ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবার ভ্যাটের আওতায় গুগল ফেসবুক ইউটিউব

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ২৭ জুন ২০১৯

 এবার ভ্যাটের আওতায় গুগল ফেসবুক ইউটিউব

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানি। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এবং সরকার অনুমোদিত ব্যাংকের মাধ্যমে পেমেন্ট ট্রান্সফারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এই পুরো টাকাটাই যাচ্ছে অবৈধ চ্যানেলে। নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে এই টাকা পরিশোধ হওয়ায় সরকারের কাছে এ বিষয়ে কোন তথ্য নেই। এমনকি এর বিপরীতে কোা রাজস্বও পায় না সরকার। এই অবস্থায় ফেসবুক-ইউটিউবের মতো ভার্চুয়াল জগতে বাংলাদেশ থেকে যেসব বিজ্ঞাপন দেয়া হয়, তা থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সে হিসেবে বছরে ভ্যাট আদায় বাবদ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার পাবে তিন শ’ কোটি টাকা। আগামী ১ জুলাই থেকে এ নির্দেশ কার্যকর করার জন্য বলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বুধবার এক নির্দেশনায় এ তথ্য জানিয়েছে এনবিআর। জানা গেছে, বাংলাদেশে দুই হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বাজার রয়েছে। মূলত প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও ওয়েব এই তিন মাধ্যম ব্যবহার করে টিকে আছে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন বাজার। কিন্তু বর্তমান মোট বিজ্ঞাপনী বাজারের ৬২ শতাংশই আন্তর্জাতিক ডিজিটাল প্লাটফর্মে চলে যাচ্ছে। ’১৮ সাল শেষে তা দ্বিগুণ বেড়ে দু’হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সূত্রমতে, দেশে দ্রুতগতিতে বিস্তার ঘটছে অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্স ও ফেসবুকভিত্তিক এফ কমার্স ব্যবসা। ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুক, টুইটারসহ জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউব ও সার্চ ইঞ্জিন গুগলসহ অনলাইন মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ছে। বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের একেকটি ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে প্রতিমাসে গড়ে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করে। ফেসবুকভিত্তিক বাণিজ্যিক সাইটগুলো তাদের ব্যবসা বাড়াতে প্রতিদিন খরচ গড়ে ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা। অনলাইনে যারা পণ্য বিক্রি করেন এবং যারা বেসিসের সদস্য তারা ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে পারেন। তবে তা খুব সামান্য। বড় বড় কোম্পানি এই লেনদেন করে ডিজিটাল এজেন্সি মাধ্যমে। যারা প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই পরিশোধ করছে হুন্ডির মাধ্যমে। এ বিষয়ে বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ফেসবুক, গুগলের মতো ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন বাবদ ঠিক কত টাকা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে সরকারের কাছে কোন তথ্যই নেই। কারণ এসব পেমেন্ট হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে। এ কারণে কোন রাজস্বও পাচ্ছে না সরকার। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পেমেন্ট বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে যাতে পরিশোধ করা যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে আমরা সরকারের কাছে পৃথক ক্রেডিট লাইন চালুর জন্য আবেদন করেছি। এতে ব্যয়িত অর্থের বিবরণী সম্পর্কে একদিকে যেমন ব্যাংকের কাছে তথ্য থাকবে, তেমনি সরকারও নজরদারি করতে পারবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে পেমেন্ট পরিশোধ হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। সূত্র জানায়, এ বছরের ২৮ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে এ বিষয়ে চিঠি পাঠায় বেসিস। সেখানে তারা বলেছে, ‘ইতোপূর্বে সফটওয়্যার ও আইটিইএস কোম্পানির জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্রয় যেমন- সফটওয়্যার টুলস্, সার্ভার, ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি বাবদ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ব্যয়ের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনুরূপভাবে আরেকটি ক্রেডিট লাইন অনুমোদন করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো আলাদা একটি ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করবে শুধু ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পেমেন্ট পরিশোধের জন্য। এক্ষেত্রে ব্যাংক আবেদনকারীর সামর্থ্য অনুযায়ী ক্রেডিট কার্ডের ক্রেডিট লিমিট নির্ধারণ করে দেবে। জানা গেছে, গত বছরের ৪ এপ্রিল এনবিআরের সম্মেলন কক্ষে সংবাদপত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও এ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (এ্যাটকো) পক্ষ থেকে ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগলকে করের আওতায় আনার কথা বলা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটে এটি কার্যকর করার আশ্বাস দেয় এনবিআর। এর আগে গত বছরের এপ্রিলে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবের মতো ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ থেকে দেয়া বিজ্ঞাপনের লেনদেন থেকে সব ধরনের রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেশ হাইকোর্ট। এর প্রেক্ষিতে এই ভ্যাট আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে গত ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি চিঠি দিয়েছিল এনবিআর। পরে গত সোমবার এনবিআরের নির্দেশ যথাযথ অনুসরণ করতে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো অবশ্য জানাচ্ছে, বাংলাদেশে ব্যবসারত কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি যদি বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞাপন দিতে চায় তাহলে বিজ্ঞাপন দেয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক। ২০১৫ সালে এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে বলা হয়, বিদেশী কোন ইলেক্ট্রনিক বা অনলাইন মিডিয়ায় বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সংক্রান্ত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। বিদেশী কোন ইলেক্ট্রনিক বা অনলাইন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচারের এই নির্দেশিকায় ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবের মতো কোম্পানিগুলোকেও ফেলা যায়। তবে এ ধরনের ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপনী পেমেন্ট পরিশোধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে চায় না অনেকেই। তারাই নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রেডিট কার্ড বা হুন্ডির মাধ্যমে ফেসবুক বা গুগলে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করা যাবে না। এটি রোধ করার মতো কারিগরি ক্ষমতাও খুব একটা নেই। ভবিষ্যতে অনলাইন বিজ্ঞাপনের বাজার আরও বাড়বে। তবে সঠিক নজরদারির মাধ্যমে পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। ফলে এ খাতে এখনই সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। গুগল-ফেসবুকে সরাসরি বিজ্ঞাপন দেয় এমন একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের প্রধান মনজুর হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, কম খরচে পণ্যের বিজ্ঞাপন নির্দিষ্ট শ্রেণীর ক্রেতা-দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয় গুগল-ফেসবুক। অথচ ওই অর্থ খরচ করে কোন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া সম্ভব নয়। আর তাতে ভাল সাড়া পাওয়া যায় না। কারণ একজন ক্রেতা বা দর্শক সব সংবাদপত্র ও অনলাইনের পাঠক নন। এদিক থেকে গুগল-ফেসবুক ক্রেতা-দর্শককে বিজ্ঞাপন দেখাতে বাধ্য করে। তিনি বলেন, দেশী প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভোক্তার কাছে পণ্য নিয়ে পৌঁছানো যায়। তবে ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু গুগল-ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়ায় সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজস্ব ও শুল্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গুগল ও ফেসবুক চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশেও এমন চুক্তি করা গেলে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পাবে সরকার। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত অর্থ পরিশোধ প্রক্রিয়া কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে অপব্যবহারই হচ্ছে বেশি। ক্রেডিট কার্ড, রেসিডেন্স ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) কার্ড, ফরেন কারেন্সি রেমিটেন্স কোটার মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের বরাবর আবেদন করতে হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা বিজ্ঞাপনী এজেন্সিকে। আবেদনসমূহ মুদ্রানীতি বিভাগ কেস টু কেস ভিত্তিতে বিবেচনা করে অনুমোদন দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনপত্রে স্পষ্টভাবে বিদ্যমান বিধিবিধান অনুযায়ী ট্যাক্স, ভ্যাট কর্তন/পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করে রেমিটেন্স আকারে টাকা পাঠানোর অনুমোদন প্রদান করে। তবে এসব নিয়মকানুন মেনে অনলাইন মার্কেটিংয়ের লেনদেন পরিশোধ করতে আগ্রহী নয় এজেন্সিগুলো।
×