ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন চলচ্চিত্র আন্দোলনের অগ্রণী মুহাম্মদ খসরু

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

চলে গেলেন চলচ্চিত্র আন্দোলনের অগ্রণী মুহাম্মদ খসরু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভালবেসেছিলেন তিনি চলচ্চিত্র শিল্পকে। সেটাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। দেশের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। চলচ্চিত্র নির্মাণের চেয়ে প্রাধান্য দিয়েছিলেন সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাণের আন্দোলনে। চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনায়ও দিয়েছেন মুন্সিয়ানার পরিচয়। প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুহম্মদ খসরু। মঙ্গলবার বেলা ১২টায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল আনুমানিক ৭২ বছর। অকৃতদার মুহম্মদ খসরু গেছেন দুই ভাই এবং পরিবার-পরিজনসহ অসংখ্য শুভাকাক্সক্ষী। মুহম্মদ খসরুর মৃত্যু খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের মাঝে। হাসপাতালে ছুটে আসেন অনেকেই। তাদের মধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা মসিহউদ্দিন শাকের, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুনসহ অনেকে। তার প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন জানান, মঙ্গলবার বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হবে খসরুর মরদেহ। সেখান থেকে আজ বুধবার বেলা ১১টায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনে মুহম্মদ খসরুর শবদেহ নেয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বেলা একটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মুহম্মদ খসরুকে তার পিতৃভিটা কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুরে দাফন করা হবে। চলচ্চিত্রের অন্তপ্রাণ মুহম্মদ খসরুর পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ২১ জানুয়ারি শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগ নিয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন ডায়াবেটিক, এ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগে। হাসপাতালে ভতির পর আক্রান্ত হন নিউমোনিয়ায়। মুহম্মদ খসরু ভারতের হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে। তিনি দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে নানা বিষয়ে তার পড়ালেখা ছিল অগাধ। কখনও লেখক, কখনও সম্পাদক, আবার কখনও নিপুণভাবে পালন করেছেন দক্ষ সংগঠকের দায়িত্ব। জীবনের বেশিরভাগ সময় নিভৃতচারী হিসেবেই কাটিয়েছেন তিনি। মুহম্মদ খসরু চলচ্চিত্র বিষয়ক কালজয়ী পত্রিকা ‘ধ্রুপদি’ সম্পাদনা করতেন। চলচ্চিত্র মহলে পত্রিকাটি দারুণভাবে সমাদৃত। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিল্ম স্টাডি সেন্টার। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের আন্দোলনের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ এবং জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভ। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে তার অবদান ছিল অসামান্য। ১৯৭৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ‘পালঙ্ক’ ছবিটি নির্মাণের সময় মুহম্মদ খসরু ভারতীয় চলচ্চিত্রকার শ্রী রাজেন তরফদারের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ ৫০ বছর নিরবচ্ছিন্ন অবদানের জন্য মুহম্মদ খসরু ‘হীরালাল সেন’ আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সুবর্ণ জয়ন্তী পদক’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র সংসদ থেকে আজীবন সম্মাননা-২০১৭ প্রদান করা হয় তাকে। মুহম্মদ খসরু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র আন্দোলনের এই অগ্রণীকে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ফিল্মফ্রিতে লিখেছেন, মুহম্মদ খসরুকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তারা জানেন যে মানুষ হিসেবে তিনি ক্ষ্যাপাটে, রাগী, মুখে তার অবিরাম খিস্তি। তার সব রাগ, ক্ষোভ ওই চলচ্চিত্রকে ঘিরেই। এই মানুষ বেঁচে আছেন সংসার করার জন্য নয়, সম্পদ অর্জনের জন্য নয়, খ্যাতি কুড়াবার জন্য নয়, শুধু একটি শিল্পমাধ্যমকে ভালবাসার এবং সেই ভালবাসা অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার জন্য। ১৯৬৩ সালে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মুহম্মদ খসরু। সৎ, শুদ্ধ ও নির্মল চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন, সেগুলোর পঠন-পাঠনের মাধ্যমে আস্বাদন, অনুধাবন ও উপলব্ধি করা, আলোচনা-সমালোচনা করা, চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ ও প্রচার, সর্বোপরি সমঝদার ও রুচিশীল দর্শক তৈরির প্রয়াসের যে সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে, গত ৫০ বছর ধরে মুহম্মদ খসরু ধরে রেখেছিলেন সেই ধারাবাহিকতা। ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ গঠনের সময় তার সঙ্গী ছিলেন আনোয়ারুল হক খান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, আবদুস সবুর, সালাহ্উদ্দিন প্রমুখ। চলচ্চিত্র নিয়ে পত্র-পত্রিকায় গভীরতা-আশ্রয়ী লেখালেখি ও গবেষণার ধারাবাহিকতা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি থেকে মুহম্মদ খসরুর সম্পাদিত চলচ্চিত্রের কাগজ ‘ধ্রুপদি’ যখন প্রকাশিত হতো, সেই সময়ে চলচ্চিত্রের পত্রিকা সম্পাদনা কিংবা প্রকাশ ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। সেই সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত ‘ধ্রুপদি’ দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের কাগজের স্বীকৃতি পায়। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের প্রবাদতুল্য মানুষটি উৎসাহিত করেছেন দেশের খ্যাতনামা অনেক চলচ্চিত্রকারদের। তাদের মধ্যে অন্যতম তারেক মাসুদ। চলচ্চিত্রকে মানুষের অধিকার আন্দোলনে কাজে লাগাতে সোচ্চার ছিল তার কলম। তার রচিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন’, ‘বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ভূমিকা’, ‘সাক্ষাতকার চতুষ্টয়’। ‘ধ্রুপদি’ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘চলচ্চিত্রপত্র’, ‘ক্যামেরা যখন রাইফেল’ ও ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ বিশেষ সংখ্যা।
×