ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলের লাঙল

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ২৫ মে ২০১৮

নজরুলের লাঙল

১৯২৪ সালে হুগলিতে প্রথম গান্ধীজির সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। তাঁর আগমন উপলক্ষে নজরুল কবিতা ও গান রচনা করেছিলেন। যা শুনে গান্ধীজি খুবই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু নজরুল উপলব্ধি করেছিলেন যে, গান্ধীজির আন্দোলনে দেশের স্বাধীনতার পথ সুগম হবে না। তাই তাঁর মন জনগণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই বিষয়টি নিয়ে নজরুল তাঁর বন্ধু কুতুবুদ্দীন আহমদ, হেমন্ত কুমার সরকার ও শামসুদ্দীন হুসয়নের সঙ্গে আলাপ করেন। এক সময় স্থির সিদ্ধান্ত হয়, তারা চারজন উদ্যোগী হয়ে একটি দল গঠন করবেন। প্রথমে দলটির নাম ঠিক হয়Ñ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত ‘লেবর স্বরাজ পার্টি’ (The Labour Swaraj Party of the Indian National Congress)। এই দলের প্রথম ইশতিহার কাজী নজরুল ইসলামের দস্তখতে প্রকাশিত হয়েছিল। পার্টি গঠন হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখপত্ররূপে সাপ্তাহিক লাঙল প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালে লাঙলের প্রথম খ- বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ‘লেবর স্বরাজ পার্টি’র অফিসের জন্য কলকাতা ৩৭ নম্বর হ্যারিসন রোডের দোতলায় দু’খানা কামরা ভাড়া নেয়া হয়েছিল। এই ঠিকানা হতেই লাঙল পত্রিকার প্রকাশনা আরম্ভ হয়। লাঙলের প্রধান পরিচালক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের নাম ছাপা হতো। আর সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো নজররুলের বাঙালী পল্টন জীবনের বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের। শেষের তিনটি সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন শ্রী গঙ্গধর বিশ্বাস। এ পর্যায়ে লাঙল পত্রিকায় নজরুলের সম্পৃক্ততা বা লাঙল বিষয়ক বিশদ বিবরণের আগে সাংবাদিক নজরুল ও বিভিন্ন সংবাদপত্রে নজরুলের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ বলিÑ দৈনিক, অর্ধ সাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা মিলে নজরুল নবযুগ, ধূমকেতু, লাঙল, ঘনবাণী, নওরোজ, সেবক, সওগাত, বুলবুল, মোহাম্মদী, বসুমতী, ভারতী, বঙ্গবাণী, আত্মশক্তি, নকীব, অভিযান, সাম্যবাদী, মোয়াজ্জিন, দরদী, শান্তি, শিখা, কবিতা, গুলিস্তাঁ, দিলরুবা, উপাসনা, সহচর, প্রবর্তক, নারায়ণ, বিজলী, কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতি, প্রবাসী, উত্তরা, ভারত বর্ষ, বৈতালিক, মোসলেম ভারত, বকুল, জয়তী, বাংলার কথা, বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকা ইত্যাদি পত্রিকায় পরিচালক, সম্পাদক বা ফরমায়েসি লেখক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন। শুধু কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় বা নিয়মিত লেখা বা একটি কবিতা-গান ওই পত্রিকার যে সার্কুলেশন বাড়াতে পারে, পাঠকরা পত্রিকার কপি সংগ্রহের জন্য ভিড় জমাতে পারে, নির্ধারিত কপি শেষ হওয়ার পর পুনর্মুদ্রণ হতে পারে কাজী নজরুল ইসলাম তার অন্যতম উদাহরণ। নজরুলের সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও কোন কোন পত্রিকা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে, সেটাও স্পষ্ট। সরাসরি নাস্তিক, আজাজিল, ইসলামের প্রধান শত্রু বলেও চিহ্নিত করেছে দু-একটি পত্রিকা। কেউ কেউ নজরুলের লেখা নিয়ে প্রকাশ্য ব্যঙ্গ করেছে, প্যারোডি লিখেছে। নজরুল অত্যন্ত চৌকশভাবে তার জবাব দিয়েছেন। এমনও হয়েছে-খুব আগ্রহভরে একটি বিশেষ বিষয়ের ওপর নজরুল উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। কিন্তু দেখা গেল পরের দিন কাগজে তা কাটছাঁট করে ছাপা হয়েছে। দুঃখে অভিমানে নজরুল সেই পত্রিকা অফিসের দিকে আর পা মাড়াননি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি এবং লুপ্ত সংবাদপত্র দৈনিক বাংলার সম্পাদক শামসুর রাহমান সম্পাদক-সাংবাদিক নজরুল নিয়ে মন্তব্য করেছেনÑ‘তার কাছে সংবাদ মূলত কাব্য বলেই বোধ হয় তিনি সম্পাদকীয় স্তম্ভ বার বার সাজিয়েছেন কবিতার পংক্তিমালায়। সম্ভবত আমাদের চেনা বিশ্বে নজরুলের আগে কোন সম্পাদকই কবিতায় সম্পাদকীয় রচনা করেননি।’ মার্চ ১৯২০-এ ৪৯ নম্বর বাঙালী পল্টন ভেঙ্গে গেলে প্রাক্তন সৈনিক হিসেবে পাওয়া রাজস্ব বিভাগের সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নজরুল সাহিত্য-সাধনায় মনোনিবেশ করেন। থাকা শুরু করেন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। কয়েক মাস পর, ১২ জুলাই নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহমদের যুগ্ম সম্পাদনায় সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হয়। কোন পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়াই নজরুল শিরোনাম-রচনা, সংবাদ-সংক্ষেপণ ও দেশপ্রেম-দীপ্ত উত্তপ্ত সম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনায় আশ্চর্য দক্ষতা দেখান। এই নবযুগ দিয়েই মাত্র ২১ বছর বয়সে নজরুলের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। পত্রিকার দুনিয়ায় সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেন। তাঁর সাংবাদিক স্বত্বা নিয়ে প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন। বিশেষ করে পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত নজরুলের লেখা এবং অপরাপর বিষয় নিয়ে কাজ হওয়া জরুরী। এতে একদিকে যেমন সাংবাদিক-সাহিত্যিক নজরুলকে জানা যাবে, অন্যদিকে সে সময়কার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চালচিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। বলেছি, ‘লেবর স্বরাজ পাটি’র মুখপত্ররূপে সাপ্তাহিক লাঙল প্রকাশিত হয়। ৩ মাস ২৯ দিনের মধ্যে ১৫ টি সংখ্যা বের হবার পর লাঙল বন্ধ হয়ে যায়। সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে ভিতরগত কারণ তো ছিলই। প্রকাশিত সংখ্যাগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজালে এক নজরে সন/তারিখ/সপ্তাহ জানা যাবে। খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা দুটি বুধবার এবং অন্যান্য ১৩টি সংখ্যা সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে প্রকাশিত হয়। পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম সংখ্যায় ইংরেজী সন/ তারিখ উল্লেখিত নাই। সপ্তম, ত্রয়োদশ, চতুর্দশ এবং শেষ পঞ্চদশ সংখ্যাঙ্ক অঙ্কে লেখা এবং বাকিগুলো বানান করে। পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম সংখ্যায় ইংরেজী সন-তারিখের কোন উল্লেখ নেই। বর্তমান বানান পদ্ধতির সঙ্গে তখনকার দিনের একটা অমিল তো আছেই। একটি বিশেষ বিষয় হলো প্রথম খণ্ড থেকে পঞ্চদশ খণ্ড পর্যন্ত লাঙল পত্রিকা ভিন্ন-ভিন্ন পৃষ্ঠা সংখ্যা নিয়ে বের হতো। এর মধ্যে ১২টি সংখ্যঅ ১৬ পৃষ্ঠার, ১টি সংখ্যা ১৮ পৃষ্ঠার, ১টি সংখ্যা ২০ পৃষ্ঠার এবং ১টি সংখ্যা ছিল ২৪ পৃষ্ঠার। লাঙল-এর প্রচ্ছদচিত্রে দেখা যায়, একটি গোলাকার বৃত্তের মাঝখানে বলিষ্ঠ গোঁফ-দাড়িওয়ালা ক’জন উদভ্রান্ত কৃষকের ছবি, যার দৃষ্টি নিবদ্ধ উর্ধ আকাশের দিকে। কৃষকের ডান কাঁধে রাখা লাঙল। লাঙল- এর হাতলের অংশটি শক্ত করে ডান হাত দিয়ে ধরা। মনে হয় যেন ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ। বাতাসে চারদিকে গাছ-পালা নুয়ে পড়ছে। কৃষকের কোমরে দৃড়ভাবে গামছা বাঁধা, আদুল গা। আকাশে কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে বিদ্যুতরশ্মি। কালো সুতোয় বাঁধা কৃষকের গলার তাবিজ বাতাসের ঝাপটায় বুকের ওপর থেকে উড়ে কাঁধ পর্যন্ত উঠেছে। বামে প্রধান পরিচালকের নাম, সম্পাদকের নাম, মূল্য। ডানে বিষয়বস্তু। প্রচ্ছদের নিচে বড়ো করে লেখা শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ সম্প্রদায়ের সাপ্তাহিক মুখপত্র, তার নিচে বক্সের মধ্যে খণ্ড, বার, বাংলা-ইংরেজী তারিখ ও সংখ্যা। সম্পাদকীয় নিবন্ধের ওপরভাগে আরও একটি চিত্র লাঙল পত্রিকার ৩ নং পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়। এ দিকে আছে, একটি গোলাকার বৃত্তের মাঝখানে জোড়া বলদ নিয়ে একজন কৃষকের চাষ করার দৃশ্য। কৃষকের হাতে ধরা একটি ছোট চিকন কঞ্চি দিয়ে গরু দুটোকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বর্ণিত প্রচ্চদচিত্র নিয়ে ১১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। দ্বাদশ সংখ্যায় কোন প্রকার ছবি ছাড়া শুধু বড়ো করে ‘লাঙল’ লেখা। তার নিচে ডান পাশে ইংরেজীতে লেখা ‘খঅঘএঅখ’। তার নিচেই ছোট করে অ ডববশষু ড়ৎমধহ ড়ভ ঃযব ইঁমধষ চবধংধহঃং ধহফ ডড়ৎশবৎং চধৎঃু। তার নিচে ৩৭, ঐধৎৎরংড়হ জড়ধফ, ঈধষপঁঃঃধ। বামে পরিচালক-সম্পাদকের নাম, মূল্য, বার্ষিক মূল্য ইত্যাদি। মাঝে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র’। ত্রয়োদশ, চতুর্দশ সংখ্যায় আবারও পরিবর্তন। আশ্চর্যজনকভাবে পরিচালক-সম্পাদকের নাম ছাড়া রবীন্দ্রনাথের আশীর্বচনÑ জাগো জাগো বলরাম ধরো তব মরু ভাঙা হল, বল দাও ফল দাও স্তব্ধকর ব্যর্থ কোলাহল। রবীন্দ্রনাথের এই আশীর্বচনটি ১৩, ১৪ ও ১৫শ’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তবে ১৫ শ’ সংখ্যাটির হেডলাইনে আবারও সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। উপরিভাগে মাঝখানে ‘লাঙল’ এর দু’পাশে কাস্তে ও হাতুড়ি আড়াআড়িভাবে রাখা। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লাঙল-এর ১৫টি সংখ্যার একেকটিতে একেক পরিবর্তন হয়েছে । অসতর্ক অবস্থায় মুদ্রণ প্রমাণসহ প্রকাশের দিন ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বাদ পড়েছে। বানানের ক্রটিও লক্ষ্য করা যায়। প্রথম ১১টি সংখ্যার প্রত্যেকটির তৃতীয় পৃষ্ঠায় প্রতীকী প্রচ্ছদের নিচে মধ্যযুগের অন্যতম পদকর্তা চন্ডীদাসের একটি মানবতার বাণী ছাপা হতোÑ শুনহ মানুষ ভাই সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই। প্রথম সংখ্যার ১১ পৃষ্ঠায় বিখ্যাত শিল্পী চারু রায়ের আঁকা একটি সময়োপযোগী স্কেচ-ধনী মহাজনের হাতের মুঠোয় পিষ্ট হচ্ছে এক শ্রমিক। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে টস্টস্ করে নিচে অপর হাতের তালুতে রক্ত পড়ছে। তার নিচে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা চার লাইন কবিতাÑ পেট পোরা তোর রাক্ষসী ক্ষুধা ধনিক সে নির্ম্মম। দীনের রক্ত নিঙাড়িয়া করে উদর ভূধর সম। সপ্তম সংখ্যায় নবম পৃষ্ঠায় একটি মোটা মানুষের স্কেচ নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতাংশ ছাপা হয়েছেÑ মোটা তাকিয়ায় দিয়ে ঠেস আমরা স্বাধীন করি দেশ ... ... ... আমরা বক্তৃতায় যুঝি ও কবিতায় কাঁদি কিন্তু কাজের বেলায় সব ঢুঁঢুঁ। বলা বাহুল্য লাঙল পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলামের রচনা বেশি গুরুত্ব পেত। ইনার পেজে মূল লেখার খবর বিশেষভাবে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাতে ছাপা হতো। প্রথম সংখ্যার নমুনাÑপ্রচ্ছদের নিচে লেখা, ‘এই সংখ্যায় লাঙলের সর্বপ্রধান সম্পদ কবি নজরুল ইসলামের কবিতা সাম্যবাদী।’ ভেতরে পঞ্চম পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে দশম পৃষ্ঠা পর্যন্ত ‘সাম্যবাদী’র ১১টি গুচ্ছ কবিতা (‘সাম্যবাদী’,‘ঈশ্বর’, ‘মানুষ’, ‘পাপ’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘মিথ্যাবাদী’, ‘নারী’, ‘রাজা-প্রজা’, ‘সাম্য’, ও ‘কুলি-মজুর’) ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে। বাংলা সাহিত্যের কোন কবির কোন কবিতা কোন পত্রিকায় এত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হতো কিনা সন্দেহ। কবির কবিতার বই, গদ্যের বই-এর খবরও আকর্ষণীয় করে বিজ্ঞাপনী ভাষায় ছাপা হতো। উল্লেখ্য, লাঙল-এ ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হবার পরে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়। লাঙল পত্রিকায় দেশী-বিদেশী সাংবাদিক লেখক যারা নিয়মিত-অনিয়মিত লিখতেন তারা হলেন-দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শ্রী গিরিজাকান্ত মুখোপাধ্যায়, শ্রী দেবব্রত বসু, শ্রী যুক্ত হৃষীকেশ সেন, শ্রী নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপ্যাধায়, শ্রী ইন্দ্রজিৎ শর্মা, শ্রী সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রী যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মুজফফর আহমদ, কুতবুদ্দীন আহমদ, শ্রী সুকুমার চক্রবর্তী , শ্রী সুরেশ বিশ্বাস, শ্রী সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আফতাব আলী, কার্ল মার্কস, শ্রী হেমন্ত কুমার সরকার, মৌলবী শামসুদ্দীন হুসেন, মিসেস এম রহমান প্রমুখ। স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রায়-এর উক্তি বা বাণী, বা কবিতাংশ কখনও স্কেচ কখনও স্কেচ ছাড়া ছাপা হতো লাঙল-এ। বিষয়ভিত্তিক ছবি ছাপা হতো চীন রাষ্ট্রগুরু ডাঃ সান ইয়াৎ সেন, সুভাষচন্দ্র বসু, কার্ল মার্কস, লেনিন-এর। শ্রী নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় অনুদিত ধারাবাহিক অনুবাদ প্রকাশিত হতো ম্যাকসিম গোর্কির বিখ্যাত রচনা ‘মা’। দু-একটি সংখ্যায় চিঠিপত্রও থাকত। আর থাকত প্রজাস্বত্ব আইনের ধারাবাহিক আলোচনা ও গণআন্দোলন সম্বন্ধীয় পুস্তকের আলোচনা ও সঙ্কলন। লাঙল পত্রিকার ১৫টি সংখ্যায় নজরুলের প্রকাশিত রচনার একটি তালিকা দেয়া হলো- প্রথম সংখ্যাÑ সাম্যবাদী (১১টি কবিতাগুচ্ছ) দ্বিতীয় সংখ্যা- কৃষাণের গান (গান) তৃতীয় সংখ্যা- সব্যসাচী (কবিতা) চতুর্থ সংখ্যা- পাওয়া যায়নি পঞ্চম সংখ্যা- পত্র (প্রজা ও শ্রমিকদের উদ্দেশে লেখা) ষষ্ঠ সংখ্যা- পাওয়া যায়নি সপ্তম সংখ্যা- অশ্বিনীকুমার (কবিতা) অষ্টম সংখ্যা- পাওয়া যায়নি নবম সংখ্যা- শ্রমিকের গান (গান) দশম সংখ্যা- পাওয়া যায়নি একাদশ সংখ্যা- পাওয়া যায়নি দ্বাদশ সংখ্যা- জেলেদের গান (কবিতা) ত্রয়োদশ সংখ্যা- পাওয়া যায়নি চতুর্দশ সংখ্যা- সর্বহারা (কবিতা) পঞ্চদশ সংখ্যা- পাওয়া যায়নি। ‘খড়কুটো’ শিরোনামে লাঙল পত্রিকায় একটি নিয়মিত পাতা থাকত। যেখানে লাঙল সংক্রান্ত খবর ছাড়াও সারা দেশের টুকরো টুকরো খবর ছাপা হতো। লাঙল দ্বিতীয় সংখ্যায় খড়কুটোতে প্রথমেই ছাপা হয়েছেÑ‘গতবার আমরা ৫ হাজার ‘লাঙল’ ছেপেছিলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমস্ত কাগজ ফুরিয়ে যাওয়াতে কলিকাতায় অনেকে কাগজ পাননি এবং মফস্বলে একেবারেই কাগজ পাঠানো হয়নি। ওই সংখ্যার প্রধান সম্পদ কবি নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ গ্রাহকগণের আগ্রহাতিশয্যে পুস্তিকাকারে বের করা হলো, দাম রাখা হয়েছে মাত্র দু’আনা’। সংবাদপত্র ইতিহাসের সঙ্গে সম্ভবত ‘বিজ্ঞাপন’ নামটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পত্রিকার জনপ্রিয়তা এবং সার্কুলেশনের সঙ্গে বিজ্ঞাপন-বিষয় খুব গুরুত্বপূর্র্ণ। লাঙল এর ব্যতিক্রম নয়। ‘ডেকোরেটিং’, ‘নতুন বই’, ‘লোহার বীম’, ‘বন্দুক বিক্রয়’, ‘ফার্মেসি’, ‘খেলার সামগ্রী’, ‘ আড়ত’, নতুন পত্রিকা’, ‘ভাড়া’, ‘পাত্র-পাত্রী আবশ্যক’, ‘অভিজ্ঞ ডাক্তার’, ‘পরীক্ষা সংক্রান্ত’, ‘ ডাইরেক্টরি’, ‘কর্মখালি’, ব্যায়াম সরঞ্জাম’, ‘গ্রামোফোন ও হারমোনিয়াম বিক্রয়’, ‘থিয়েটার সামগ্রী’, ‘ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন’সহ লাঙল পত্রিকার ১৫টি সংখ্যায় প্রায় ১৬৬টি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। নজরুলের নতুন পুরাতন প্রকাশিত গ্রন্থের বিজ্ঞাপন বক্স করে ছাপা হতো। লাঙল-এর বিজ্ঞাপনের হার, বুক এজেন্সির নাম, এজেন্সির নিয়মাবলী ছাপাতে বিশেষ যতœ নেয়া হতো। ডিএম লাইব্রেরির বইয়ের তালিকাও ছাপা হতো। ১২ ৯ সাইজের লাঙল পত্রিকার প্রতি সংখ্যার নগদ মূল্য ছিল ১ আনা। ভারতবর্ষ ও ব্রক্ষদেশে বার্ষিক মূল্য ৩টাকা। বিদেশে ৬ শিলিং। সার্কুলেশন ৫০০০ (পাঁচ হাজার)। রেজিস্ট্রেশন নং- ঈ-১৩৮৯, ৬/১১/১৯২৫ তারিখে পাওয়া ডিক্লারেশন নং- ১৯২০। ১৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর ‘লাঙলের’ নাম পরিবর্তন করে সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ নামে প্রকাশিত হয়। সম্পাদক মুজফ্ফর আহমদ। নজরুল সেখানে কেবলি লেখক।
×