ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাত বাড়ালেই বন্ধু

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৪ আগস্ট ২০১৮

হাত বাড়ালেই বন্ধু

শায়লা আর রূপসা দুজনেই ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুলের ক্লাস সেভেনে পড়ে। কিন্তু দুজন একে অপরের বন্ধু নয়। বন্ধু তো দূরের কথা, ওরা একে অপরের সঙ্গে ঠিকমত কথাও বলে না। প্রায়ই ছোটখাটো বিভিন্ন বিষয়ে ঝগড়া বেঁধে যায় ওদের। অথচ দুজনেই খুব ভাল মেয়ে। সবাই ওদের খুব পছন্দ করে। কিন্তু ওরা দুজন দুজনকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। শায়লা প্রতি বছরই পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। পড়ালেখায় ভীষণ ভাল। শুধু যে ক্লাসের পড়ায় ও মনোযোগী এমন নয়। ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি সাধারণজ্ঞানেও বেশ পটু। তাই তো যে কোন কুইজ প্রতিযোগিতায় স্কুলকে বিজয়ী করতে তার তুলনা হয় না। অন্যদিকে, রূপসার গাওয়া গানের সুনাম স্কুলজুড়ে। তার সুরের মায়ায় মুগ্ধ হয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে হওয়া স্কুল সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় সেরা কণ্ঠ হিসেবে বিশেষভাবে বিচারকদের কাছ থেকে বাহবা পেয়েছে। এছাড়া রূপসা খুব সুন্দর নাচতেও পারে। স্কুলের যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর নাচ দেখে মুগ্ধ হয় দর্শকরা। তবে ওর রেজাল্ট শায়লার মতো ভাল হয় না। আর এজন্যই রূপসাকে শায়লা তেমন একটা পছন্দ করে না, একইভাবে রূপসাও। তাই তো দুজনের মাঝে প্রায় প্রতিদিনই কিছ ুনা না কিছু একটা নিয়ে এমনকি ক্লাসে টিচারের সামনেই ঝগড়া বেঁধে যায়। যার জন্য ক্লাসের অন্যদেরও বেশ ভুগতে হয়। ঠিক একইভাবে আজকেও ক্লাসে টিচারের সামনে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেছিল ওদের। বোঝানোর পরও যখন ওরা থামছিল না তখন ওদের দুজনের আচরণে বিরক্ত হয়ে টিচার আজকে প্রধান শিক্ষকের কাছেই নালিশ জানিয়েছেন। নিজেদের গুণের পরিচয় দিয়ে শায়লা আর রূপসা দুজনেই স্কুলজুড়ে পরিচিত মুখ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক নাসিমা আক্তারও ওদের দুজনকে খুব ভালভাবে চেনেন। ওদেরকে ভীষণ ভালও বাসেন। তাই ওদের নামে এমন নালিশ শুনে আসলে সমস্যাটা কোথায় হতে পারে, সে নিয়ে তিনি কিছুটা ভাবলেন। এরপর ওদেরই ক্লাসের কয়েক বন্ধুকে ডেকে ওদের সম্পর্কে কথা বলে শায়লা আর রূপসার সম্পর্কে জানলেন। শায়লা আর রূপসার ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্কের দিকটা বুঝতে পেরে পরদিন ক্লাস শুরুর আগে ম্যাডাম ওদের দুজনকে নিজের অফিস রুমে ডেকে পাঠালেন। ম্যাডামের এভাবে ডেকে পাঠানোতে দুজনেই বেশ ভয় পেল। ক্লাসরুম থেকে বের হওয়ার পর কিছুটা পথ এগিয়ে হুট করে থেমে গিয়ে শায়লা বলে উঠল, আচ্ছা রূপসা গতকাল টিচার নাকি আমাদের সবসময় ঝগড়া করার জন্য বড় ম্যাডামের কাছে নালিশ দিয়েছেন। তার জন্যই ম্যাডাম আমাদের এভাবে ক্লাসের আগে ডেকে পাঠিয়েছেন। শায়লার দিকে মুখ ঘুরে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল রূপসা, হ্যাঁ। আমার ভীষণ ভয় করছে। আমারও ভয় করছে। নিশ্চয় আমাদের ওপর খুব রাগ করেছেন। আমাদের কি খুব বকবেন? বকা দিলে কি করবি? সেজন্য কথা বলতেই তো এখানে দাঁড়ালাম। আমার মনে হয় ম্যাডামের কাছে গিয়ে প্রথমেই আমাদের ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত। তাহলে হয়ত উনার রাগটা কমে যাবে। আর আমাদেরও বকা না দিয়ে ক্ষমা করে দেবেন। হ্যাঁ, সেটাই ভাল হবে। চল, যাই তাহলে। বড় ম্যাডামের রুমে সালাম দিয়ে ঢুকল দুজন। এরপর ম্যাডামের কাছে গিয়েই নিজেদের ভুলের কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাইল ওরা। ম্যাডাম দুজনের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ওদের ভয় পাওয়া মুখ-চোখকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করলেন। দুজনকেই উনার সামনের দুটো চেয়ারে বসিয়ে বলেন, ক্ষমা চাইছ কেন তোমরা? আর ভয়ই বা পাচ্ছ কেন? তোমরা কি জান আমি তোমাদের কিসের জন্য ডেকেছি? মাথা নিচু করে থাকা রূপসা ম্যাডামের দিকে মুখ তুলে তাকাল। উত্তর দিল, ম্যাডাম, আমরা জানি আপনি আমাদের সবসময় ঝগড়া করার কথা শুনে রাগ করেছেন। এবারের মতো আমাদের ক্ষমা করে দিন, আমরা আর কখনই ঝগড়া করব না। ম্যাডাম মুচকি হেসে জানতে চাইলেন, তোমরা যে আর কখনও ঝগড়া করবে না সেটা আমি কিভাবে বুঝব? এবার শায়লা উত্তর দিল, আপনার কাছে আসার সময় আমি রূপসাকে ডেকে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। কথা বলে নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছি। আর তার জন্যই প্রথমে এসেই আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছি আমরা। কথা দিচ্ছি, আর কখনও ঝগড়া করে ক্লাসের পরিবেশ নষ্ট করব না। তার মানে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় তোমরা দুজনেই একসঙ্গে কথা বলে ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছ, তাই তো? দুজনেই জবাব দিল, জি ম্যাডাম। তোমরা কি এখান থেকেই বুঝতে পারছ না যে, তোমরা একই ক্লাসে পড়। একজন পড়া-লেখায় খুব মনোযোগী। সবসময় পরীক্ষায় ফার্স্ট হও। অন্যজন পড়ালেখায় একটু পিছিয়ে থাকলেও নাচ-গান ইত্যাদিতে সেরা। দুজনেই দুজনের জায়গা থেকে আমাদের স্কুলের সুনাম ধরে রেখেছ। কিন্তু তোমরা একে অপরকে পছন্দ কর না। আজকের মতো যদি একজন একটু প্রথমে ডেকে যে কোন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে নাও, তাহলে কি এত ঝগড়া হয়! বরং যে কোন বিষয়ে দুজনেই মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিলে কোন ঝগড়াও যেমন হয় না, আবার ঐ কাজটাও খুব সুন্দরভাবে শেষ করতে পার। যেমন দুজনে মিলে প্রথমেই নিজেদের ভুলের কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টাতে আমি খুশি হয়েছি। তোমরা ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে অসাধারণ গুণের অধিকারী। এখন তোমরা যদি একজন অন্যজনের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের গুণ অপর জনের মাঝে ছড়িয়ে দাও, তাহলে তোমাদের আর কোন কমতিও থাকবে না। শায়লা তুমি যদি রূপসাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে ওকে পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোল, তাহলে সেও ভালো রেজাল্ট করবে। আর আমাদের স্কুলের সুনাম আরও বাড়বে। আবার, রূপসা তুমি যদি শায়লাকেও নাচ-গানে পারদর্শী হতে সাহায্য কর, তাহলে সেও নিশ্চয় তোমার মতোই স্কুলের হয়ে অনেক পুরস্কার নিয়ে আসবে, তাই না? রূপসা উত্তর দিল, আপনি ঠিকই বলেছেন ম্যাডাম। আমরা সত্যিই অনেক ভুল করেছি। রূপসার পর এবার শায়লাও একমত হয়ে বলল, আমরা এখন থেকে বন্ধু হয়ে যাব। বন্ধুর মতোই একে অপরকে সাহায্য করে নিজেদের কমতিগুলো পূরণ করে নেব ম্যাডাম। ওদের দুজনের কথায় খুব খুশি হলেন বড় ম্যাডাম। বললেন, এই তো কি সুন্দর বুঝতে পেরেছ তোমরা। জান তো, আগামীকাল বন্ধু দিবস? এই বন্ধু দিবসে ছোট ছোট ভুলগুলো শুধরে দুজনেই দুজনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দাও। দেখবে, সবাই তোমাদের নিয়ে আরও বেশি গর্ব করবে। এবার তোমরা ক্লাসে যেতে পার। ম্যাডামকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। ক্লাসে যেতে যেতে নিজেদের সব ভুলের জন্য একে অপরকে সরিও বলে নিল। আর অপেক্ষায় থাকা সকলে দুজনকে হাত ধরে ক্লাসে ঢুকতে দেখে হাততালি দিয়ে ওদের নতুন বন্ধুত্বটাকে বরণ করে নিল। ২য় বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×