ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানব পাচারে অর্থনীতির অশনি সঙ্কেত

অবৈধভাবে চলে যাচ্ছে কোটি কোটি ডলার

প্রকাশিত: ১০:৫০, ১৪ মে ২০১৯

  অবৈধভাবে চলে যাচ্ছে কোটি কোটি ডলার

ফিরোজ মান্না ॥ অবৈধ মানবপাচারে বছরে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে এক হিসাবে উঠে এসেছে। বৈধপথে কর্মসংস্থান যত কমবে-অবৈধ পথে বাজারটির পরিধি তত বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৬ হাজার মানুষ অবৈধ পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। এই হিসাব ইউএনসিআর নামের একটি সংগঠনের। তবে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিউনিসিয়ার উপকূলে ৩৭ বাংলাদেশীর মৃত্যুর খবর বিশ্বব্যাপী নাড়া দিয়েছে। কিন্তু এ রকম ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। কোন কোন ঘটনার খবর পাওয়াই যায় না। ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সিনিয়র গবেষক ও ইউল্যাবের অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন সিকদার তার গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে তিউনিসিয়ার উদ্দেশে একটি প্রতিনিধি দল সোমবার সকালে ঢাকা ছেড়েছেন বলে জানা গেছে। তারা সেখানে কতজন জীবিত আছেন আর কতজন মারা গেছেন তাদের খোঁজ-খবর নেবেন। মৃতদের লাশ কিভাবে দেশে আনা যায় এ বিষয় নিয়েও কথা বলবেন। জীবিতদেরও দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। জালাল উদ্দিন সিকদার তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, ইউরোপের বাজারে প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চলে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার বাজারে যাচ্ছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিশাল টাকা পাচার হচ্ছে। মানুষকে যেমন পাচার করা হয় একইভাবে টাকাও চলে যায়। ১০ টায়ারে বিদেশে দালাল চক্র মানবপাচার করে। প্রথমত গ্রাম থেকে লোক সংগ্রহ করা। লোক সংগ্রহ হলে তাদের সেন্টার পয়েন্ট ঢাকাতে নিয়ে আসা। এখান থেকে বিভিন্ন দেশের দালাল চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। তারপর তাদের একটি দেশে নিয়ে আটক রাখা হয়। সেই সংশ্লিষ্ট দেশে কিছু দিন বন্দী জীবন-যাপন করেন। দালালরা তাদের কাছ থেকে আরও টাকা দাবি করে। প্রথমে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে প্রলোভনে পড়ে দালালের হাত ধরে পাড়ি জমায় লিবিয়া, ইরাক, তিউনিসিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে। বাড়তি টাকার জন্য বাবা-মা কিংবা আত্মীয় স্বজনদের কাছে ফোন করে আরও বড় অঙ্কের টাকা আদায় করে নেয়। যারা বাড়তি টাকা দেন তাদের নৌকায় তোলা হয়। সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ নিয়ে যায়। সেখানেও দালাল চক্র রয়েছে। তারা তাদের রিসিভ করে। এভাবে একটা চেইন কাজ করে। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়েও যে তারা চাকরি পান তা কিন্তু না। সেখানেও তারা নির্যাতনের শিকার হন। সেখানেও বাড়তি টাকা দিতে হয়। তা না হলে দাস হিসেবে থাকতে হয় তাদের। সাগর পথে উন্নত জীবনের আশায় যারা ইউরোপ পাড়ি দেন তাদের কারও ভাগ্য ভাল হলে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে পারেন। তবে অনেকেরই বিধিবাম। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায় প্র্রতিদিন গড়ে ছয়জন করে মানুষ মারা যাচ্ছে। অবৈধপথে মানবপাচারের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঘটছে মালয়েশিয়াতে। প্রতিদিন কয়েক শ’ মানুষ সাগরপথে পাড়ি জমাচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসন মনে করেন, যেভাবেই যাক তবুও তারা গেছে তো। এক সময় রেমিটেন্স পাঠাবে। আসলে তারা যে মৃত্যু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে যাচ্ছেন এ বিষয়টি কেউ মনে করছেন না। এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, গত ১০ মে শুক্রবার ভূমধ্যসাগরে ওই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। নৌকাডুবির পর তিউনিসিয়ার জেলে ও নৌবাহিনী ১৬ জনকে উদ্ধার করে। এখনও উদ্ধার অভিযান চলছে। আহতরা বলছেন, বৃহস্পতিবার লিবিয়ার জোয়ারা উপকূল থেকে অন্তত ৭৫ জন রওনা দিয়েছিলেন ইতালির উদ্দেশে। গভীর সাগরে পৌঁছানোর পর বড় নৌকা থেকে তাদের ছোট একটি নৌকায় তোলা হয়। ছোট্ট সেই নৌকাটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যায়। তিউনিসিয়ার নৌবাহিনী ও মৎস্যজীবীরা ১৬ জনকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন। তাদের মধ্যে ১৪ জনই বাংলাদেশের নাগরিক। উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা বলছেন, নৌকাটিতে অন্তত ৫১ জন বাংলাদেশী ছিলেন। আর ছিলেন তিনজন মিসরীয় এবং মরক্কো, সাদ ও আফ্রিকার কয়েকজন নাগরিক। এই হিসাব থেকে অনুমান করা হচ্ছে, অন্তত ৩৭ জন বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। ইউএনএইচসিআর বলছে, লিবিয়া থেকে ইউরোপের যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগরের ওই সমুদ্র পথে এ বছরের প্রথম চার মাসে অন্তত ১৬৪ জন শরণার্থী প্রাণ হারিয়েছেন। লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়াসহ আফ্রিকার নানা দেশের লোকেদের সঙ্গে কেন এভাবে ইউরোপ যাচ্ছেন বাংলাদেশীরা। সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার হার কিছুটা হলেও কমেছে। কারণ, লিবিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীকে অভিবাসী অনুপ্রবেশের ওপর নজরদারি চালানোর দায়িত্ব দিয়েছে ইতালি। ফলে মাঝ সমুদ্রে কোন শরণার্থীদের নৌকা নজরে এলেই সেটিকে আটক করার নির্দেশ পায় লিবিয়ার বাহিনী। কিন্তু এরপরেও চলতি বছরেই অন্তত ১৫ হাজার ৯০০ জন উদ্বাস্তু ইউরোপে ঢুকেছেন বলে জানাচ্ছে ইউএনএইচসিআর। ২০১৮ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার সময় প্রতিদিন গড়ে ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান বলেন, আমরা অনেক সময় খুশি থাকি এই ভেবে যে বিদেশে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। ২০১৭ সালে তো নতুন রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। ওই বছর ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন বাংলাদেশী চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। আবার সে বছরেই ৫ মে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট একটি সংবাদ প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ ইজ নাও দ্য সিঙ্গেল বিগেস্ট কান্ট্রি অব অরিজিন ফর রিফিউজিস অন বোটস এ্যাজ নিউ রুট টু ইউরোপ এমারজেস’। ওই সংবাদে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথ পাড়ি দেয়াসহ ইউরোপে কিভাবে অবৈধ বাংলাদেশীরা প্রবেশ করছে, তার তথ্য তুলে ধরা হয়। সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে বা অবৈধভাবে বাংলাদেশীরা যেমন ইউরোপে প্রবেশ করছেন, তেমনি দেশটিতে গিয়ে আশ্রয় চাওয়ার সংখ্যাও কম নয়। ইউএনএইচসিআর’র তথ্যে গত এক দশকে অন্তত এক লাখ বাংলাদেশী ইউরোপে আশ্রয় চেয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৮ হাজার আশ্রয় চেয়েছেন ২০১৫ সালে। আগের বছরগুলো ধরলে এই সংখ্যা লাখ দেড়েক হয়ে যাবে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ প্রবেশ করেছেন, সেই তালিকার শীর্ষ দশ দেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রায়ই বাংলাদেশও থাকছে। চলতি বছর ওই তালিকায় থাকা শীর্ষ দেশগুলো হলোÑ আফগানিস্তান, গায়েনা, মরক্কো, সিরিয়া, মালি, ইরাক, ফিলিস্তিন, আইভরি কোস্ট এবং সেনেগাল। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের নাগরিকরা কেন আফ্রিকা বা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিকদের সঙ্গে এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছেন। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাট-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশী ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্প্রতি তরুণদের মধ্যে একটি জরিপ করেছে, তাতে দেখা গেছে আরও ভাল জীবন-যাপন এবং পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণই নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। এসব তরুণ মনে করেন না যে, নিজের দেশে তাদের ভবিষ্যত আছে। তাছাড়া এমনিতেই বাংলাদেশীদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ভয়াবহ। এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রনৌক জাহান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অবৈধ পথে কর্মী যাতে বিদেশ না যান তার জন্য ৬৪ জেলার ৪৯০ উপজেলায় সচেতনার কাজ করে যাচ্ছি। এরপর মানুষ কেন যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। এটা কিভাবে রোধ করা যাবে। এটা তো কোন নিয়মের মধ্য দিয়ে হচ্ছে না। এরপরও আমরা এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করার। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত চার দশকে এক কোটি বাংলাদেশী চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। আর এদের ৭৫ শতাংশই গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু অবৈধভাবে কত লোক বিদেশে যান তার কোন হিসাব বাংলাদেশের কোন দফতরে নেই। তবে এক যুগেরও বেশি সময় অভিবাসন ও মানবপাচার বিষয় নিয়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখেছি, সংখ্যাটি নেহাতই কম নয়। শ্রম ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন বলেন, ইরাক, লিবিয়া, তিউনিসিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার একটা চেষ্টা কিন্তু সবসময় পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশীরা কখনও বৈধভাবে কাজ করতে অথবা অবৈধভাবে গিয়ে এই মৃত্যুযাত্রায় পা বাড়ায়। সমুদ্র যাত্রার নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রতি তিনজনে একজন করে মারা যায়। মূলত এরা সবাই কর্মের সন্ধানে এই মৃত্যুযাত্রায় পা বাড়ায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যারা ইউরোপ যেতে চায় তাদের মধ্যে বেশির ভাগই দুবাই-এর ভিসা নিয়ে দুবাই গিয়ে সেখান থেকে নতুন টিকেট করে ইরাক যায়। তারপর দালালরা ইউরোপ পাঠানোর জন্য বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে। এর মধ্যে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর দিয়ে নৌকায় করে ইতালি কিংবা ইউরোপ যাওয়াকে কম খরচ বিধায় সেই রুটটাকে বেশি ব্যবহার করে। ইরাক বর্তমানে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার একটা হাবে পরিণত হয়েছে। এতে আমাদের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত। দেশে তরুণদের কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান তৈরি করাসহ জনশক্তি প্রেরণের সক্ষমতা বাড়িয়ে এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। বিদেশ গমন ইচ্ছুক কর্মীদের সচেতন করতে হবে। যাতে কেউ অবৈধভাবে সমুদ্রযাত্রায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে না যায়।
×