ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৯ মে ২০১৮

ঢাকার দিনরাত

ঢাকার পথে পথে এখন নতুন পতাকাঅলার দেখা মিলছে। চার বছরে এমন সুযোগ একবারই আসে। তাই স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস উপলক্ষে যারা জাতীয় পতাকা বিক্রি করেন পথে পথে, তারা তো বটেই, অন্য মৌসুমী ফেরিঅলারাও বিশ্বকাপ ফুটবলের নানা মাপের পতাকা বিক্রি করেন বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে। তবে বলাবাহুল্য সেখানে বিক্রির জন্য আমাদের জাতীয় পতাকা থাকে না, যদিও জাতীয়ভাবে দুই ভাগ হয়ে যাওয়া দুই দলের অনুরাগীদের চাহিদা অনুযায়ী থাকে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলÑ এই দুই দেশের জাতীয় পতাকা। আমাদের গলিতেও দেখলাম দুদিন দু’জনকে পতাকা নিয়ে হেঁটে যেতে। ওই দুই দেশের বাইরে অন্য কোন দেশের পতাকা তেমন একটা চোখে পড়ে না। বাঙালী সত্যিই হুজুগে জাতি। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় বাঙালীর উন্মাদনা উচ্চকিত হয়ে ওঠে। এদিকে আইপিএলের আসরে যে আমাদের সাকিবের দল ফাইনাল খেলল, তা নিয়ে বিশেষ বাড়াবাড়ি নেই। তবে হ্যাঁ, রাস্তার ধারের টিভি সেট বিক্রির দোকানগুলোর সামনে এখনও যথারীতি ভিড় দেখি। ভিড় একটু বেশিই থাকে যেদিন সাকিবের দল সানরাইজার্স হায়দারাবাদ খেলে। আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের ফুটবল দলে আমাদের কোন খেলোয়াড় নেই, তবু ওই দুই দলের অনেক খেলোয়াড়কেই আমরা নিজেদের দেশের ছেলেই মনে করি। বাঙালীর এই আবেগ সম্ভবত বিশ্বে অদ্বিতীয়। বিস্ময়করভাবে বিপরীতমুখী বুধ ও শনি- গত সপ্তাহে এই দুটি দিনে ঢাকার হালচাল ছিল বিস্ময়করভাবে বিপরীতমুখী। বুধবার পঞ্জিকা অনুযায়ী জ্যৈষ্ঠ মাসের নয় তারিখ, মানে গ্রীষ্মের উত্তুঙ্গ এক সময়। থাকবে হাঁসফাঁস গরম, রীতিমতো দাবদাহই বয়ে যাবে ঢাকার ওপর দিয়ে। অসহনীয় গরমে ধ্বস্ত নাকাল মানুষ বারেবারে চাইবে আকাশের দিকে, ইশ একটু যদি বৃষ্টি হতো। এমনটাই তো স্বাভাবিক এই ঋতুবৈচিত্র্যের দেশে। কিন্তু সেদিন ছিল পুরোদস্তুর শ্রাবণ মাসের সবচেয়ে বর্ষণমুখর একটি দিনের মতো। পানিতে সয়লাব রাজধানীর বড় বড় রাস্তা। জনকণ্ঠেই পরদিন বিমানবন্দর সড়কে ঢেউ তুলে চলা প্রাইভেট কারের ছবি ছাপা হলো। প্রধান শিরোনাম হলো- টানা বর্ষণে জনদুর্ভোগ। এখন ঢাকায় বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা। সঙ্গত কারণেই চলতি সপ্তাহের ‘সমাজ ভাবনা’ তথা জনমত প্রকাশের সাপ্তাহিক বিশেষ বিভাগের বিষয় হলো- বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতা নিয়ে কিছু কথা বলার আগে শনিবারের কথায় ফিরি। এদিন আবার ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের মতোই তীব্র গরম। সূর্য ছিল সম্ভবত বছরের সবচেয়ে শক্তিধর আগ্রাসীর ভূমিকায়। চলতি রমজানে রোজাদাররা প্রথম টের পেলেন গ্রীষ্মকালের রোজা কতটা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। বেলা না বাড়তেই গলা শুকিয়ে কাঠ। রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে জলাবদ্ধ এলাকার সংখ্যাও। সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি জমে থাকছে। আর ঢাকায় জলজট মানেই অসহনীয় যানজট। রেকর্ড রাখার প্রয়োজনে পরিসংখ্যান রাখা। গত বছর সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছিল ১৫টি এলাকা। এলাকাগুলো হলোÑ শান্তিনগর, মালিবাগ ও মৌচাক, ধানম-ি ২৭ নম্বর রোডের সংযোগস্থল, মতিঝিল, পুরাতন ঢাকার নাজিমুদ্দিন ও উমেশ দত্ত রোড, বংশাল রোড, বঙ্গভবন ও টিকাটুলির অভয় দাস লেন, মুগদা, গ্রিন রোড, কাঁঠালবাগান, কারওয়ানবাজার, তেজকুনিপাড়া ও তেজতুরী বাজার গার্ডেন রোড, মিরপুরের ১০ নম্বর ও কাজীপাড়া, খিলক্ষেত ও উত্তরা ৪ নম্বরের কিছু অংশ। এবার এই তালিকায় যোগ হলো মনিপুর, শেওড়াপাড়া ও বিজয় সরণি। মেট্রোরেলের জন্য রাস্তা খুঁড়বার কারণেও কোন কোন এলাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়েছে, সেটাও মনে রাখছি। রমজানে রাস্তা ও যাত্রী দেখতে দেখতে দশম রোজা অতিক্রম করলাম। রোজার মাসে ঢাকার দিন ও রাতে কিছু বড় পরিবর্তন আমাদের নজরে আসে। অফিসের সময়সূচীতে পরিবর্তন আসে বলে নাগরিক জীবনধারা কিছুটা বদলে যায়। সরকারী, বেসরকারী চাকরিজীবী, অন্যান্য পেশাজীবী, ছাত্র-বেকার সবার মধ্যে একটা তাড়না থাকে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ইফতারি করার। ফলে সন্ধ্যার আগের তিনটে ঘণ্টা ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কের ওপর চাপ বেড়ে যায়। (এবার দেখছি সকাল থেকেই জনচাপ, যানবাহনের চাপ) চলমান যানবাহনের ভেতর যত যাত্রী অবস্থান করে সে সময়টাতে, তার চেয়ে বরং বেশি মানুষ থাকে যানবাহনে ওঠার প্রতীক্ষায় রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে। রাস্তায় হেঁটে চলা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। রাস্তা ভর্তি যানবাহন, রাস্তার দুই পাশে, ফুটপাথে এমনকি রাস্তার ভেতরে খালি জায়গায় মানুষ গিজগিজ করতে থাকে। বেশ কিছু পাবলিক বাস এই সময় নগরীর অতিভিড়াক্রান্ত কয়েকটি এলাকার বাস স্টপেজে রাখা হলে কিছু চাপ যে কমে, তাতে সন্দেহ নেই। একবার ফার্মগেটে কয়েকটি ডবল ডেকার রাখা হয়েছিল অফিস ছুটির পর যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে। শুধু ফার্মগেটে নয়, আরও কয়েকটি জায়গায় যাত্রীসুবিধার কথা ভেবে বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা নেয়া হবেÑ ঢাকার বাসযাত্রীরা এমনটা ভাবতেই পারেন। এখনও পর্যন্ত এমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কর্তৃপক্ষ অতীত থেকে আর কী শিক্ষা নিলেন? আরেকটা বিষয় অস্বীকারের উপায় নেই যে রমজানে বাড়তি রোজগারের জন্য হোক, কিংবা কেনাকাটা ও বেড়ানোর জন্য হোক ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে যায়। এমনিতেই ঢাকা পরিণত হয়েছে জটিল জনারণ্যে। তার ওপর এই বড়তি চাপ কিছুতেই নিতে পারে না নগরটি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। রাজপথ বেহাল দশায় পতিত হয়। বিবেচনায় ইফতার রকমারি ঐতিহ্যবাহী ইফতারের জন্য ঢাকার সুনাম আছে। শুধু কি পুরনো ঢাকায়, ঢাকার বর্ধিত অংশেও বাহারি ইফতারি বিক্রি হয়। উত্তরায় নামী রেস্টুরেন্টগুলো এ সময় শামিয়ানা টানিয়ে বিচিত্র ইফতারি আইটেমের প্রদর্শনী করে। আবার মার্কেট ভবনের নিচে ফুটপাথ সংলগ্ন প্রাঙ্গণেও ইফতার বিক্রির ব্যবস্থা নেয়া হয়। গুনে দেখেছি কমপক্ষে ২৬টি আইটেম এসব জায়গায় বিক্রি হয়। পিৎজা, বার্গারের মতো ফাস্ট ফুডের আইটেমগুলো যুক্ত হওয়ায় ইফতারির পদও বেড়ে যায়। সেইসঙ্গে শাসলিক, মোমো-র মতো অভিজাত রেস্টুরেন্টের চাহিদাসম্পন্ন খাবার আইটেমগুলোও ইফতারির অন্য খাদ্যদ্রব্যের পসরায় যোগ করা হয়। এবারই ঢাকায় প্রথম দেখলাম তেলছাড়া ইফতারির বিক্রয়কেন্দ্র। প্রাচীন নগরী ঢাকার ইফতার ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র চকবাজার। এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার ইফতার মানেই যেন চকবাজারের লোভনীয় খাবারের আয়োজন। কালক্রমে এর কদর যেন বেড়েই চলছে। এখানকার ঐতিহ্যের আদি স্থাপনাগুলো এখন আর নেই। কিন্তু রয়ে গেছে ইফতারির ঐতিহ্য। সেই চির-পরিচিত হাঁক-ডাক। রাস্তার মাঝখানে সারি সারি দোকান। ভোজনরসিক মানুষের ভিড়। সেই ভিড়ের ভেতর থেকে বিক্রেতার কণ্ঠে শোনা যায় ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়।’ পাওয়া যায় সুতি কাবাব, জালি কাবাব, টিকা কাবাব, ডিম চপ, কবুতর-কোয়েলের রোস্ট, খাসির রান, গোটা মুরগি ফ্রাই, মুরগি ভাজা, ডিম ভাজা, পরোটা, শাহী কাবাব, সাসলিক, ভেজিটেবল রোল, চিকেন রোল, খাসির রানের রোস্ট, দইবড়া, হালিম, লাচ্ছি, পনির, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, মাঠা। আর পরিচিত খাবারের মধ্যে বেশি পাওয়া যাচ্ছে কিমা পরোটা, ছোলা, মুড়ি, ঘুঘনি, সমুচা, বেগুনি, আলুর চপ, পিঁয়াজু, জিলাপিসহ নানা পদের খাবার। রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজন এখন প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। অনেক বিত্তবান ব্যক্তি এবং সামাজিক সংগঠন দুস্থদের জন্য ইফতারির আয়োজন করে থাকে। তবে দুস্থ পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের কথা তেমন শোনা যায় না। গত রোজায়ও আমরা জনকল্যাণের দৃষ্টান্ত দেখেছিলাম ঢাকায়। পুরনো ঢাকার নাজিরাবাজার বাংলা দুয়ার পঞ্চায়েত কমিটি তিন শ’ দুস্থ পরিবারের মাঝে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী বণ্টন করেছিল। মানুষ মানুষের জন্য। ইফতার ও ঈদের কেনাকাটায় অনেক অপচয়ও হয়। কৃচ্ছ্রতা সাধনের কথা বলছি না, অন্তত অপচয় হ্রাস করা যে দরকার, সেটা বলা চাই। ঢাকার প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের জনকল্যাণমূলক সামাজিক উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দু’তিন জন ছাত্র উদ্যোগটি নিলেই তাতে ধীরে ধীরে লোকবল বাড়বে। একবার এই নিয়ম চালু করা গেলে প্রতিটি রমজানেই তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন কিছু হবে না। এজন্য প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। গ্যাস-বিড়ম্বনা শীতে সাধারণত ঢাকায় বেশ কয়েকটি এলাকার বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কম থাকে। বিগত বছরগুলোতে যে সব এলাকায় (বিশেষ করে পুরনো ঢাকায়) এ সমস্যা ছিল সেসব স্থানে একই সমস্যা বিরাজ করতে লক্ষ্য করা গেছ এবারের শীতেও। বরং সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নতুন নতুন এলাকা। উত্তরায় আছি একযুগ, গত বছরই প্রথম গ্যসের সঙ্কট দেখেছিলাম। চলতি বছর যা বড় ধরনের বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দিয়েছে অন্তত আমাদের মহল্লায় এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি। রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় দিনের বেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাসের চাপ কম থাকায় রান্নার কাজে বিঘœ ঘটেছে। আবার অনেক সময় পুরোপুরি বন্ধও ছিল গ্যাস। এটা ঠিক যে কারিগরি ত্রুটি, পাইপ লাইনে ময়লা জমে থাকা, রক্ষণাবেক্ষণের কাজসহ নানা কারণে ঢাকায় কোন কোন এলাকায় গ্যাস সরবরাহে বিঘœ ঘটতেই পারে। কিন্তু নিয়মিতভাবে এ অবস্থা চললে সেটি দুর্ভোগের পর্যায়ে চলে যায়। গ্যাসের মজুদ কমে আসছে- এটা সত্য। আবার গ্যাসের চাহিদাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। বিদ্যুত সরঞ্জাম ব্যবহার করেও আংশিকভাবে রান্না করছেন বহু ঢাকাবাসী। সেক্ষেত্রে আবার বিদ্যুতের খরচ ও চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে, আবার সমাধানের পথও বের হয়ে আসছে। ঢাকাবাসী হয়ে উঠছে সর্বংসহা নাগরিক। কথা হচ্ছে এই গ্রীষ্মে, বলা ভাল এই রমজানেও চলছে গ্যাস সঙ্কট। মানুষ বাধ্য হয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন ইফতারির আয়োজনের জন্য। ঢাকার যেসব এলাকায় গ্যাসের সমস্যা বছরজুড়েই রয়েছে, এ রমজানে ওই এলাকাগুলোতে সরবরাহও প্রায় বন্ধ। দিনের বেলা গ্যাস থাকে না। রাত ৯টা-১০টার পর চুলায় যে গ্যাস আসে তা দিয়ে নিভুনিভু চুলা জ্বলে। আবার রাত ১২টা-১টা নাগাদ গ্যাস বন্ধ হয়ে যায়। এ টিমটিম আগুনে রাত জেগেও রান্না শেষ করতে পারেন না গ্রাহকরা। আবার কিছু এলাকায় গ্যাস থাকে রাত ৩টা-৪টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত। কয়েকটি এলাকায় সারা দিন মৃদু গ্যাস সরবরাহ থাকলেও বিকাল থেকে ইফতার এবং সেহরির সময় গ্যাস নেই। এই অবস্থায় রমজানের সেহরি-ইফতার তৈরি বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২৭ মে ২০১৮ [email protected]
×