ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস আজ ॥ প্রতি জেলায় ‘সিনেপ্লেক্স’ শুধু কাগজে-কলমে

হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, মধুময় স্মৃতির অধ্যায়...

প্রকাশিত: ১০:৫০, ৩ এপ্রিল ২০১৯

হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, মধুময় স্মৃতির অধ্যায়...

সমুদ্র হক ॥ হলে গিয়ে সিনেমা দেখা- নিকট অতীতের মধুময় স্মৃতির অধ্যায় হয়ে আজ দেশে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস উদযাপিত হচ্ছে। সাত বছর আগে ২০১২ সালে ৩ এপ্রিলকে এই দিবস ঘোষণা করা হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কল্যাণে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার (এফডিসি) যাত্রা শুরু। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই বছর প্রাদেশিক সরকারের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন বিল উত্থাপন করেন। ৩ এপ্রিল ১৯৫৭ বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। এরপর ঢাকার তেজগাঁয়ে নির্মিত হয় এফডিসি। একই বছর ঢাকায় প্রথম নির্মিত হয় আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত ছবি মুখ ও মুখোশ। পঞ্চাশের দশকে এই দেশে ভারতীয় ছবি, হলিউডের ইংরেজী ছবি ও পাকিস্তানী ছবির অবাধ প্রদর্শন ছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে ঢাকা এফডিসি থেকে নির্মিত অনেক ভাল ছবি নির্মিত হয়। দর্শকরা গ্রহণ করে। ষাটের দশকের শুরু থেকে সত্তরের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত নি¤œবিত্ত অর্থাৎ সকল শ্রেণীর মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল সিনেমা। সিনেমা দেখার কথা উঠলেই বলা হতো ‘চলো বই দেখে আসি’। সেদিনের সিনেমার গল্পের বুনন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে সিনেমা মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যেত। গল্পই ছিল ছবির প্রাণ। চলচ্চিত্র ছিল বিনোদনের সঙ্গে ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও সমাজ সংস্কারের বড় মাধ্যম। আজ তা নিকট অতীত। আশির দশকের শেষভাগ থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে একটু একটু করে ঘুনপোকা ঢুকতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে তার ব্যপকতা পায়। সিনেমা প্রেমী দর্শকরা সিনেমাহল বিমুখ হতে শুরু করে। ১৯৯০ সালে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১৪৩৫টি। বর্তমানে এই সংখ্যা ১৭৪। যা টিকে আছে তা অনেকটা লাইফ সার্পোটের মতো। মালিক এই সার্পোট খুলে নিলে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। সিনেমা হল ভেঙ্গে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শপিং মল। এরই মধ্যে হাতে গোনা কিছু ছবি দর্শকদের সিনেমাহলমুখী করছে ঠিকই তবে সিনেমা হলের পরিবেশ অচলায়তন দর্শককে টানতে পারছে না। বর্তমানে কার্বনের বড় প্রজেক্টরে ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মের কয়েকটি রিলে ছবি প্রদর্শিত হয় না। এখন ল্যাপটপে চিপস ডিভাইজ বা পেন ড্রাইভে মাল্টিমিডিয়ায় ডিজিটাল ফর্মেটে বড় পর্দায় ছবি প্রদর্শিত হয়। ছবি নির্মিত হয় হাই ডেফিনেশনের উচ্চ শক্তির রেজুলশেন ক্যামেরায় ডিজিটাল ফর্মেটে। সম্পাদনা হয় ডিজিটাল ডিভাইসে। ছবি প্রদর্শনের প্রজেক্টর ডিজিটাল প্রযুক্তির। আমদানিকারকগণ যে ছবি আনে তা প্রদর্শিত হয় আরেক ধরনের ই-প্রজেক্টরে। যেখানে ইন্টারনেটে সংযোগ থাকে। নেটের মাধ্যমে আমদানি করা ছবি প্রদর্শন করা হয়। এ জন্য একটি পাসওয়ার্ড থাকে। যা আমদানিকারক নেটের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়। তারপরও সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার দর্শক বাড়েনি। মহানগরী ঢাকায় কয়েকটি সিনেপ্লেক্সে বিশ্বের নানা দেশের ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। সিনেপ্লেক্স পরিবেশ উন্নত থাকায় বর্তমানের তরুণ তরুণীরা মুভি দেখতে যাচ্ছে। বিশ্বের উন্নত মুভি রিলিজ হচ্ছে। সেখানে এ দেশের বর্তমানের হাতে গোনা ভাল ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। সিনেপ্লেক্সে টিকেটের দাম বেশি হওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখনও ভাল সিনেমা হলে (যেখানে উন্নত পরিবেশ এখনও বিরাজমান) ছবি দেখতে যায়। তবে মূল কথা ভালা ছবি। রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রাম, বগুড়া, যশোর, খুলনায় সিনেমা হলের সংখ্যা বেশি ছিল। ঢাকা মহানগরীর আশপাশের ঐতিহ্যের অনেক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। যেমন গুলিস্তান। যা শুধু অতীত। পুরাতন ঢাকায় মুখোমুখি দুই সিনেমা হল মুন ও স্টার। এগুলো বন্ধ। সদরঘাটের রূপমহল আরমানিটোলার শাবিস্তান অস্তিত্বই নেই। নিউমার্কেটের সামনে বলাকা ও মতিঝিলে মধুমিতা এখনও টিকে আছে। এই দুইটি সিনেমা হলে রুচিশীল দর্শকরা আজও যায়। তবে একটাই কথা- ভাল ছবি নির্মিত না হলে কে যাবে হলে ছবি দেখতে! এই কথা মালিক কর্তৃপক্ষের। বগুড়া নগরীর বড় সিনেমা হল ছিল উত্তরা, মেরিনা ও মাধু। তিনটি ভেঙ্গেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মধুবন সিনেমা ধুকে ধুকে চলছে। হলের মালিক রুবেল বলেন, সিনেপ্লেক্স বানিয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখবেন। বগুড়া নবাববাড়ি সড়কে রানার প্লাজা আধুনিক শপিংমলে সিনেপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। চট্টগ্রামে ২০টি সিনেমা হল বন্ধ। যশোরে সিনেমা হল ছিল ২১টি। বর্তমানে ২টি। রাজশাহীতে হারাধনের একটি ছেলের মতো টিকে ছিল উপহার। তাও গত মাসে বন্ধ হয়েছে। খুলনায় ১১টির মধ্যে টিকে আছে ৩টি। রংপুর, দিনাজপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, সিলেটে টিকে আছে একটি করে। নরসিংদী, কক্সবাজার, রাঙামাটি, ঝালকাঠি, পঞ্চগড়সহ কয়েকটি জেলায় সিনেমা হল আর নেই। নিকট অতীতের দৃশ্য- ষাটের দশকের প্রথম ভাগ। সিনেমা হলে ছবি দেখার জন্য দর্শকদের ভিড় লেগেই থাকে। ভাল ছবি হলে টিকেট পাওয়া সহজ নয়। সিনেমা টিকেটেরও কালোবাজারি ছিল। নায়ক নায়িকা পরিচালকের নাম দেখে ভিড় বাড়ত। পরিবারের সদস্যরা সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখত। সে দিনের কত ছবির কত সংলাপ ও গান দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে। আজ এসব শুধুই স্মৃতির এক অধ্যায়। সিনেমা হলের প্রবীণ মালিক বললেন, এখন দর্শক টানার মতো সিনেমা নির্মিত হয় না। কালে ভদ্রে দুই একটি ভাল ছবি নির্মিত হয় তবে তার দর্শক ড্রেস সার্কেল (ডিসি) রিয়ার স্টলের। আগে এফডিসি থেকে বছরে শতাধিক ছবি নির্মিত হয়ে মুক্তি পেত। ছবি ছিল ৩৫ মিলিমিটার (এমএম) ফিল্মের। এফডিসিতে ৩৫ এমএম ফিল্মের নেগেটিভ ও পজিটিভ ফিল্ম প্রসেসর এবং প্রিন্টের ভারি যন্ত্রগুলো এখন অলস পড়ে আছে। কিছু অকেজো। ৬ বছর আগে পূর্ণ দৈর্ঘ্য একটি ছবির ২৮টি প্রিন্ট তৈরি ছিল ৩৫ এমএম ফিল্মের শেষ কাজ। ২০১৬ সালে সরকারের আর্কাইভের জন্য কয়েকটি ছবি প্রিন্ট করে ৩৫ এমএম এর যুগ শেষ হয়ে এসেছে ডিজিটাল রূপালী যুগ। এই ডিভাইসে গতবছর হাতে গোনা কয়েকটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। সুধীজনের কথা- দর্শকদের সিনেমা হলমুখী করতে ভাল ছবি নির্মাণের বিকল্প নেই। সিনেমা হলের পরিবেশও ভাল থাকতে হবে। প্রতিটি নগরী, জেলা শহরে একাধিক সিনেপ্লেক্স এবং প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তত একটি করে সিনেপ্লেক্স নির্মিত হওয়া দরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত আছে, দেশের প্রতিটি জেলায় সিনেপ্লেক্স নির্মিত হবে। আধুনিক শপিং কমপ্লেক্সে বাধ্যতামূলকভাবে একটি করে সিনেপ্লেক্স থাকবে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ।
×