ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পায়রায় ডুবোচর

ফেরি চলাচলে বিঘ্ন

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯

ফেরি চলাচলে বিঘ্ন

নিজস্ব সংবাদদাতা, আমতলী, বরগুনা, ১৩ জানুয়ারি ॥ বুড়িশ্বর নদী বা পায়রা নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৯০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১২০০ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বুড়িশ্বর নদী বা পায়রা নদী বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাটি ইউনিয়ন এলাকার প্রবাহমান নদী হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। অতঃপর এই নদীর জলধারা আঙ্গারিয়া, লেবুখালী, পাঙ্গাশিয়া, ইটবাড়িয়া, ছোটবিঘাই, বড়বিঘাই, আয়লা পাটকাটা, গুলিশাখালী, আমতলী পৌরসভা, বুড়িরচর, আড়পাঙ্গাশিয়া এবং পচাকোড়ালিয়া, ছোটবগী ও নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়ন অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে নিপতিত হয়েছে। নদীটির উজানের তুলনায় ভাটির দিক অধিক প্রশস্ত। নদীতে সারাবছর পানিপ্রবাহ পরিদৃষ্ট হয় এবং ছোট-বড় নৌযান চলাচল করে। তবে বর্ষাকালে নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির প্রবাহ অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এ সময় নদীর তীরবর্তী অঞ্চল বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। নদীটি জোয়ার ভাটার প্রভাবে প্রভাবিত। এই নদী বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নৌপথ হিসেবে স্বীকৃত। অপর দিকে বিষখালী ও বলেশ্বর নদী বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। তিন নদীর মোহনাকে জেলেদের ভাষায় গাঙ্গের আইল বলা হয়। বঙ্গোপসাগরের মিলিত হওয়া বিষখালী-বলেশ্বর মোহনায় লালদিয়া সমুদ্র সৈকত এবং পায়রা-বিষখালীর মোহনায় পদ্মাবাবুগঞ্জচর। তিন নদীর মোহনায় এ চর দুটি স্বাভাবিক জোয়ারের পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে নদীর গভীরতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। পায়রা-বিষখালী নদীর মোহনায় রয়েছে বড়াইয়্যার ডুবোচর। ১৫-২০ কিলোমিটার জুড়ে এ চর ফকিরহাট থেকে শুরু করে আশার চরে মিলিত হয়েছে। এ চরটি বঙ্গোপসাগর থেকে পায়রা নদীতে জোয়ারের পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। আশার চরের শেষ সীমানা থেকে শুরু হয়েছে নলবুনিয়ার ডুবোচর। এ চরের বিস্তৃতি ৭-৮ কিলোমিটার। এ ডুবোচরটি পায়রা নদীর প্রবেশ দ্বারে অবস্থিত। পায়রার প্রবেশ মুখ অতিক্রম করে ৩-৪ কিলোমিটার পরে পরপর পদ্মা ও কুমিরমারা ডুবোচর । এ চরের বিস্তৃতি ৬-৭ কিলোমিটার। এ চরে পড়ন্ত ভাটায় লোকজন হাটাচলা করে। জেলেরা খুটা গেরে জাল ফেলে। জোয়ারের সময় এ ডুবোচরে প্রচ- তুফান হয়। এ সময় ডুবোচরের কারণে সাগর থেকে জোয়ারের পানির সঙ্গে রুপালি ইলিশ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে অন্যান্য নদীর তুলনায় পায়রা নদীতে তুলনামূলকভাবে ইলিশের পরিমাণ কম থাকে। ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর প্রলঙ্ককারি ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানায় নদী গতিপথ হারিয়ে যায় এবং ডুবোচরের সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে আইলার পরে পায়রা নদীতে দ্রুতগতিতে ডুবোচরের সৃষ্টি হয়। ওই সময় পর থেকে নদীর নাব্য হারাতে থাকে। বঙ্গোপসাগর থেকে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা বালু কনা ও পলি জমে নদীর গভীরতা কমে ২০ থেকে ২৫ ফুট দাঁড়িয়েছে। জোয়ারের পানিতে আসা বালু কনা পায়রা নদীর তলদেশে জমা হয় কিন্তু ভাটার তীব্রতায় ওই পলি বঙ্গোপসাগরে যেতে পারে না। ফলে বালু কনা জমা পরে সৃষ্টি হয় ডুবোচর। পায়রা নদীতে নাব্য সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নদীতে ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় লঞ্চ ও ফেরিসহ নৌযান চলাচল হুমকির মুখে পড়েছে। বরগুনা ও আমতলীর মাঝখান দিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার প্রস্থ প্রবাহিত পায়রা নদী। আমতলী-পুরাকাটা পায়রা নদীর ফেরি চলাচলের জন্য গত বছর বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ চরের মধ্যখান দিয়ে চ্যানেল তৈরির জন্য ড্রেজিং করে। এক মাস যেতে না যেতেই ওই চ্যানেল ভরে যায়। এতে আবারও সমস্যায় পরে ফেরি ও খেয়া পারাপার। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, পায়রা নদীর চরপাড়ায় এক কিলোমিটার, বুড়িরচর পাঁচ কিলোমিটার, লোচা থেকে শুরু করে ওয়াবদা স্লুইসগেট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার, জাঙ্গালিয়া দুই কিলোমিটার, ডালাচারা থেকে তিতকাটা পর্যন্ত আট কিলোমিটার ও কাঁকচিরা থেকে মির্জাগঞ্জ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশাল ডুবোচর রয়েছে। এ ডুবোচরের কারণে নদীতে লঞ্চ, ফেরি ও ট্রলার চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। এ পথে লঞ্চ, ফেরিসহ বড় বড় নৌযান চলাচল করতে পারে না। বাধ্য হয়ে তখন তিন থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে ঘুরে চলাচল করতে হয়। অনেক সময় রাতের অন্ধকারে এ পথে ফেরিসহ নৌযান চালাতে গিয়ে চরে আটকা পড়ে যায়। বাধ্য হয়ে তখন যাত্রী ও যানবাহন নিয়ে জোয়ারের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়। সাগরসংলগ্ন নলবুনিয়া গ্রামের আলমগীর হাওলাদার বলেন, সাগর মোহনায় ডুবোচরের সৃষ্টি হওয়ায় পায়রা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। এতে রুপালি ইলিশ পায়রায় প্রবেশ করতে পারে না। তিনি আরও বলেন, নদীতে ডুবোচরের কারণে নৌযান স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে না। এ ডুবোচর কেটে নদীর স্বাভাবিক গতি পথ সৃষ্টি না হলে পায়রা নদী মরা পায়রায় পরিণত হবে। আমতলী পৌর শহরের লঞ্চঘাট এলাকার জেলে হোসেন গাজী বলেন, ডুবোচরের কারণে পায়রা নদীতে রুপালি ইলিশ ধরা পড়ছে না। সিডরের আগেই আমতলী পায়রা নদীতে ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। সিডরের পরে চর সৃষ্টির প্রসারতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমতলী-পুরাঘাটের খেয়ার মাঝি ফরিদ মৃধা, ইয়ামিন হাওলাদার, খলিল তালুকদার ও আল আমিন গাজী বলেন, ডুবোচরের কারণে ভাটার সময় তিন থেকে চার কিলোমিটার ঘুরে খেয়া পারাপান হতে হয়। এতে জ্বালানি খরচ বেশি হওয়ায় আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। আমতলী-পুরাঘাট খেয়াঘাটের ইজারাদার মোঃ ইসহাক হাওলাদার বলেন, ডুবোচরের কারণে ভাটার সময় ঠিকমতো খেয়া চলাচল করতে পারে না। অতিদ্রুত ডুবোচর ড্রেজিং করে নদীর নাব্য দূর করে খেয়া পারাপারে সুবিধার দাবি জানাই। বরগুনা বিআইডব্লিউটিএ’র পোর্ট অফিসার মোঃ মামুন অর-রশিদ বলেন, ডুবোচরের কারণে পায়রা নদীর স্বাভাবিক গতিপথ হ্রাস পেয়েছে। ড্রেজিং করে পায়রা নদীর নাব্য দূরীকরণে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বাঘাবাড়িতে ভিড়ছে না জাহাজ নিজস্ব সংবাদদাতা পাবনা থেকে জানান, যমুনা নদীর নাব্য সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করায় বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়তে পারছে না । চট্টগ্রাম থেকে সার, সিমেন্ট ও তেলবাহী ২৫টি জাহাজ গত ১০ দিন ধরে বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে আসার পথে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতদিয়ায় আটকে পড়েছে। আটকেপড়া এ সব জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করে বাঘাবাড়ি বন্দরে আনতে হচ্ছে। বাঘাবাড়ি নৌযান লেবার এ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে নাব্য সঙ্কটের কারণে দৌলতদিয়া থেকে বিকল্প উপায়ে পণ্য বাঘাবাড়ি বন্দরে আনায় পণ্য সামগ্রী পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, বাঘাবাড়ি বন্দরে জাহাজ চলাচলের জন্য ১০ ফিট পানির গভীরতা দরকার হলেও বর্তমানে তা ৭ ফিটের নিচে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এ নৌ পথে জাহাজ চলাচলে বেড়া উপজেলার পেঁচাকোলা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত পানির স্তর জায়গায় জায়গায় ৫ ফিট থেকে ৭ ফিট পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। এ অংশে ছোটবড় অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় জাহাজ চলাচল হুমকির মধ্যে পড়েছে। এ কারণে গত ১০ দিনে অন্তত ২৫টি সার, সিমেন্ট, তেলসহ পণ্যবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ি বন্দরে ভিড়তে পারছে না। তাই পণ্যবাহী এসব জাহাজ মানিকগঞ্জের দৌলতদিয়া পয়েন্টে নোঙ্গর করতে হচ্ছে। আটকেপড়া এ সব জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজ ও ট্রলারে করে পণ্যসামগ্রী খালাস করে বাঘাবাড়ি বন্দরে আনা হচ্ছে। বাঘাবাড়ি নৌবন্দর সহকারী পরিচালক এস এম সাজ্জাদুর রহমান জানান, পানির গভীরতা অনুযায়ী জাহাজে যত মালামাল আনার প্রয়োজন তার চেয়ে অতিরিক্ত মাল বোঝাইয়ের কারণে এসব স্বাভাবিকভাবে বন্দরে আসতে পারছে না। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে ড্রেজার দিয়ে পলি অপসারণ করে এ নৌরুট সচল রাখার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এবার ও ড্রেজিং করে নৌপথ চালু রাখার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
×