ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জল ছুঁয়ে থাকা লম্বা ঝুলন্ত মঞ্জরি, অনিন্দ্য সুন্দর ফুল

প্রকাশিত: ১১:২৮, ২৬ জুন ২০১৯

জল ছুঁয়ে থাকা লম্বা ঝুলন্ত মঞ্জরি, অনিন্দ্য সুন্দর ফুল

মোরসালিন মিজান ॥ হিজলের কথা লিখতে গিয়ে ভাটিবাংলা সুনামগঞ্জের কথাই আগে মনে পড়ছে। জেলার তাহিরপুরে একাধিক হাওড়। হাওড় মানে, বিপুল জলরাশি। ভরা বর্ষায় হাওড়ের বুকে ঢেউ তুলে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যায় ইঞ্জিনের নৌকা। নৌকা থেকে চারপাশে তাকালে থৈ থৈ জল দেখা যায়। আর দেখা যায় হিজল গাছ। হাওড়ের জল ছুঁয়ে থাকা গ্রামগুলোকে এই গাছ চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে। দেখে মনে হয় পরিকল্পিত সবুজ বাগান। বাড়ির পেছনের দিকে বড় হতে থাকা হিজলের ঝুলন্ত মঞ্জরি বর্ষার নয়া পানিকে যেন ডেকে আনে। স্পর্শ করতে চায়। ঘাটে নৌকা লাগতেই স্বাগত জানায় যে ফুল, সেটিও হিজলের। স্থানীয়দের খুব চেনা এবং উপকারী গাছটি শুকনো মৌসুমেও দিব্যি থাকে। হাওড়ের পানি সরে যাওয়ার পর নতুন চেহারা পায়। চাষযোগ্য জমির আইলের ওপর, পায়ে হাঁটা পথের ধারে দৃশ্যমান হয় হিজল গাছ। তবে কালক্রমে গাছটি হারিয়ে যেতে বসেছে। যারপরনাই দুুর্লভ এখন। গ্রামেও আগের মতো দেখা যায় না। তবে অনেকে জেনে অবাক হবেন, রাজধানী ঢাকায় আছে হিজল গাছ। শিল্পকলা একাডেমির সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে বেশ কিছু গাছ লাগানো হয়েছিল। অনেকদিন আগের কথা। এখন ভরপুর প্রাণ। এই শুকনো, জ্বলতে থাকা, পুড়তে থাকা শহরে কী করে বেঁচে আছে প্রিয় হিজল? ভেবে অবাক না হয়ে পারা যায় না। অবশ্য হিজলের প্রাণশক্তি অনেক বেশি। বিধ্বংসী বন্যা কিংবা তীব্র খরাও কুপোকাত করতে পারে না। বরং অন্যের যতœ ছাড়াও বাঁচতে পারে। জল এবং স্থল দুই জায়গাতেই সাবলীল। মঙ্গলবার একাডেমির হিজল গাছের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, বেশ আছে এরা। রাজধানীর প্রকৃতি পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। অন্য অনেক গাছের পাশে থেকেও বৈশিষ্ট্য হারায়নি। ম্লান হয়নি। বরং নিজের জাত চেনাতে সীমানা প্রাচীর টপকে বাইরে ফুটপাথের ওপর এসে আছড়ে পড়েছে লম্বা মঞ্জরি। প্রসঙ্গ উঠতেই শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বললেন, এই চত্বরে হিজল গাছ দেখে অনেকেই অবাক হন। বহু লোকগানে, গীতিকায়, কবিতায় গাছটির কথা আছে। শিল্পীরা গান গাওয়ার সময়ও হিজলের নাম নেন। তবে তাদের বড় একটি অংশ এ গাছ চেনে না। একাডেমি প্রাঙ্গণে লাগানোর ফলে সবার চেনার সুযোগ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। শিল্পকলা একাডেমির হিজল দেখে অনুমান করা যায়, ঢাকায় এ গাছ আরও আছে। নদীমাতৃক দেশ যেহেতু, অন্যান্য অঞ্চলেও কম বেশি চোখে পড়ে। তবে হিজলের আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারত। সাধারণত পানি বা কাদাজলে জন্মাতে দেখা যায়। মাঝারি আকারের গাছ। ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত উপরে ওঠে। মাটির কাছাকাছি থেকে ডালপালা চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। হিজল একইসঙ্গে নিচুল, জলন্ত, নন্দীক্রান্ত নামে পরিচিত। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা থেকে জানা যায়, হিজল দীর্ঘজীবী গাছ। এর ঝুলন্ত মঞ্জরি ৬ থেকে ১৫ ইঞ্চি লম্বা হয়। মঞ্জরির পুরোটাজুড়ে ক্ষুদ্র কিন্তু অনিন্দ্য সুন্দর ফুল হয়। বহুপৌষ্পিক ফুলের বৈশিষ্ট্যে হিজল অনন্য বলে মনে মত দিয়েছেন তিনি। হিজলের লাল ও গোলাপি রঙের ফুল মুগ্ধ করে রাখে। সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ফুল হয়। গভীর রাতে ফোটে। সকালে ঝরে যায়। ফুলের ঘ্রাণটাও বেশ মিষ্টি। বাতাসে দুলতে থাকা ফুলে মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। তারও বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন শিল্পী সাহিত্যিক ও কবিরা। বহু পুরনো রচনায় হিজলের উল্লেখ পাওয়া যায়। মৈমনসিংহ গীতিকার এক জায়গায় হিজল এসেছে এভাবেÑ পাষাণে বান্ধিয়া হিয়া বসিল শিওরে।/নিদ্রা যায় নদীয়ার ঠাকুর হিজল গাছের তলে...। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন: প্রাণে তার ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো;/একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো...। শেষ করা যাক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বেদনাবোধের কথা জানিয়ে। খুব বিখ্যাত একটি গানে দুঃখ করে মহান গীতিকার সুরকার লিখেছেন: হাওড়ের পানি নাইরে হেথায়/নাইরে তাজা মাছ/বিলের বুকে/ ডানা মেইলা/ নাইরে হিজল গাছ...। সত্যি নাই হয়ে যাচ্ছে হিজল গাছ। শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়া গাছটিকে, অনিন্দ্য সুন্দর ফুলটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সচেতন উদ্যোগ প্রয়োজন। একটু সচেতন কি আমরা হতে পারি না?
×