ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চারদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট স্থবির ॥ অবর্ণনীয় ভোগান্তি

মহাজটে মহাসড়ক

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৪ মে ২০১৮

মহাজটে মহাসড়ক

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম/মীর শাহ আলম, কুমিল্লা ॥ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে অচলাবস্থা কাটেনি। রবিবার চতুর্থ দিনে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ বিভিন্ন জাতীয় যানবাহন চরম দুর্ভোগ বয়েই চলেছে। অসহনীয় এ যানজটের আতঙ্কে দূরপাল্লার যাত্রীদের বড় একটি অংশ যাতায়াতের জন্য রেলপথ বেছে নিয়েছে। অপেক্ষাকৃত বিত্তবানরা বেছে নিয়েছে আকাশপথ। এ অবস্থায় যানজট পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদ আজ সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এ সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে আন্তঃজেলা মালামাল পরিবহন ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি। এদিকে ফেনীতে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের এক অংশ খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ফলে সোমবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস-ট্রাকসহ সবধরনের যানবাহন চলাচল করবে। রবিবার রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ কফিল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘যানজট নিরসনের জন্য সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে যাত্রীবাহী গাড়ি না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলাম রবিবার সকালে। সন্ধ্যায় আমাদের ফেডারেশন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা ১৫ মে সন্ধ্যার মধ্যে ফেনীর ফ্লাইওভারের এক অংশ যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন। তাই আমরা যথানিয়মে যাত্রীবাহী গাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এর আগে সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভয়াবহ যানজট সহনীয় পর্যায়ে আনতে সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে কোন যাত্রীবাহী গাড়ি না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ (চট্টগ্রাম)। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি ফোর লাইনে উন্নীত হবার পর এ ধরনের যানজট পরিস্থিতি অতীতে তেমন একটা হয়নি। মূলত গত বুধবার রাতের পর থেকে এই মহাসড়কে যানজট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে আছে দীর্ঘ প্রায় ৮০ কিলোমিটার জুড়ে। ফেনীর ফতেহপুর এলাকায় রেলওয়ের ওভারপাসের নির্মাণজনিত কারণে এর দক্ষিণে চট্টগ্রামে মীরসরাইস্থ বারৈয়ারহাট থেকে মীরসরাই-সীতাকুন্ড এবং উত্তরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম সদর উপজেলা পেরিয়ে মিয়াবাজার পর্যন্ত উভয়দিকে যানজট বিস্তৃতি ঘটেছে। গত ৩ দিন পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। রবিবার দুপুরে ওই ওভারপাসের উভয়দিকে যানজট কিছুটা হ্রাস পেয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশে তা বজায় ছিল। এ মহাসড়কে উভয়দিক থেকে যানবাহন ছাড়লেও তা কিছুটা চলে আবার থমকে যায়। এ মহাসড়কটি ফোর লাইনে উন্নীত হবার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম যানচলাচলের সময় নেয় সর্বোচ্চ ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা। কিন্তু সৃষ্ট যানজটের কারণে এখন কখনও কখনও ২০ থেকে ৩০ ঘণ্টাও সময় লেগে যাচ্ছে। ভয়াবহ এ অবস্থায় কুমিল্লার দাউদকান্দির টোলপ্লাজা, মেঘনা, গোমতী ব্রিজ ও ফেনীর রেলক্রসিং এলাকায় যানবাহন ও যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এদিকে বিকল্প পথে যানবাহন চলাচলের কারণে এ মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। ফেনীর ফতেহপুরে নির্মাণাধীন রেলওয়ে ওভারপাসকে ঘিরে মহাসড়কে দীর্ঘমেয়াদি সৃষ্ট অসহনীয় যানজট নিরসনে এই ওভারপাসের বন্ধ থাকা লেনটি আগামী ১৫ মে খুলে দেয়া হতে পারে বলে হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। সঙ্গত কারণে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত এ মহাসড়কের পরিস্থিতি কোন্্ পর্যায়ে পৌঁছবে তা নিয়ে সকল মহলে শঙ্কা বিরাজ করছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতে দুর্ভোগ সীমাহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি বাসের পরিবর্তে রেলপথে যাত্রীর চাপ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার সফিকুর রহমান। যানজটে পড়ে দুর্ভোগের কারণে মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসে আশঙ্কাজনকহারে যাত্রী কমে যাওয়া এবং কুমিল্লা-লাকসাম-নোয়াখালী-ফেনী হয়ে বিকল্প পথে বাস চলাচল করায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে বাসের যাত্রীনির্ভর অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর ব্যবসায় চরম মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। চৌদ্দগ্রামের হোটেল ‘হাইওয়ে ইন’-এর জিএম শাহ আলম জানান, আগে এ হোটেলে দৈনিক ৪০-৪৫টি যাত্রীবাহী বাস দাঁড়ালেও এখন আসে ৪-৫টি। হোটেল তাজমহল কমপ্লেক্সের ম্যানেজার আল আমিন জানান, আগে দিনে-রাতে শতাধিক বাস দাঁড়ালেও এখন দাঁড়ায় ১০-১৫টি। তারা আরও জানান, বেচা-বিক্রি তলানীতে গেলেও হোটেলের বিপুল পরিমাণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তিন বেলা খাবার, বেতন-ভাতা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলসহ সকল খরচ নিয়মিত পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে হোটেল মালিকদের পথে বসতে হবে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জাহিদ হোসেন জানান, ঢাকা থেকে ফেনী শহরে প্রবেশ পথ পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটিতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় এবং শহরের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার এলাকায় সংস্কার কাজ চলার কারণে এ পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ। এটি মহাসড়কে যানজট সৃষ্টির একটি কারণ। আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে আগামী ২ মাসের মধ্যে কাজ শেষে সড়কটি খুলে দেয়া হবে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর রেলওয়ে ওভারপাসের কাজটি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলছে। হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোঃ নজরুল ইসলাম দাউদকান্দিতে এখন যানজট নেই দাবি করে বলেন, ফেনী রেলওয়ে ওভারপাসের নির্মাণজনিত কাজের কারণে চার লেনের গাড়ি এক লেন দিয়ে চলাচল করে। ওই লেনটিতেও অতিবৃষ্টির কারণে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ফেনী শহরমুখী পুরাতন সড়কটিতে সংস্কারজনিত কারণে যানবাহন চলাচল করতে না পারায় যানজটের সৃষ্টি হয়। রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণকারী সংস্থা জানিয়েছে- শীঘ্রই একটি লেন খুলে দেয়া হবে। সড়ক বিভাগের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন ॥ যানজটের কারণে চরম ভোগান্তির জন্য সড়কের দুরবস্থার পাশাপাশি সড়ক বিভাগের দায়িত্বশীলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ যাত্রীরা। তারা জানান, হঠাৎ করে সড়কের একটি লেন বন্ধ করে দেয়া হলো। কর্তৃপক্ষ একটি ঘোষণা কিংবা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও জানাবার প্রয়োজনবোধ করেনি। যদি জানিয়ে দেয়া হতো যে, ফতেহপুর ওভারপাসের জন্য আগামী ৮ বা ১০ দিন একটি লেন বন্ধ থাকবে, তাহলেও একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ এ মহাসড়কে যাতায়ত বন্ধ কিংবা বিকল্প পথের চিন্তা করত। কিন্তু এমন ধরনের কোন তথ্য না পাওয়ায় যাত্রী সাধারণ রাস্তায় বেরিয়ে দিনের পর দিন আটকা থেকেছে। সড়ক বিভাগ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে এ দুর্ভোগ হতো না। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা বিভাগের পক্ষ থেকে এ ভোগান্তির জন্য সামান্য দুঃখ প্রকাশও করা হয়নি।
×