ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি

সৈয়দ আশরাফের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাই

প্রকাশিত: ১০:২১, ২ মার্চ ২০১৯

 সৈয়দ আশরাফের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাই

আজ আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি মহান সংসদে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে আসতে পেরে। যেখানে মাননীয় সংসদ সদস্য ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে সংসদে একদিন ছিলেন আমার পিতা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সদ্য প্রয়াত আমার বড় ভাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এর চেয়ে গর্বের আর আবেগের জায়গা কি হতে পারে? এই সেই পবিত্র মহান সংসদ যেখান থেকে আমার বড় আপা গণতন্ত্রের মানসকন্যা. আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্লান্ত পরিশ্রম করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলছেন। মাঝে মাঝেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, রাজনীতির প্রতি আগ্রহ, রাজনীতির প্রতি সম্পৃক্ততা কবে থেকে শুরু? রাজনৈতিক পরিবারে আমার জন্ম। আমাদের বৈঠকখানায় দেখতাম বাবার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঁধানো ছবি। একটা ছোট ঘটনার কথা আজ বার বার মনে পড়ছে। সময়টা সম্ভবত ’৭০-এর শেষের দিকে। আমার বাবা, আমার মা ও আমার ছোট বোন আর আমাকে নিয়ে গেলেন বাবার নেতার কাছে। স্থানটা ছিল মধুপুর গড়ের ভেতর। যখন আব্বা তার নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিটিং করছেন, তখন বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলের নেতৃত্বে আমরা দুই বোন বাংলাদেশের ছোট ছোট পতাকা নিয়ে মিছিল করছিলাম আর স্লোগান দিচ্ছিলাম ‘জয় বাংলা’। কতটুকুই বা বুঝি, তবে এটা বুঝতাম আমরা খুব ভাল একটা স্লোগান দিচ্ছি। সম্ভবত সেটাই ছিল আমার সক্রিয় রাজনীতির হাতেখড়ি। তার পর মনে পড়ে ’৭১, ’৭৫ পরে স্বৈরাচারীর দুঃশাসনের সময়, ’৮০-এর দশকের শেষ দিকে মেডিক্যাল কলেজে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সহপাঠী ছাত্রলীগ কর্মী নোমান ভাইয়ের মর্মান্তিক হত্যাকান্ড। কিন্তু মৃত্যু আমাদের ভয় পাওয়া শেখায়নি। নতুন উদ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে কিভাবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে পরাজিত করতে হয়। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে এবং খানিকটা বৈরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে প্রবাস জীবন কাটিয়েছি। আমি আবার ফিরে এসেছি আমার প্রাণের মাতৃভূমিতে, এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কী হতে পারে! খুব বেশি দিন আগের কথা নয়- প্রবাসে বিদেশী বন্ধুরা বাংলাদেশ বলতে বোঝাত ভারতবেষ্টিত বর্মার পাশে লোকে লোকারণ্য ছোট্ট একটি দেশ। মিলিটারি ক্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর ক্ষুধা, দারিদ্র্য যার নিত্য সঙ্গী। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বে মাথা উঁচু করে বলতে পারি আমি বাংলাদেশের মেয়ে এবং বাংলাদেশের একজন নাগরিক। আজ আমি গর্বিত, উদ্বেলিত এই উন্নয়নের মহাসড়কে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে। আমি কৃতজ্ঞ জাতির জনকের কন্যার প্রতি। আমি কৃতজ্ঞ, আমার নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জ-১ এর জনগণের প্রতি, আমাকে এই মহান সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করে দেয়ায়। আজও আমার স্মৃতিতে জ্ব্ল জ্বল করে ’৭৫ পরবর্তী বিভীষিকাময় বছরগুলোর কথা। ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের ধারাবাহিকতায় জাতির চার নেতার অন্যতম আমার পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আমরা হারিয়েছি। ঢাকা শহরে আমাদের থাকার কোন জায়গা ছিল না। আমার বড় দুই ভাই তখন লন্ডনে নির্বাসিত। এখানে সেখানে মাস কয়েক ঘুরে আমার মা আমাদের চার ভাই বোনকে নিয়ে অবশেষে ময়মনসিংহে চলে গেলেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো, কিন্তু কি অদ্ভুত দেশ, কোন সরকারী স্কুলে আমাদের ভর্তি হতে দেয়া হলো না। কি দোষ করছিলাম আমরা? বাবাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা হতো। মনে পড়ে কেউ একজন আমাকে এবং আমার ছোট বোনকে বুঝিয়েছেন যে, তোমাদের বাবা লুকিয়ে আছে অগণিত নক্ষত্রের মাঝে। মনে পড়ে পরিষ্কার তারা ভরা রাতে আমরা দুই বোন চুপিসারে বাসার ছাদে উঠে চুপি চুপি বাবাকে খুঁজতাম। হয়ত উজ্জ্বলতম তারাটাকে ভাবতাম বাবার প্রতিচ্ছবি। আমরা তাকিয়ে থাকতাম দীর্ঘ সময় নিয়ে। পুরো ব্যাপারটাই যে একটা কল্পনা তা বোঝার বয়স অনেক আগেই হয়েছিল- তবুও ভাল লাগত মিথ্যাটাকে বিশ্বাস করতে। চারদিকের বৈরিতাকে ভুলে থাকার জন্য সেই মিটমিটি অথচ চির উজ্জ্বল তারার আলো আমাদের শান্তি দিত, আশা জাগাত। আমার এই লেখা কিছুটা ব্যক্তিগত অনুভূতির বহির্প্রকাশ এতে সন্দেহ নেই- কিন্তু এটিই আমাদের এবং আমার মতো অসংখ্য শহীদের সন্তানদের মনের কথা, প্রাণের ব্যথা। এই পরিণত বয়সে এসে এখন যখন তারার দিকে তাকাই তখন আর বাবাকে খুঁজে পাই না, মনে হয়, এই তারকাগুলো আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের প্রতিচ্ছবি আর অসংখ্য মা-বোনের আহাজারি। আমি সত্যিই আবেগাপ্লুত যে, এমন একটি মহান সংসদে আসতে পেরেছি, যে সংসদের অনন্য স্থাপত্যশৈলীকে আলোকিত করে রাখে সেই অগণিত শহীদদের জীবনের প্রদীপ যারা- মৃত্যুহীন। এই মহান সংসদে যে আসনের আমি প্রতিনিধিত্ব করছি তা ভেবে কিছু শঙ্কাও আমার মাঝে কাজ করে। এই আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে ছিলেন আমার পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সদ্য প্রয়াত বড় ভাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তাই নিঃসন্দেহে এটি একটি স্পর্শকাতর আসন। কিন্তু এটি আমার জন্য পবিত্র এক অনুভূতির জায়গা। আশার কথা যে, কিশোরগঞ্জবাসী ’৬০-এর দশকের শুরু থেকেই আমাদের পরিবারের সঙ্গে আছেন এবং এটি আমাদের পরম আস্থার স্থান। বড় ভাই সৈয়দ আশরাফের অসমাপ্ত কাজ দিয়েই আমি আমার দায়িত্ব পালন শুরু করতে চাই এবং সেই সঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কিশোরগঞ্জকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এই আমার উদ্দেশ্য। সৈয়দ আশরাফ তার ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতা দিয়ে কিশোরগঞ্জকে এক সম্মানের স্থানে নিয়ে গিয়েছেন, আমি আমার জীবন দিয়ে চেষ্টা করব যেন সেই সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে পারি। আমার উদ্দেশ্য এমন এক কিশোরগঞ্জ গড়া যেখানে কোন সন্ত্রাস থাকবে না, মাদক থাকবে না, টেন্ডারবাজি থাকবে না। আমি শুধু ভৌত উন্নয়নের দিকেই জোর দেব না, জনসাধারণের সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিকাশের দিকেও গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ আমি মনে করি বস্তুগত উন্নয়নকে স্থায়ী করতে হলে মানুষের আত্মিক ও মানসিক উন্নয়ন অপরিহার্য। আমার কাজের ধরন হবে আমার মতো। হয়তবা কিছু ক্ষেত্রে আমার ভাই থেকে আলাদা কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি দ্বিধাহীনচিত্তে বলব যে, আমাদের লক্ষ্য এক এবং অভিন্ন। যে আস্থা কিশোরগঞ্জবাসী আমার ওপর রেখেছেন, যে আস্থা জননেত্রী এবং এই মহান সংসদের নেতা আমার ওপর রেখেছেন- আমার জীবন দিয়েও তা রক্ষা করতে বিচ্যুত হব না। লেখক : সংসদ সদস্য, কিশোরগঞ্জ-১
×