ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কারিগর পিবিআই

অজ্ঞাত লাশ শনাক্তকরণে সাফল্য

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ২৩ মার্চ ২০১৯

 অজ্ঞাত লাশ শনাক্তকরণে সাফল্য

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অজ্ঞাত লাশ শনাক্তকরণে একের পর এক যুগান্তকারী সফলতা আসছে। সেই সঙ্গে অজ্ঞাত লাশ শতভাগ শনাক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য প্রযুক্তিগত রীতিমত বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। এমন সফলতার কারিগর হিসেবে কাজ করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বিদেশ থেকে সরকারের আমদানি করা বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পিবিআই অজ্ঞাত লাশ শনাক্তকরণে একের পর এক সফলতার মুখ দেখছে। প্রযুক্তিটি আরও আধুনিক করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কক্সবাজারে হত্যার পর পুড়িয়ে আলামত নষ্ট করা, টুকরো টুকরো করে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া এবং সর্বশেষ গাজীপুরে খুনের পর এসিড দিয়ে লাশ গলিয়ে দেয়া অজ্ঞাত সেই লাশেরও পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছর পচে গলে যাওয়া আঠারো জন অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। ওইসব ব্যক্তি নিখোঁজ হওয়ার পর থানায় নিখোঁজের জিডি হয়েছিল। সেই জিডিগুলোই এখন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। তাদেরও হয়তো একই স্টাইলে হত্যার পর লাশ যাতে না পাওয়া যায় এজন্য গোপন জায়গায় গুম করে রাখা হয়েছিল। বিশেষ ওই প্রযুক্তি পর্যায়ক্রমে দেশের ৬৪ জেলার পিবিআইয়ের কাছে সরবরাহ করা হবে। ইতোমধ্যেই ১২ জেলায় সরবরাহ করা হয়েছে। আরও ৪০টি জেলায় সরবরাহ করার কাজ চলছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা এবং পিবিআই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে গুপ্তহত্যার পর লাশ পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে দেয়া, এসিডে ঝলসে দিয়ে আলামত নষ্ট করার সঙ্গে জড়িতদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে। লাশ শনাক্ত হওয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই তদন্তে খুনী বেরিয়ে আসবে। খুনীরা একদিন না একদিন ধরা পড়বেই। খুনীদের শাস্তি নিশ্চিত হলে এ ধরনের মর্মান্তিক হত্যাকা-ের ঘটনা স্বাভাবিক কারণেই কমে আসবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার। যার মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ নারী। সে হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে শতাধিক ব্যক্তিকে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়। যাদের দাফন করা হয়, সাধারণত তাদের সম্পর্কে পরবর্তীতে আর কোন তথ্য মেলে না। বিশেষ করে কোন ব্যক্তি আলোচিত না হলে, অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করার পর তার আর কোন হদিসই থাকে না। এসব অজ্ঞাত লাশের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ মানুষই সাধারণ পরিবারের সদস্য। অজ্ঞাত লাশের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ নদী বা ডোবা বা নর্দমা বা ঝোপঝাড় বা পঁচা খাল বা বিল, হাজামজা বড় বড় পানায় ভর্তি পুকুর থেকে পাওয়া যায়। অজ্ঞাত লাশ কোন সময়ই মাটি চাপা দিয়ে বা গর্ত করে পুঁতে রাখার নজির নেই। কারণ গন্ধ হওয়ার কারণে কুকুর বা শিয়ালে মাটি খুঁড়ে বের করে ফেলে। এজন্যই হত্যার পর লাশ সাধারণত গুম করতে এমন জায়গায় ফেলা হয়, যেখানে পানি থাকে। কারণ পানিতে লাশ পচে যায়। পচে যাওয়ার কারণে কোন প্রাণী দুর্গন্ধে সেখানে যায় না। এদের অধিকাংশই হত্যার শিকার। আবার অনেকে পানিতে পড়ে মারা যান। নৌ বা লঞ্চ ডুবিতে তাদের মৃত্যু হয়। তাদের পরিচয় আর কখনই মেলে না। কারণ যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে, সেখান থেকে অনেক ভাটিতে কয়েক দিন পর লাশ ভেসে ওঠে। আবার অনেক লাশ মাছে বা জলজ প্রাণী খেয়ে ফেলে। অনেক সময় তাদের হাড়গোড় উদ্ধার হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের আর পরিচয় মেলে না। তাদেরও অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘ দিন পরে হলেও অজ্ঞাত লাশের পরিচয় জানার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সফলতা আসছে। দেশের যেসব নাগরিকের সঠিক জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, তাদের আর কোন দিনই অজ্ঞাত লাশ হওয়ার ন্যূনতম কোন সুযোগ নেই। কারণ তাদের সবার তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছে বিশেষ ওই যন্ত্রে। ফলে কোন জাতীয় পরিচয়পত্রধারী ব্যক্তির মৃত্যু হলে এবং তাকে অজ্ঞাত হিসেবে দেখানো হলে মুহূর্তেই তার সঠিক পরিচয় জানা সম্ভব। যন্ত্রটি বহনযোগ্য। ফলে যন্ত্রটি নিয়ে মৃত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা সহজ। শুধু তাই নয়, শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ থাকলে তাও জানা যাবে। এই কর্মকর্তা বলছেন, তবে যাদের পরিচয়পত্র নেই, তাদের সম্পর্কে ওই যন্ত্রের মাধ্যমে তথ্য পাওয়া কঠিন হবে। এজন্য জন্মের পর পরই প্রত্যেক নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। নির্বাচন কমিশনও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। এ সংক্রান্ত আইনও হয়েছে। সরকার অজ্ঞাত হিসেবে আর কাউকে যেন দাফন হতে না হয়, এজন্য পিবিআইকে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। সংস্থাটির জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ খরচ করে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি আমদানি করেছে। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিকে আরও সমৃদ্ধশালী করার কাজ চলছে। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে বিশেষজ্ঞ তৈরির কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই অনেককেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আরও দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি পিবিআই বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তির ব্যবহার করে সারাদেশে অজ্ঞাত হিসেবে পাওয়া ১৮ জনের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ গাজীপুরে পাওনা টাকা দেয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে হত্যার পর লাশ এসিড দিয়ে গলিয়ে দেয়া সেই ব্যক্তির লাশও শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়া ওইসব লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তিই নিখোঁজ ছিল। এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট থানায় নিখোঁজের জিডি দায়ের হয়েছে পরিবারের তরফ থেকে। পরবর্তীতে পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর তদন্তে জানা গেছে, নিখোঁজ ব্যক্তিরা খুন হয়েছেন। পরে ওই নিখোঁজ জিডি খুনের মামলা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। অনেক মামলার খুনী শনাক্ত হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে দেশের প্রতিটি জেলায় থাকা পিবিআইয়ের কাছে বিশেষ এই প্রযুক্তি সরবরাহ করা হবে। প্রাথমিকভাবে দেশের ১২টি জেলার পিবিআইকে দেয়া হয়েছে। আরও ৪০টি জেলার পিবিআইকে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, অজ্ঞাত লাশ শনাক্ত হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে নিহতদের পরিবার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালতের। কারণ অজ্ঞাত খুনের দায়ে কাউকে আর হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে না। লাশের পরিচয় পাওয়ার পর দায়েরকৃত মামলার তদন্ত সহজ ও দ্রুত হয়েছে। ফলে আদালতেও দ্রুত চার্জশীট দাখিল করা হচ্ছে। আদালতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। মামলা জট অনেকাংশে কমে আসছে। যা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বিশিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকন্ঠকে বলেন, অজ্ঞাত লাশ শনাক্ত করার বিষয়ে সরকার ও তদন্তকারী সংস্থার কঠোর সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতে করে নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবার লাশ পেলে ন্যূনতম সান্ত¡না হলেও পাবে। খুন হওয়া ব্যক্তি অজ্ঞাত হলে যেখান থেকে লাশ উদ্ধার হয়, তার আশপাশের মানুষের হয়রানির সম্ভবনা থাকে। লাশ শনাক্ত হলে স্বাভাবিক কারণেই সেটি কমে যাবে। পর্যায়ক্রমে তদন্তে খুনী শনাক্ত হবে। আদালতে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত হবে। খুনীও শাস্তি পাবে। যা বিচার ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ধারা অব্যাহত রাখলে খুনীরাও আর হরহামেশাই খুন করার সাহস পাবে না। অপহরণের পর হত্যা বা হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনা তুলনামূলক কমে আসবে। সার্বিকভাবে সরকারের প্রতি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর মানুষের মধ্যে আস্থা আরও বাড়বে।
×