ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

খোঁড়াখুঁড়ির শেষ নেই ॥ সমন্বয়ের অভাব

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ১৪ মে ২০১৯

খোঁড়াখুঁড়ির শেষ নেই ॥ সমন্বয়ের অভাব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট থেকে রামপুরামুখী সড়কের কিছু অংশে ড্রেনেজ নির্মাণ কাজ চলছে প্রায় দুই মাসের বেশি। এ কাজের জন্য সড়কে রাখা হয়েছে ইট, বালু, পাথরসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী। সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু কাজ যেন শেষ হওয়ার নয়। চলছে তো চলছেই। এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরাও বলছেন, পর্যাপ্ত জনবল পেলে চলমান এই নির্মাণকাজ সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কবে শেষ হবে এর সঠিক কোন ব্যাখ্যা কারো কাছে নেই। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটিতে যানজটের ভোগান্তি বেড়েছে অনেক বেশি। খিলগাঁও কিংবা কাকরাইল থেকে আসা যানবাহনগুলোতে প্রতিদিনই যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে। দুই মিনিটের সড়ক পাড়ি দিতে সময় লাগছে ঘণ্টারও বেশি। এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনসহ যাত্রীরা ক্ষোভ জানিয়েছেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কিছু সড়কে আছে উন্নয়ন ভোগান্তি। মাসের পর মাস চলছে সমন্বয়হীন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি। অন্যদিকে ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি আয়ের আশায় রাজধানীতে বেড়েছে ভাসমান মানুষের চাপ। বেড়েছে গাড়ি। এমনিতেই সর্বোচ্চ তিন লাখ গাড়ি চলতে পারে এই শহরে। কিন্তু বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিআরটিএ নিবন্ধিত পরিবহনের সংখ্যা ১৪ লাখ ১০ হাজারের বেশি। এর বাইরে ১০ লাখের বেশি রয়েছে অযান্ত্রিক পরিবহন রিক্সা। যা নিবন্ধনের বাইরে। তাছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, রিক্সা, হিউম্যান হলার, ভেসপাসহ অন্যান্য অনিবন্ধিত পরিবহন তো আছেই। সব মিলিয়ে বাড়তি মানুষ, বাড়তি গাড়ি ও বাড়তি পরিবহনে ঢাকার সড়কে ভোগান্তির মাত্রা একেবারেই বাড়িয়ে তুলেছে। শনিবার ছুটির দিনেও রাজধানীর মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, বসুন্ধরা, কাওরানবাজার, পান্থপথ, ধানমন্ডি, মগবাজার, শাহবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেট, আসাদগেট, শ্যামলী, মিরপুর, গুলশান, বাড্ডা, শাহজাদপুর, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে সকালের পর থেকে যানজট দেখা যায়। কোথাও একটু কম কোথাও বেশি। দুপুরের পর থেকে যানজটের মাত্রা আরও বেশি বাড়তে থাকে। মৌচাকের সামনে ফরচুন শপিংমল গেটে নিয়মিত রিক্সার আড্ডা। মূলত মার্কেটের ক্রেতারাই এসব রিক্সায় বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করে থাকেন। মগবাজারের আমবাগানের বাসিন্দা শরিফ মিয়া এই এলাকায় রিক্সা চালান ১৫ বছরের বেশি। তিনি জানান, রমজান শুরুর কয়েকদিন আগে থেকে মৌচাক এলাকায় নতুন রিক্সাচালক দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে রিক্সার ভিড়। তিনি জানান, প্রতিদিন আমাদের নিয়মিত রিক্সাস্ট্যান্ডে নতুন মানুষ দেখা যাচ্ছে। বাড়তি আয়ের আশায় ভাসমান মানুষ প্রতি বছরে ঈদের এক মাস ঢাকায় আসেন বলে জানান তিনি। বলেন, এখন রিক্সার প্রতিটি গ্যারেজে বাড়তি মানুষের ভিড় দেখা যায়। মগবাজার এলাকায় অন্তত ২০টি গ্যারেজে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। বাড়ছে রিক্সার জমাও। এ রকম নতুন মুখের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। নাম আলতাফ। এসেছেন রংপুর থেকে। তিনি জানান, ঢাকা শহরে এবারই প্রথম। ঢাকায় তার মামা রিক্সা চালান। তাই তাকে এবার আনা হয়েছে। আলতাফ বলেন, পথ না চিনলেও গাড়ি চালাতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। যাত্রীরা চিনিয়ে নিয়ে যান। ভাড়াও পাওয়া যাচ্ছে বেশ। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে তার আরও দুই ভাইকে আনবেন রিক্সা চালানোর জন্য। বিআরটিএ কর্মকর্তাসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে রাস্তা অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিন লাখ যান চলাচল করতে পারে। অপরিকল্পিত যানবাহনের নিবন্ধন দেয়ায় রাজধানীসহ সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। তেমনি নানা উদ্যোগের পরও সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত শহরে রাস্তা অনুযায়ী কত যানবাহন চলতে পারবে, সেই হিসাব করে নিবন্ধন দেয়া হয়। একটি গাড়ি নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত অন্যজন নতুন গাড়ি নামানোর অনুমতি পান না। কিন্তু আমাদের দেশে এ রকম কোন কিছুই দেখা যায় না। যে কেউ ইচ্ছা করলেই গাড়ি নামানোর সুযোগ পাচ্ছেন। দিব্যি পাচ্ছেন বিআরটিএর নিবন্ধনও। যানজট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক বলেন, রাজধানীতে বিআরটিএ যেভাবে গাড়ির নিবন্ধন দিয়েই যাচ্ছে তা অবৈজ্ঞানিক। ঢাকায় যত গাড়ি চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এর মাধ্যমে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে কোন সমন্বয় থাকছে না, তাই যানজট বাড়ছেই। লোকজন ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে তখনই ছুটছেন যখন তারা গণপরিবহনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। গণপরিবহন উন্নত হলে ব্যক্তিগত গাড়ির এত চাহিদা থাকত না। এতে যানজট কিছুটা হলেও কমত। এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এমন পরিস্থিতি থেকে একদিনে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এজন্য কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। বছরে কি পরিমাণ যোগান আছে সে অনুসারে গাড়ির নিবন্ধন করাতে হবে। যানবাহনের ঢালাও নিবন্ধন করতে দেয়া যাবে না। গণপরিবহনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সড়কে চলতে লোকজন যখন বিকল্প গণপরিবহন বা অন্যান্য যানবাহন পাবেন তখন গাড়ি কিনতে নিরুৎসাহিত হবেন। এ সম্পর্কে বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলেন, একটি শহরে যেখানে যানবাহনের চলাচল ও ব্যবস্থাপনার জন্য ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সড়ক দরকার সেখানে ঢাকায় আছে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। ফলে যানজট হবে এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় লোকজন সড়কের ওপরই গাড়ি রাখছেন, যা যানজট বেড়ে যাওয়ার বড় একটি কারণ। রাজধানীর কলেজগেটের পুরো রাস্তায় থেমে থেমে চলছে গাড়ি। একটার সঙ্গে আরেকটা গাড়ি প্রায় লাগানো। কলেজগেট থেকে পান্থপথ স্বাভাবিক সময়ে বাসে ২০ মিনিট লাগলেও শনিবার দুপুর ১২টায় এই রাস্তাটুকু পার হতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। তার সঙ্গে রয়েছে অসহনীয় গরম। এমনিতেই যানজটের শহর হিসেবে বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ঢাকা। শুধু তাই নয়, সময় অপচয় ও ট্রাফিক অদক্ষতা সূচকেও শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও এর প্রকাশ করা ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯তে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৮ ও ২০১৭ সালে যানজটে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। রুদ্র সোহেল শনিবার মিরপুর থেকে বেলা ১১টায় রওনা দিয়ে সোবহানবাগ পৌঁছান ১টায়। সায়েন্সল্যাব যাওয়ার কথা থাকলেও বাসের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি নেমে পড়েছেন সোবহানবাগে। রাস্তা পার হয়ে ফিরতি গাড়িতে বাসায় ফিরবেন। তিনি বলেন, ‘পুরো পথেই রাস্তার দুপাশে যানবাহন থেমে থেমে চলছে। ঈদের কেনাকাটা অনেকেই রোজার শুরুতেই সেরে ফেলতে চান। তাই বলে এই অবস্থা হবে কে ভেবেছিল?’ ঠিক কবে নাগাদ স্বস্তির বৃষ্টি আসবে সেই আগাম বার্তা দিতে পারেনি আবহাওয়া অধিদফতর। তারা বলছে, রাজধানীসহ দেশের অনেক অঞ্চলে তাপপ্রবাহ চলছে। গত চার দিন ধরে দেশে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ শাহিনুল ইসলাম। তাদের হিসেবে ৩৬-৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু, ৩৮-৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসকে মাঝারি এবং ৪০ ডিগ্রী ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ। আজ রবিবার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছে আবহাওয়া দফতর থেকে। তবে কঠোর রোদ্রের মধ্যে নগরবাসীর একদিকে যানজটের ভোগান্তি অন্যদিকে উন্নয়ন বিড়ম্বনা। সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস ওঠেছে ঢাকার মানুষের। উন্নয়ন ভোগান্তি পথে পথে ॥ ঢাকা সিটির উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সব খানেই এখন উন্নয়ন ভোগান্তি চলছে। বর্ষা সমাগত। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে চলমান উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। একদিকে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটিএসহ চলমান বিভিন্ন মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এসবের ভোগান্তির সঙ্গে এবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, বিটিসিএল, বিদ্যুত বিভাগসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার কাজ বর্তমানে চলমান। তবে বেশিরভাগ সড়কে সিটি কর্পোরেশনের ড্রেন উন্নয়ন কাজ চলছে। কথা ছিল যেসব এলাকায় উন্নয়ন কাজ হবে সেখানে সাইনবোর্ডে কত দিনের মধ্যে ভোগান্তি শেষ হবে তা প্রদর্শন করা হবে। কিছু এলাকায় উন্নয়ন কাজ চলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সাইনবোর্ড দেখা গেলেও কবে শেষ হবে তা জানেন না নির্মাণ শ্রমিকরাও। শাহজাহানপুর থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত মূল সড়কটি প্রায় ১ মাসের বেশি সময় ধরে কেটে রাখা হয়েছে। বনশ্রী, খিলগাঁও, গোড়ান, মাদারটেক, সবুজবাগ, মুগদা, তিলপাপাড়ার লাখ লাখ মানুষের চলাচল এই পথ দিয়ে। অথচ প্রায় ১ মাসের বেশি সময় পাইপ বসানোর জন্য রাস্তাটির অর্ধেক অংশ কেটে রাখা হয়েছে। ঢিলেঢালাভাবে পাইপ বসানোর কাজ শেষ হলেও এখনও কাটা রয়েই গেছে সড়কটি। ফলে একাংশ দিয়ে কোনরকম যানবাহন চলাচল করছে। এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। খিলগাঁও থেকে দৈনিক বাংলা যাওয়ার পথে ১০ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা। এই বিড়ম্বনার ফলে খিলগাঁও রেলগেট থেকে দৈনিকবাংলা, গুলিস্তান, পল্টন, প্রেসক্লাব অভিমুখে হেঁটেই রওনা করতে দেখা গেছে অনেককে। ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কটিও কেটে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এখানেও বড় বড় পাইপ বসানোর কাজ চলছে। রাস্তাটির অর্ধেক অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে না। বাকি অর্ধেক রাস্তা দিয়ে ধীরগতিতে যানবাহনগুলো চলছে। ফলে যানজটেরও সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে এই সড়কে চলছে মেট্রোরেলের কাজ। ফলে মতিছিল থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন অংশে রাস্তা কাটা হয়েছে। কেটে রাখা হয়েছে পুরান ঢাকার রথখোলা সড়কটি। রায়সাহেব বাজার মোড় থেকে রথখোলা পুরো সড়কটিই কেটে রাখা হয়েছে। ড্রেনের জন্য পাইপ বসানোর কাজ চলছে সেখানে। রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে সিপাহিবাগ, দক্ষিণ মেরাদিয়া, ভুঁইয়াপাড়া, বনশ্রী, গোড়ানসহ বিভিন্ন এলাকায়। দিলু রোডসহ মগবাজারের আশপাশের অলিগলিসহ অনেক সড়ক কাটাছেঁড়া চলছে অনেকদিন। মগবাজার থেকে মৌচা-বাংলামোটর পর্যন্ত বিভিন্ন সেবা সংস্কার কাজ চলমান। কোথাও কাজ শেষ হলেও রাস্তা সংস্কার হচ্ছে না। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, বেশ কিছু এলাকায় রাস্তার কাজ চলমান রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে মেট্রোরেলের জন্য বাংলামোটর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কে রাস্তার কাজ চলছে। আর যেসব এলাকায় কাজ চলছে, সেগুলো জুনের আগেই শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আশা করছি, তা শেষ হবে। তবে নতুন করে কোন প্রতিষ্ঠানকে রাস্তা কাটার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। বর্ষার আগে কাজ শেষ করা হবে।
×