আকাশে ঝলমলে রোদ্দুর।
আলো আছে আকাশভরা। উত্তাপ নেই বললেই চলে। তখন বিকেল গড়িয়ে পড়েছে প্রায়। খুব ধীরে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সেই বাতাসে ঘরে-ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির গানের আভাস ভেসে আসে। নিকটে কোথাও নয়, বেশ বুঝা যায়Ñপাখিদের এই গানের সুরের উৎস হয়তো বা দূরে কোথাও।
এরই মাঝে ঘুড়িদের মিটিং বসেছে।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েই যে তাদের এসব মিটিং হয় সব সময় তা কিন্তু নয়। তবে মাঝে-মধ্যেই তারা একত্রিত হয়। নানান বিষয়ে তাদের কথা হয়, আলোচনা হয়, তর্ক-তর্কি হয়, আবার ভাবভালোবাসাও হয়। লোকে এটাকেই বলে ঘুড়িদের মিটিং। এটা ঘুড়িদের মিটিং ঠিকই, তবু কিছু কথা আছে। এই মিটিংয়ে যারা অংশ নেয়, তাদের মধ্যে প্রায় সবাই সুতোকাটা ঘুড়ি। কবে একদিন ঘুড়িপ্রিয় বালকের বা কিশোরের চোখের স্বপ্ন আপন বুকে নিয়ে তারা উড়েছিল আকাশে, কত না রঙিন স্বপ্নে রাঙিয়ে দিয়েছিল বিকেলের নরম আকাশ, তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘের সঙ্গে কত না লুকোচুরি আর কত না মাখামাখি; তারপর মাঞ্জা দেওয়া সুতোর প্রবল টানের কাছে টিকতে না পেরে এক সময় ভোকাট্টা হয়ে লেজ দুলিয়ে গা এলিয়ে গড়িয়ে পড়া।
সুতোকাটা এই ঘুড়িগুলো শেষপর্যন্ত কোথায় গড়িয়ে পড়ে?
কোনো কোনো ঘুড়িপাগল বালক চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছনে পেছনে বহু দূর ছুটে যায়, ঝোপজঙ্গল কাঁটা-খোঁচ কোনো বাধা মানে না, ছুটে যায় পায়ে রক্ত ঝরিয়ে বুকের মধ্যে একরাশ আবেগ নিয়ে, গিয়ে দ্যাখে সুতোকাটা ঘুড়িটা ঝুলে আছে কোনো এক লম্বা গাছের মগডালে কিংবা ঝোপজঙ্গলের মাথার উপরে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে পড়ে আছে চিৎপটাং। তখন সে কী করে? লতাপাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকে, চোখ কুতকুত করে দ্যাখেÑএত যে বদ্রাগী একরোখা ঘুড়ি, এ কী পরিণতি তার! এখানে ওখানে খোঁচা-খুঁিচ খেয়ে ছিঁড়েছুটে ফালাফালা! কী যে হাল হয়েছে ঘুড়ির চেহারা কিংবা শরীরের!
তবু তার ওই ঘুড়িটাই চাই।
সুতোকাটা ঘুড়ি বলে সে কি ঘুড়ির সমাজের বাইরে চলে গেছে! আহা, সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত! কত না আঘাত সইতে হয়েছে পথে পথে! ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরে নিচে নেমে আসা মানে কি সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া! মোটেই তা নয়। বরং ঘুড়ি রাজ্যের অনিয়ম বা অন্ধকার দিকগুলো বেশি জানা থাকে তাদেরই। আবার আনন্দের খবরও আরো অনেকের চেয়ে ভালো জানে এই সুতোকাটা ঘুড়িরাই। আর দুঃখ-বেদনার কথা তো বলতেই নেই, লড়াই করতে করতে সুতোর টান কেটে গেলে তখন তো পতন অনিবার্য! উপরে থেকে নিচে নামা কি সোজা কথা! অনেকে অবশ্য উপরে ওঠার কাজটাকেই সবচেয়ে কঠিন মনে করে, নামার ব্যাপারটা তারা বুঝতেই চায় না। বোঝে না বলেই দুম করে বলে ফেলতে পারেÑনামা আবার কঠিন কোথায়! নিজেকে একবার ছেড়ে দিলেই হলো!
সুতোকাটা ঘুড়িদের মধ্যে একটা আছে বাচাল স্বভাবের। স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনা নেই; যেখানে সেখানে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে। বেশ, ইচ্ছে হলে না হয় বলল কথা, তাই বলে আবোল তাবোল বকলেই হলো! কোথায় কোন কথা বলা উচিত সেটা ভেবে দেখতে হবে তো! না, অত ভাবনা-চিন্তার মধ্যে সে নেই। মনের ভেতরে কোনো কথার উদয় হলেই তার পেট গুড়গুড় করে। সে কথা মুখে প্রকাশ না করা পর্যন্ত তার শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। কথা বলার সুযোগ না পেলে তখন সে ফিকফিক করে হাসে। সে হাসির যে মানে কী তা কে জানে! মিটিং চলাকালে সবাই যখন আলোচনায় ব্যস্ত, বাচাল ঘুড়ি তখনও ফিকফিক হাসছে। সে হাসি দেখে কর্তামতো ঘুড়িটি বেশ বিরক্ত হয়ে বলে,
হাসির কী দেখলে, এ্যাঁ?
না, এমনিতেই হাসছি।
কর্তা ঘুড়িটি বিরক্ত এবং বিস্মিত,
এখানে একটা মিটিং চলছে। আর তোমার কিনা এমনিতেই হাসি পাচ্ছে!
হ্যাঁ, হাসি পাচ্ছে যে!
কেন হাসি পাচ্ছে চাঁদু?
চাঁদু! দয়া করে ওই নামে ডাকবেন না। ওই নামে একটা ভয়ঙ্কর খারাপ মানুষ আমি দেখেছি। উহ্, সে যে কী বদমাশ সন্ত্রাসী! বাপরে বাপ! না দেখলে...
তোমার চোপাবাজি থামাও তো বাচালবাবু!
বলেন, এই নামে আমার আপত্তি নাই। কথা বেশি বললে অন্তর পরিষ্কার থাকে। উহ্! কী আর বলব! সেই চাঁদুমিয়া করে রাজনীতি। মানুষ ঠকানোর রাজনীতি।
এতক্ষণে অন্যএক লেজকাটা ঘুড়ি হাত তুলে তাকে থামায়। রাজনীতির কথায় সে হয়তো ব্যথিত হতেও পারে। এই ঘুড়ি-জনমের আগে তারও বেশ রাজনীতির নেশা ছিল। বাচাল ঘুড়িকে থামানোর পর সে জানায়Ñদুনিয়ায় সব রাজনীতিবিদ যেমন ওই চাঁদুর মতো খারাপ নয়, আবার চাঁদু নামের সব মানুষই যে খারাপ হবে তারও কোনো মানে নেই। তা তুমি হাসছিলে কেন বলো তো শুনি।
এমনিতেই।
এমনিতে বললেই হলো? একটা কারণ নিশ্চয় আছে। কী সেই কারণ?
বাচাল ঘুড়ি বলে,
এই আমাদের সুতোকাটা ঘুড়িদের কথা ভেবে হাসছিলাম।
কী রকম?
বাইরের কেউ কি সুতোকাটা ঘুড়িদের ভেতরের কথা জানে? প্রশ্ন করার পর সে আবার নিজে থেকেই উত্তর দেয়Ñজানে না। ঘুড়িকে সবাই ঘুড়িই মনে করে। কিন্তু সুতো কেটে যাবার পর ঘুড়ি কি আর ঘুড়ি থাকে? সুতো কাটার সঙ্গে সঙ্গে ঘুড়ির ভেতর থেকে তো আসলে ঘুড়িটাই হারিয়ে যায়, পালিয়ে যায়Ñতাই না?
বাব্বা! তুমি যে ভারি দার্শানিক কথাবার্তা বলছ হে! এ সব কথা দুনিয়ার সবাই জানবে কেমন করে?
আমিও তো সেই কথাই বলছি। সবাই ঘুড়িটাকেই দ্যাখে, দেখে আনন্দ পায়, সুতোকাটা ঘুড়ির বেদনার দিকটা কেউ ধরতেই পারে না।
লেজকাটা ঘুড়ি হঠাৎ যেন বেদনাক্রান্ত হয়ে পড়ে। নাকে সর্দি টেনে সে বলে,
তুমি এভাবে বলো না তো ভাই, আমার মন খারাপ করছে।
কেন, মন খারাপ কেন?
না, না, আমার কান্না পাচ্ছে। তুমি থামো।
কী আশ্চর্য! আমরা সবাই তো সুতোকাটা ঘুড়ি, আমাদের মধ্যে আবার কান্নাকাটি কিসের?
এবার ফ্যাঁচ করে ফুঁপিয়ে ওঠে,
আরে ভাই, আমার যে এদিকে লেজও কাটা!
বাচালটা অনেকক্ষণ পর হেসে ওঠে হি হি করে।
তুমি হাসছ! হাসো। যত পারো হাসো। কী বিপদে পড়ে যে আমার লেজ কাটা গেছে সেটা যদি জানতে!
আচ্ছা, আগে তোমার লেজকাটা, নাকি সুতোকাটা?
কী মুশকিল, লেজ তো কেটেছে আমার নিজের দোষে। আমারই গোঁয়র্তুমির জন্যে। চট্টগ্রামের পাহাড়ি জঙ্গলের মাখার উপর দিয়ে উড়তে গেলাম যে!
অ। তাহলে তোমার লেজটাই গেছে আগে?
আরে নাহ্। সুতো কেটে ভো-কাট্টা হয়ে যাবার পরই তো উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম চাটগাঁ। পাহাড়-নদী-সাগর আর বনবনানীর এমন মধুর মাখামাখি আমি আর কোথাও দেখিনি। আমাদের এইটুকু দেশের মধ্যে এ যেন এক অন্যজগৎ। বিশ্বাস করÑচাটাগাঁ না গেলে আমার এত অভিজ্ঞতাই হতো না।
লেজকাটা ঘুড়ি এত কথা কাকে শোনাচ্ছে এতক্ষণ! অপাত্রে ঘি ঢালবার কোনো মানে হয়! বাঁচাল ঘুড়ি এত সব ভালো কথা শুনলে তো! তার মনের ভেতরে কী আছে কে জানে! হঠাৎ নিচে তাকিয়ে সুন্দর এক প্রজাপাতি দেখে সে খুব অবাক হয়। পুটুশবনের ছোট ছোট ফুলের মাথার উপরে পাখা মেলে উড়ছে এক রঙিন প্রজাপতি। সেই প্রজাপতিকে দেখে সে রীতিমতো গান শুরু করেÑপ্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা/ টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা/কোথায় পেলে ভাই...।
লেজকাটা ঘুড়ি সশব্দে হাততালি দিয়ে ওঠে,
বাহ! তুমি তো চমৎকার গান জানো দেখছি!
প্রশংসা শুনে বেশ লজ্জা পায়,
না, এই একটু আধটু আর কী!
কী বলছ তুমি! এমন সুন্দর কণ্ঠ...
কতদিন গলা সাধা হয়নি!
তবু এমন সুন্দর!
আরও একবার গাই তাহলেÑপ্রজপাতি প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই.. লেজকাটা ঘুড়ি হঠাৎ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়। চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বলে, দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি প্রজাপতি কোথায় দেখলে?
কেন, ওই যে প্রজাপতি!
আঙ্গুল তুলে দেখায় বাচাল ঘুড়ি। কিন্তু লেজকাটা সেটা মানতে চায় না। বলে, মাথা খারাপ! ওটা প্রজাপতি হবে কেন?
তা হলে!
বীরকন্যা প্রীতিলতার নাম শুনেছে তুমি?
হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি তো! সে তো এই চট্টগ্রামেরই মেয়ে।
অমা তুমি তাও জানে দেখছি!
সে তো সেই কবেকার কথা!
কবেকার মানে সে হচ্ছে অগ্নিযুগের কথা। শুধু এই বাংলাদেশ নয়, গোটা ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। শাসন করছে ইংরেজরা। তাদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্যে সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে চট্টগ্রামে। খুব অল্প সময়ের জন্যে হলেও ইংরেজদের হাত থেকে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে ফ্যালে সূর্যসেন এবং তার দলবল।
বাচাল ঘুড়ি শুধরে দেয়,
সবাই বলে মাস্টারদা সূর্যসেন।
ওই হলো। সেই মাস্টারদার বিপ¬বী শিষ্য ছিল নির্মল সেন, পুলিন ঘোষ, মধু দত্ত, লোকনাথ বল, নরেশ রায়, অর্ধেন্দু দস্তিদার, কানু ঘোষ, নির্মল লালাÑআরো কতজন।
আর প্রীতিলতা?
ওরে বাবা! সে তো সাংঘাতিক ডাকাবুকো শিষ্য। তার নেতৃত্বেই ইউরোপীয়দের নাচগানের ক্লাব ধ্বংস করা হয়। একেবারে শেষ মুহূর্তে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার আগেই কী করেছিল জানো?
না তো!
নিজে হাতে বিষপান করেছিল। তখনকার দিনের বিপ¬বীদের উপরে নির্দেশই ছিলÑকিছুতেই ইংরেজ সৈন্য কিংবা পুলিশের হাতে ধরা পড়া চলবে না। ওরা নির্যাতন চালিয়ে গোপন কথা মানে বিপ¬বী তথ্য বের করে নেবে। তার চেয়ে বিষপানে আত্মহত্যাই ভালো।
আচ্ছা ভাই, তুমি এত কথা জানলে কী করে?
কী যে বোকার মতো প্রশ্ন করো না! আমিও তো একটা সুতোকাটা ঘুড়ি, নাকি?
হ্যাঁ, তাতো জানিই।
তবে যে! সূর্যসেন বলো কিংবা তার বিপ¬বী শিষ্যদের কথাই বলো, মৃত্যুর পর তারা সবাই তো সুতোকাটা ঘুড়ির মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছে! তোমার সঙ্গে সেইসব সুতোকাটা ঘুড়িদের বুঝি দেখা হয়নি কখনো!
বাচাল ঘুড়ি এতক্ষণে লজ্জা পায়।
তারও দেখা হয়েছে অনেক সুতোকাটা ঘুড়ির সঙ্গে। অনেকের পরিচয় সে জেনেছে। তাদের অনেকেই পাকিস্তান আমলের লোকজন। কেউ বা বাংলাদেশ আমলেরও। তাই বলে এত প্রাচীন সব বটবৃক্ষের সঙ্গে তার হয়নি পরিচয়। সে জানতে চায়,
আচ্ছা তোমার সঙ্গে কি ক্ষুদিরাম বসু কিংবা প্রফুল¬ চাকীর দেখা হয়েছে?
হবে না কেন, তারাও তো সুতোকটা ঘুড়ি হয়েই মিশে আছে আমাদের মাঝে?
আর প্রীতিলতা? নন্দনকানন গার্লসের টিচার?
প্রশ্ন শুনে এইবার হা হা করে হাসে লেজকাটা ঘুড়ি। হাসির গমক কমে এলে বলে, প্রীতিলতা এ দেশে সকলের বোন হয়ে বেঁচে আছে।
উত্তরে যেন ঠিক মন ভরে না। তাই সে প্রশ্ন করে,
কেন ঘুড়ি হয়নি, সুতোকাটা ঘুড়ি?
না রে ভাই। বোনটি আমাদের দলে না এসে চলে গেছে প্রজাপতির দলে।
তাই নাকি!
তবে আর বলছি কী!
অমা, আমি তখন একটা প্রজাপতি দেখে গান ধরলাম যে!
ওটা প্রজাপতি কোথায়। ওটাই তো বোন প্রীতিলতার অন্যরূপ। কী অপরূপ সৌন্দর্য। পাখায় পাখায় কত না রঙের কারুকাজ! দেখলে যে কারো চোখ জুড়াবেই। হায় প্রীতিলতা!
বলবার ভঙ্গি দেখে বাচাল ঘুড়িরও বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে একটু গলা নামিয়ে বলে,
আমার যে আরো একজনের কথা খুব মনে পড়ছে!
কার কথা? নাম বলো।
সেও ভীষণ বিপ¬বী নারী।
আহা, কার কথা বলছ!
নাচোলের ইলা মিত্র।
সে তো সকলের রানি মা! চিনি চিনি, খুব চিনি।
সেই রানি মা কি সুতোকাটা ঘুড়ি হয়েছে? তুমি জানো?
না, সুতোকাটা ঘুড়ি হবে কেন সে? তার তো অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি!
কৃষকের তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল। সে সব জঘন্য কথা মুখে উচ্চারণ করাও যায় না।
তবু সেই রানি মার মৃত্যু হয়নি।
রাগে দুঃখে ক্ষোভে অপমানে রানি মা এ দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এ পারে পড়ে থাকে তার সারা জীবনের লড়াই সংগ্রামের মাঠ, ছড়িয়ে থাকে তার সহযোদ্ধা আদিবাসীরা।
এই তো কয়েক বছর আগে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে কলকাতায়।
তারপর থেকে রাণি মা দোয়েল পাখি হয়ে গেছে। এ দেশের হাজার হাজার দোয়েল পাখির মধ্যে কোথাও তিনি লুকিয়ে আছেন।
সুতোকাটা ঘুড়িদের মধ্যে একটা ছিল বৃটিশবুড়ো। আড়ালে আবডালে নয়, অন্যান্য সুতোকাটা ঘুড়ি তাকে প্রকাশেই বৃটিশবুড়ো বলে ডাকে। তাতে সে কখনো বিশেষ রাগ করে না। বরং মুচকি মুচকি হাসে। তাকে বেশি খোঁচাখুঁচি করলে সে দিব্যি ঠোঁট উল্টিয়ে বলতে পারে,
খুঁচিয়ে লাভ নেই ভায়া, মনে রেখÑসুতোকাটা ঘুড়ির আর মৃত্যু নেই। হ্যাঁ।
এমনই দার্শনিক কথাবার্তা তার। কখনো ইতিহাস, কখনো দর্শন, কখনো বা রাজনীতি এ সব প্রসঙ্গে সে অবিরাম কথা বলতে পারে। বলা উচিত এসব নিয়ে কথা বলতে সে পছন্দ করে, আনন্দ পায়। কখনো কখনো শ্রোতারা ধৈর্য হারিয়ে ফেললেও তার কিছুতেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না। সেদিন সুতোকাটা ঘুড়িদের সমাবেশে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়Ñমৃত্যুকে যারা ভয় করে, একবার দুবার নয় তাদের মরতে হয় বারবার। তবে মানবজনম একবারই ঘটে। তারপর আসে কুকুর বেড়ালের মতো মানবেতর জন্ম। আবার মৃত্যু। আবার জন্ম। আর আমরা তো কখনো মৃত্যুকে ভয় করিনি, সাহসের সঙ্গে আলিঙ্গন করেছি; তাই আমরা বেঁচে গেছি। এই যে সুতোকাটা ঘুড়ি হয়ে দিব্যি আছি। আমাদের আবার মৃত্যু কিসের!
অন্য এক সুতোকাটা ঘুড়ি এগিয়ে এসে বলে,
মৃত্যু নেই মানছি। বেঁচে থাকারও জ্বালা অনেক। দু’চোখে দেখা দৃশ্যগুলো তো ভোলা যায় না কিছুতেই। মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়। মনকে দগ্ধায়।
বৃটিশবুড়ো হাসে।
তা ঠিক বলেছ। দেখা মানেই জ্বালা।
হ্যা, না-দেখার তো অসুবিধা নেই। মনগড়া একটা কিছু বলে ফেললেই হলো। তার পেছনে হাততালি দেওয়ার লোকের হবে না। সঙ রেডি হয়েই থাকে। চোঙা ফুঁকলেই হলো।
কী নির্লজ্জ দ্যাখোÑএকেবারে নির্ভেজাল মিথ্যে বলতেও জিভে বাধে না ওদের!
ওই যে তুমি বললেÑদেখা মানেই জ্বালা!
এতক্ষণ পর আরেক সুতোকাটা ঘুড়ি এসে এদের আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়ে। সে দাবি জানায়,
নারে ভাই, দেখার মধ্যে সুখও আছে। অনেক সুখ। অশেষ সুখ।
বলতে বলতে তার গলা ধরে আসে, চোখ ভিজে আসে। বৃটিশবুড়ো তবু বলে,
কী রকম?
সে সুখের কথা কি ভোলা যায়! সেদিন ছিল মার্চের রোদ ঝলমলে সোনালি আকাশ। ঢাকার আকাশে আমি উড়ছি উড়ছি। উড়তে উড়তে শেষে এই রেসকোর্স ময়দান। এখন মহান নেতা সোহরাওয়ার্দীর নামে উদ্যান হয়েছে। আকাশে বাতাসে সে কী গুঞ্জনÑআজই হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজই ঘোষণা হবে।
বৃটিশবুড়ো মনের মতো বিষয় পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে,
লাখো জনতার কণ্ঠে সেই সব ¯ে¬াগান মনে আছে তোমাদের? তুমি কে আমি কেÑবাঙালি বাঙালি। তোমার দেশ আমার দেশÑবাংলাদেশে বাংলাদেশ। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
আহা, বাঙালির এমন একতা আর কখনো কেউ দেখেছে? স্বাধীনতার জন্য সারা দেশের মানুষের এমন ঐক্য, এমন আকাক্সক্ষা আর উত্তেজনা, সে কি ভোলা যায় কিছুতেই?
বৃটিশবুড়ো আবারও মিটমিট করে হাসে,
ভোলা তো যায় না। কিন্তু ভুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে স্বাধীনতার পর থেকেই। একটা বদমাশ মহল তো বাঙালির বাঙালিত্বই ভুলিয়ে দিতে চায়। বদল হয় অনেক কিছুর, তাই বলে জাতি-পরিচয় কি বদলায়?
ওরাই তো স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক বাধায়। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে হানাহানি বাধায়!
এরই মাঝে সাতই মার্চের কল-রেডি মাইক্রোফোনের গমগমে ধ্বনি ভেসে আসছে। বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত প্রবাহিত জনসমুদ্রের গর্জন কি ছিল এমনই মেঘমন্দ্রিত? সুতোকাটা ঘুড়িদের সমাবেশ কানায় কানায় পূর্ণ। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দচন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ পণ্ডিতেরা সুতোকাটা ঘুড়িদের ইস্কুলে ছুটি দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সমাবেশে। সাংবাদিক সিরাজুউদ্দীন হোসেন, শহীদুল¬াহ কায়সার, সেলিনা পারভীন কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসেছেন জনসভার নিউজ কভার করতে।
পদ্মফুলের আকৃতিতে সাজানো মঞ্চে বসে আছেন জাতীয় চার নেতাÑতাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী। এদের মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন প্রধান অতিথি শহিদ জননী জাহানারা ইমাম। অনুষ্ঠান উপস্থাপনের জন্যে মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ায় এক কিশোর। মাথা ভর্তি চুল। বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ। চেহারাটি ভরাট হয়ে উঠলে এবং কালো ফ্রেমের চওড়া ডাণ্ডির চশমা পরিয়ে দিলে যে-কেউ আঙুল উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠতে পারেÑওই যে আমাদের নেতা ফিরে এসেছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু!
মাইক্রোফোন কড়কড় করে ওঠে। কী আশ্চর্য! কিশোরকণ্ঠ এমন বজ্রনির্ঘোর্ষ হলো কী করে! শ্রোতা সাধারণ উৎকর্ণ হয়Ñআমাদের শুনতে ভুল হচ্ছে না তো! এ যে সেই আকাশ-কাঁপানো কণ্ঠ! ওই কণ্ঠ কি এখনই গর্জে উঠবে; এবারের সংগ্রাম...? নাহ্; ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তো বলা হয়ে গেছে সেই কবে! আবারও সংগ্রাম! আর কত সংগ্রাম!
মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে উপস্থাপক শুরু করে,
আমি শেখ রাসেল।
‘শেখ মুজিবের ছেলে’ শুধু এই পরিচয়ের অধিকারে আজ এখানে আমি আসিনি। এটা সুতোকাটা ঘুড়িদের সমাবেশ, আমি এসেছি সুতোকাটা ঘুড়ির অধিকারেই। আমার জীবনের পূর্ণতার সুতো ছিঁড়ে গেছে সেই অন্ধকার পঁচাত্তরে। ‘মুজিবের ছেলে’Ñএ ছাড়া কীইবা অপরাধ ছিল আমার!
জননী সাহসিকা জাহানারা ইমাম মাইক্রোফোনে এসে প্রথমেই বলেন, রাসেলের আবেগকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। আপনারা কেউই জীবন-লাটাইয়ের সবটুকু সুতো পূর্ণব্যবহার করতে পারেননি। মেনে নিয়েছেন সুতোকাটা ঘুড়ির জীবন। আপনাদের এ সমাবেশে এসে আমি সম্মানিত বোধ করছি।
এরপর তিনি ধীরে ধীরে জানান প্রায় নিভে যাওয়া, আগুন তিনি কী ভাবে আবার জ্বেলে দিয়েছেন; থেমে যাওয়া যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খুলেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধাপরাধী বিচার চলছে দেশে। একটি বিশেষ মহল এই বিচারকে বিঘিœত করতে চায় বলে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়... ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ছড়াতে চায়..
বাচাল স্বভাবের সুতোকাটা ঘুড়িটি বক্তৃতার মাঝখানে ছুটে আসে বৃটিশবুড়োর কাছে। হন্তদন্ত হয়ে জানতে চায়Ñএত বড় সমাবেশে বঙ্গবন্ধু কই? তিনি কি সুতোকাটা ঘুড়ি হননি?
বৃটিশবুড়ো এ প্রশ্নের উত্তর যেন গুছিয়ে উঠতে পারে না, অসহায়ভাবে তাকায় সামনে বসে থাকা অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর দিকে। বিনম্রভাবে জানতে চায় বঙ্গবন্ধু কোথায় স্যার?
চোখের চশমা নামিয়ে মুনীর চৌধুরী জানানÑতারও সুতোকাটা ঘুড়ির জীবন। তবু তিনি ইচ্ছে করেই ঘাসফুল হয়েছেন। দেশের মাটির সঙ্গে মিশে থাকেন সারাক্ষণ। তিনি সকলের সঙ্গেই আছেন।
বৃটিশবুড়ো নিশ্চিত হবার জন্যে পুনর্বার শুধায়, সত্যিই আছেন?
গভীর প্রত্যায়ের সঙ্গে ঘোষণা করেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী,
অবশ্যই আছেন। চিরসবুজ বঙ্গবন্ধু এই বাংলা ছেড়ে কোথায় যাবেন! তিনি আছেন, আমাদের সঙ্গেই আছেন।
শীর্ষ সংবাদ: