ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লঘুচাপের প্রভাবে বর্ষণ অব্যাহত

চট্টগ্রামে ৩০ পাহাড় নিয়ে ব্যাপক শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৪ জুন ২০১৮

 চট্টগ্রামে ৩০ পাহাড় নিয়ে ব্যাপক  শঙ্কা

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ উপকূলবর্তী এলাকা এবং পাহাড় জুড়ে বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। পাহাড় থেকে নামছে ঢল। আর এ ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এদিকে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ৩০ পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের বড় অংশ ঝুঁকিতেই রয়েছে। বুধবার একে খান পাহাড়ের পাদদেশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে দেড় শতাধিক পরিবারকে সরানো হয়েছে। অপরদিকে, বর্ষণ অব্যাহত থাকায় চট্টগ্রামের রাউজান, হাটহাজারী, রাঙ্গুনীয়া, ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও আনোয়ারার বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। ঈদের প্রাক্কালে টানা বর্ষণের এ ঘটনা জনদুর্ভোগকে ব্যাপকতর করেছে। ঈদের ছুটি শুরু না হলেও অনেকে আগেভাগে ঘরমুখো হয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় অনেককে চরম ভোগান্তির কবলে পড়তে হয়েছে। জেলা জুড়ে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নিম্নাঞ্চলে মঙ্গলবার রাতের ভারি বর্ষণে জলজট সৃষ্টি হয়েছে। মহানগরী অভ্যন্তরে ৪১টি খাল ভরাট হয়ে থাকা এবং কর্ণফুলী সংলগ্ন চাক্তাই খালের মুখ এখনও ডেজিং না হওয়ার কারণে নগর অভ্যন্তর থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতে পারছে না। মূলত এ কারণেই চট্টগ্রাম মহাগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলজট সৃষ্টি হয়ে আছে। বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভারি বর্ষণ না হলেও কখনও হালকা কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি এবং কখনও মাঝারি আকারে বর্ষণ অব্যাহত ছিল। দিনভর আকাশ মেঘলা থাকলেও বৃষ্টি হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। এতে করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে সড়ক ও অলিগলি থেকে পানি নেমেছে। ঈদ বাজারে দুর্ভোগ অপেক্ষাকৃত কমেছে। তবে চট্টগ্রামসহ সমুদ্র বন্দরগুলোর জন্য ৩ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত বহাল রাখা হয়েছে। লঘুচাপের কারণে আজও সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর। এদিকে, বিপর্যয়ের আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বসতি উচ্ছেদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মোঃ ইলিয়াস হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৮৬৪টি পরিবারের একটি তালিকা করা হয়েছিল। কিন্তু ভাসমান হওয়ায় এদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। তবে এর মধ্যে প্রায় ৬ শ’ পরিবারকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বর্ষার আগেই সকল পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বসতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সে কাঁচা ঘরগুলো উচ্ছেদ করা এখনও সম্ভব হয়নি। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অবৈধ বসতি সরাতে তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল এর কোনটিই বাস্তবায়ন কেন করা যাচ্ছে না এর কোন উত্তর মিলছে না। বরঞ্চ কোন কোন পাহাড়ের পাদদেশে নতুন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। মহানগরীতে অধিকাংশ পাহাড়ের মালিকানায় রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। তা পরবর্তীতে আবারও পূর্বের অবয়বে ফিরে আসে। এবারের বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই ভারি বর্ষণ হয়েছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর মাটি নরম হয়েছে। ফলে বিশেষজ্ঞদের অনেকে বড় ধরনের ধসের আশঙ্কাও করছেন। আর যদি এ ধরনের ধসের ঘটনা ঘটে তাহলে যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেও যেতে পারে। বুধবার সকালেও ছিল মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তবে সকাল ৯টার পর মেঘ সরে গিয়ে রোদের আলো দৃশ্যমান হয়। কিন্তু দুপুরের পর আবারও কালো মেঘে সাজতে থাকে আকাশ। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরছিল। এতে করে ঈদে কেনাকাটায় যেমন বিঘœ ঘটে, তেমনিভাবে ভোগান্তির মধ্যে পড়েন ঈদে ঘরমুখো মানুষ। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, বুধবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার, যা আগের দুদিনের তুলনায় অনেক কম। এর আগে গত মঙ্গলবার একই সময়ে ৯৪ দশমিক ২ মিলিমিটার এবং সোমবার ২২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। লঘুচাপ কেটে গেলেও সাগরে সঞ্চালনশীল মেঘমালা রয়েছে। সে কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। মাছ ধরার নৌকা এবং ছোটখাট জলযানগুলোর প্রতি উপকূলের কাছে থেকে নিরাপদে চলাচলের নির্দেশনা রয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানায়, বৃষ্টির প্রকোপ কমলেও সম্ভাবনা এখনও রয়ে গেছে। আরও অন্তত দু’দিন এ অবস্থা বিরাজ করতে পারে। চট্টগ্রামে একটানা বর্ষণের কারণে নগরজীবনে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। নগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকা, ছোটপুল, হালিশহর, শুলকবহর, চকবাজার, মুরাদপুর, ষোলশহর, কাপাসগোলাসহ নিচু এলাকাগুলোতে এখনও পানি রয়ে গেছে। বৃষ্টি কমার ফলে পানি কমলেও চট্টগ্রামে দুর্ভোগের আরেক কারণ সামুদ্রিক জোয়ার। দুবেলা জোয়ারের ফলে পানি স্বাভাবিক গতিতে নিষ্কাশিত হতে পারে না। এবারের বর্ষণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয়েছে ঈদ বাজারে। রোজার একেবারে শেষ দিকে বাড়ি মুখো মানুষ যখন স্বজনদের জন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত তখনই বর্ষার আগমনী। জ্যৈষ্ঠ মাস শেষ না হলেও এই লঘুচাপের মধ্য দিয়ে চলে এসেছে বর্ষা ঋতু। ঈদে স্বজনদের জন্য কিছু না কিনলেই নয়। আর সে কারণে বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও মানুষকে যেতেই হচ্ছে বিপণি কেন্দ্রে। অপেক্ষাকৃত স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ছাদে আচ্ছ্বাদিত মার্কেট থাকলেও খুবই কষ্টের মধ্যে পড়েছেন দরিদ্ররা। কেননা, তাদের ভরসা খোলা আকাশের নিচে ফুটপাতে বসা পসরা। অনেক কষ্ট সয়ে তাদের ঈদ বাজার সারতে হচ্ছে। বিক্রেতারাও রয়েছেন অনেকটা বেকায়দায়। কোন রকমে বাঁশের কঞ্চিতে পলিথিন বেঁধে পণ্য সামগ্রী রক্ষার চেষ্টা। অনেকেই জানাচ্ছেন, বৃষ্টির কারণে পণ্য নষ্ট হয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছেন। এছাড়া ভারি বর্ষণের কারণে সড়ক ও নালা উপচে অনেক স্থানে পানি ঢুকে পড়ে মার্কেটের নিচতলায়। এতেও তাদের ব্যবসার ক্ষতি হয়। ঈদের আর মাত্র দুদিন বাকি। আবহাওয়ার কিছুটা উন্নতি বুধবার পরিলক্ষিত হলেও শঙ্কা কাটেনি। লঘুচাপের প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। তবে আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, দুদিন পর থেকে পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও এর মধ্যে যেহেতু বর্ষাকাল এসে পড়েছে সেহেতু দীর্ঘমেয়াদে ভাল পরিস্থিতি আশা করা যায় না। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, বর্ষণ, বাতাস ও স্রোতের কারণে বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য লাইটারিং বুধবারও ব্যাহত হয়। ছোট জাহাজ চলাচলের ওপর সতর্কতা জারি রয়েছে। তবে জেটিতে কন্টেনার হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক রয়েছে। ঈদ চলে আসায় বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি স্বাভাবিকভাবেই কমেছে। কেননা, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটিও শুরু হয়ে গেছে। তাছাড়া ঈদে বাড়িমুখী যাত্রীদের যাত্রা নির্বিঘ্ন রাখতে মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচলের ওপর বিধি-নিষেধও রয়েছে। পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ ॥ টানা বর্ষণের কারণে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো উচ্ছেদে অভিযান অব্যাহত রেখেছে জেলা প্রশাসন। বুধবার দুপুরে নগরীর একে খান পাহাড় এলাকায় অভিযান পরিচালিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দেলোয়ার হোসেন। এদিন সেখান থেকে ১৫টি বসতি উচ্ছেদ করা হয়। যাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের জন্য চালু করা হয় সাতটি আশ্রয় কেন্দ্র। এ বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ে গড়ে উঠা বসতিতে কোন পরিবারকে থাকতে দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রশাসন। বসবাসকারীদের সরানোর পাশাপাশি অবৈধ বসতি ভেঙ্গে দেয়ার কাজটিও চলমান রয়েছে।
×