়নি। বিরোধ থাকলে আমার সঙ্গে আছে, আমার বোন ভাই বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নিশ্চয়ই নেই। আমার ভাগ্নে রাজনীতি করে না। আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তিনি আরও বলেন, বিএনপির নেতা থাকা অবস্থায় বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের সমস্ত কার্যক্রম জোরপূর্বক বন্ধ করে রেখেছিলেন সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ওই সময়ের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান। ১৯৯৭ সালের ৬ জুলাই কাউন্দিয়া কৃষক লীগ সমাবেশের আয়োজন করে। ওই সময় সাইফুল ইসলাম খানসহ ২০/২৫ জন বন্দুক দিয়ে গুলি চালিয়ে সমাবেশ প- করে দিয়েছিলেন। গুলিতে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছিল। যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। এ ব্যাপারে সাইফুল ইসলাম খানসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে সাভার থানায় মামলা হয়। তার বিরুদ্ধে র‌্যাবের দুই গোয়েন্দা সদস্যকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ওই অভিযোগে ২০১০ সালের মে মাসে সাইফুল ইসলাম খান দুই সঙ্গীসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এছাড়া খাল দখলের সময় প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালানোর দায়ে সাইফুল ইসলাম খানসহ ১৯ জন র‌্যাব-৪ এর হাতে আটক হয়েছিলেন। তাকে জেলও খাটতে হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলাকালে তার বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে একজন নিহত হন। ওই সময় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন শান্ত খান। তার সঙ্গে নির্বাচনে হেরে যান সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান। মূলত এর পর থেকেই বিরোধ তুঙ্গে। তারই জেরে ঘটনাটি ঘটেছে বলে বর্তমান চেয়ারম্যান শান্ত খানের দাবি। এ ব্যাপারে শাহআলী থানার ওসি মোঃ সালাহউদ্দিন মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, চাঞ্চল্যকর এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে।
×