ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হোয়াইট হাউসের বিস্ময়কর তথ্য

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৩১ আগস্ট ২০১৮

হোয়াইট হাউসের বিস্ময়কর তথ্য

১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার জাতির পিতা এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন হোয়াইট হাউস নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ করেন এবং চূড়ান্ত নকশার অনুমোদন দেন। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং হোয়াইট হাউসের নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটনের মেয়াদ ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। তিনি ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ‘প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস’ নামে খ্যাত হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটনের থাকার সৌভাগ্য হয়নি কখনও। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জন এ্যাডামস তার স্ত্রী এ্যাবিগ্যালিকে নিয়ে অসম্পূর্ণ হোয়াইট হাউসে চলে আসেন। তাঁরাই আমেরিকান জাতির প্রথম দম্পতি যারা হোয়াইট হাউসে বসবাস শুরু করেন। আপনার ধারণার চেয়েও বড় বর্তমানের বিশাল সব ভবনের তুলনায় হোয়াটস হাউস ছোট হলেও, আমেরিকান গৃহযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এটিই ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বড় ভবন। ছয় স্তরে সাজানো হোয়াইট হাউসে রয়েছে ১৩২টি রুম, ৩৫টি বাথরুম। আরও রয়েছে ৪১২টি দরজা, ১৪৭টি জানালা, ২৮টি ফায়ারপ্লেস, ৮টি বৃহদাকার সিঁড়ি এবং ৩টি লিফট। ভবনটির দৈর্ঘ্য ১৬৮ ফুট এবং প্রস্থ ৮৫ ফুট (প্রবেশ দ্বারের বারান্দা ছাড়াই)। ভবনটি দক্ষিণ দিকে লম্বায় ৭০ ফুট এবং উত্তরদিকে ৬০ ফুট ৪ ইঞ্চি। হোয়াইট হাউস এবং এর সংশ্লিষ্ট অংশ মোট ১৮ একর জমির উপর অবস্থিত। ব্রিটিশ সৈন্যদের আক্রমণের শিকার ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা-ব্রিটেন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন আমেরিকান সৈন্যরা ব্রিটেনের ইয়র্ক প্রদেশের ওন্টারিওর বিভিন্ন দালান-কোঠায় অগ্নিসংযোগ করে। এর প্রতিশোধস্বরূপ ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সৈন্যরা হোয়াইট হাউস আক্রমণ করে এবং তাতে অগ্নিসংযোগ করে। ফলে হোয়াইট হাউসের ভেতরের অংশ এবং ছাদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস মেডিসন হোয়াইট হাউসের প্রধান নকশাকারক জেমস হোবানকে জরুরীভিত্তিতে ভবন পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেন। তবে মেডিসন এবং তার স্ত্রী হোয়াইট হাউসে আর ফিরতে পারেননি। পুনর্নির্মাণের যখন শেষ হয় তখন নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেমস মনরো ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হোয়াইস হাউসে আসেন। ১৯০১ সালের আগে কোনও নাম ছিল না ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিখ্যাত এই ভবনটি আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের সরকারী বাসভবন হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপ্রতি থিওডোর রুজভেল্ট সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর মূলত ভবনটি সরকারীভাবে ‘হোয়াইট হাউস’ নামকরণ করা হয়। এর আগে ভবনটি ‘প্রেসিডেন্ট হাউস’ বা ‘দ্য প্রেসিডেন্ট ম্যানসন’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিছু তত্ত্ববিদদের মতে, ১৮১৪ সালে ভবনটিতে আগুন লাগার পর সেটি সাদা রং করা হয় এবং সেখান থেকেই ‘হোয়াইট হাউস’ নামের উৎপত্তি। তবে এই কাহিনী ভিত্তিহীন বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা। টানা দুই বছর আন্দোলন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৯১৭ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে একদল নারী হোয়াইট হাউসের সামনে আন্দোলন শুরু করেন। নারীদের ওই দলটি ‘দ্য সাইলেন্ট সেন্টিনেল’ নামে পরিচিত ছিল। দলটি জাতীয় নারীবাদী দলের সমর্থক ছিল এবং নারীদের ভোটাধিকার না দেয়া পর্যন্ত তারা হোয়াইট হাউসের সামনে আন্দোলন চালিয়ে যান। তাঁরা টানা আড়াই বছর, সপ্তাহে ছয় দিন হোয়াইট হাউসের সামনে ক্যাম্প স্থাপন করে আন্দোলন চালিয়ে যান। আন্দোলন চলাকালীন তাঁরা বিভিন্ন প্রকার হয়রানি, এমনকি মারধরের শিকার হওয়া সত্ত্বেও আন্দোলন চালিয়ে যান। অবশেষে ১৯১৯ সালের ৪ জুন আমেরিকান সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে নারীদের ভোটাধিকারের কথা উল্লেখ করা হলে সেই আন্দোলন সমাপ্ত হয়। ভুতুড়ে বলে গুজব রয়েছে ঐতিহাসিক এই ভবনটির মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট, ফার্স্ট লেডি, কর্মকর্তা এবং অতিথিরা ভূতের দেখা পেয়েছেন বলে প্রচলিত রয়েছে। পূর্বদিকের কক্ষে মৃত ফার্স্ট লেডি এ্যাবিগ্যালি এ্যাডামসকে যেতে দেখা গেছে, যেখানে তিনি তাঁর কাপড়চোপড় রাখতেন। তাছাড়া ফার্স্ট লেডি ম্যারি টোড লিংকন তাঁর বন্ধুদের কাছে গল্প করতেন যে, তিনি মৃত এ্যান্ড্রু জ্যাকসনকে প্রচ- শব্দে দাপাদাপি এবং চিৎকার করতে শুনেছেন। অবশ্য এসব কাহিনীর মধ্যে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের আত্মা হোয়াইট হাউসের ভেতর ঘুরে বেড়ানোর কথা বেশি শোনা যায়। প্রেসিডেন্ট কুলিজ, জনসন এবং রুজভেল্টের সময়কালের ফার্স্ট লেডিরা একাধিকবার লিংকনের আত্মাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন বলে প্রচার রয়েছে। এমনকি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন হোয়াইট হাউসে ছিলেন, তিনি তখন আব্রাহাম লিংকনের আত্মাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। হোয়াইট হাউসে বন্যপ্রাণী হোয়াইট হাউসে বসবাসকারী মার্কিন প্রেসিডেন্টের পোষা প্রাণীও সেখানে থাকে। এক্ষেত্রে কুকুর এবং বিড়ালের মতো আদর্শ পোষা প্রাণী কমন হলেও, কোন কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট খামার কিংবা বন্যপ্রাণীও হোয়াইট হাউসে এনেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি পাখি, খরগোশ, কুকুর, বিড়াল থেকে শুরু করে ঘোড়া পর্যন্ত পুষে রেখেছিলেন হোয়াইট হাউসের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন পুষেছিলেন দুটি ভালুকের শাবক। প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভ্যান বুরেন দুটি বাঘের শাবক পুষেছিলেন যা তিনি উপহার পেয়েছিলেন ওমানের সুলতানের কাছ থেকে। পরে অবশ্য কংগ্রেসের জোরজবরদস্তির কারণে সেগুলো চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন একটি ছাগল এবং গরু পালন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জেমস বুকানান একজোড়া টেকো ঈগল রাখার পাশাপাশি কুকুরছানা, টাট্টুঘোড়া এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পুষে রেখেছিলেন। প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড হোয়াইট হাউসের আঙিনায় মুরগি পালন করেছিলেন। ভবন রং করতে কত রং লাগে অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনার মতো হোয়াইট হাউসের চাকচিক্য ধরে রাখতে বেশ পরিচর্যার দরকার পড়ে। হোয়াইট হাউসের বাইরের অংশ রং করতে লাগে ৫৭০ গ্যালন সাদা রং (প্রায় ৩ টন), যার ৩০০ গ্যালন মূল ভবন রং করতেই খরচ হয়ে যায়। ১৯৯২ সালে হোয়াইট হাউস সংস্কার করার সময় বাইরের দেয়াল থেকে প্রায় ৩০ স্তরের সাদা রং উঠাতে হয়েছিল। বর্তমানে প্রতিবছর হোয়াইট হাউস রং করা হয় এবং সারা বছরই এটির নানা সংস্কার কার্যক্রম চলতেই থাকে। গোপনে নির্দেশ দেয়ার সেন্টার রয়েছে? ২০১০ সালে নির্মাণকর্মীরা হোয়াইট হাউসের পশ্চিমাংশের সামনে বিশালাকৃতির একটি গর্ত খোঁড়া শুরু করেন। কাজটি খুবই গোপনে করা হয় এবং কাজ চলাকালীন সময়ে সবুজ রঙের একটি উঁচু ঘেরের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। দুই বছর পর সেই ঘের খুলে দেয়া হয় এবং নির্মাণাধীন জায়গাটি দেখে মনে হয় যে, এখানে কিছুই হয়নি। হোয়াইট হাউস কর্তৃপক্ষের মতে, পশ্চিম পাশের কিছু অংশ পুরনো হয়ে যাওয়ায় সেটা পুনর্নির্মাণের কাজ চলছিল সেখানে। কিন্তু ট্রাকের পর ট্রাক উন্নতমানের কংক্রিট নিয়ে যাওয়া দেখে অনেকের মনে সন্দেহ জাগে যে, এর অভ্যন্তরে গোপনে নির্দেশনা দেয়ার সেন্টার বানানো হচ্ছে। যা ৫০ বছর আগে স্থাপনের কথা ছিল। রাজনৈতিক বিদ্বেষের শিকার শুরুর দিকে আমেরিকায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার হাতবদল বেশ মর্যাদাপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণ ছিল। পরবর্তীতে কিছু প্রেসিডেন্ট নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানান। ১৯৩২ সালে প্রেসিডেন্ট হুভারের পর রুজভেল্ট ক্ষমতায় আসলে হুভার এমন আচরণ করেন। পরবর্তীতে সাবেক প্রেসিডেন্টের প্রশাসন নানান প্রহসনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা ছাড়া শুরু করেন। ২০০১ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ ক্ষমতায় এলে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের কর্মচারীরা হোয়াইট হাউসে প্রায় ২০ হাজার ডলার মূল্যের ক্ষয়ক্ষতি করে রেখে যান। তারা হোয়াইট হাউসের ৬০টি কম্পিউটার থেকে ডব্লিউ বাটন উঠিয়ে টেপ দিয়ে ভবনের দেয়ালের বিভিন্ন অংশে লাগিয়ে রেখে যান। এছাড়াও তারা দরজার হাতল চুরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসবাবের ড্রয়ারের নিচের অংশে আঠা লাগিয়ে রেখে যান। প্রায় ১০০টি টেলিফোনের নম্বর পরিবর্তন করে ভুলভাল নম্বর সেইভ করে রেখে যান। ফুল টাইম স্টাফের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি সাবেক কোন প্রেসিডেন্ট যখন হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন, তিনি সাধারণত সেখানকার সকল কর্মীকে সঙ্গে নিয়েই ত্যাগ করেন। নতুন প্রেসিডেন্টকে তার নিজস্ব স্টাফ দিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হয় যার সংখ্যা প্রায় ৩,৩০০ জন। তাছাড়া সেখানে অনেক প্রকারের পার্টটাইম স্টাফ রয়েছেন যাদের সংখ্যা উল্লেখ করা মুশকিল। নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নিয়োগকৃত বেশকিছু স্টাফ রয়েছেন যারা অফিস হোয়াইট হাউসের বাইরে কাজ করেন। তাছাড়া হোয়াইট হাউস কর্তৃপক্ষ ৫০০ স্টাফ নিয়োগ করে, ভাইস প্রেসিডেন্ট অফিস নিয়োগ করে ১০০ স্টাফ, সামরিক অফিস নিয়োগ করে ১৩০০ স্টাফ। অফিস ব্যবস্থাপনা এবং বাজেট কাজে স্টাফের সংখ্যা প্রায় ৫০০। এছাড়াও হোয়াইট হাউসে ৫০০-র বেশি গোয়েন্দাকর্মীসহ ২০০ স্টাফ নিয়োগ করা হয় প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য। মূল ভিত্তিপ্রস্তর উধাও হোয়াইট হাউস নিয়ে যত রহস্য আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ভবনের মূল ভিত্তিপ্রস্তর গায়েব হয়ে যাওয়া। ১৭৯২ সালে স্থাপনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হোয়াইট হাউসের মূল ভিত্তিপ্রস্তর উধাও হয়ে যায়। কোথায় গেল কেউ জানে না। নির্মাণকর্মীদের মধ্যে এ ব্যাপারে কেউ কিছু স্বীকার করেনি। বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট যেমন : রুজভেল্ট এবং ট্র্যুম্যান সেটি খোঁজার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। শোনা যায়, ভিত্তিপ্রস্তরটি হোয়াইট হাউসের আঙিনায় অবস্থিত একটি গোলাপ বাগানে দুটি পাথুরে দেয়ালের ভেতর লুকানো আছে, কিন্তু তা কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট
×