ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

’১৮ সাল বজ্র দুর্যোগের বছর

বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিলের মাস মে!

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১০ মে ২০১৮

বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিলের মাস মে!

সমুদ্র হক ॥ মে মাস কি বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিলের মাস! এ বছর কি বজ্র দুর্যোগের বছর! এক হিসাবে দেখা যায় গত আট বছরে ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে যত মৃত্যু হয়েছে তার ৩৩ শতাংশই হয়েছে মে মাসে। বজ্রপাতে বাকি ৬৭ শতাংশ মৃত্যু ওই আট বছরের অন্য এগারো মাসে। চলতি বছর এপ্রিলের শেষের দুইদিনই বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে মে মাস অতিক্রম করছে। ২০১০ সাল থেকে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৯ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজারেরও বেশি। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। যে সংখ্যা ৯শ’ ৯৬ জন। অর্থাৎ ২০১৫ সাল থেকেই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছর এপ্রিলেই বজ্রমৃত্যু শুরু হয়ে মে মাসে সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে- চলতি বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে কি বজ্রদুর্যোগ যোগ হচ্ছে। আবহাওয়াবিদগণ বলছেন, মৌসুমী বায়ুর আগমনের মাসগুলোতে এপ্রিল মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যায়। এই সময়ে আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা বেশি থাকে। বেড়ে যায় ঝড় বৃষ্টি। বজ্রপাত তারই অনুষঙ্গ। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যে বৃষ্টিপাত হয় তাতে বজ্রপাতের সংখ্যা থাকে কম। একাধিক তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের ১৭ মে বজ্রপাতে মারা যায় ৭ জন। ২০১১ সালের ২২ ও ২৩ মে মারা যায় ৪৫ জন। ২০১২ সালের ২ মে মারা যায় ১৪ জন। ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে মারা যায় ৩২ জন। ২০১৪ সালের ৩০ মে মারা যায় ৮ জন। ২০১৫ সালের ১৬ ও ১৭ মে মারা যায় ৩৩ জন। ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ মে মারা যায় ৫৭ জন। ২০১৭ সালের ৯ মে মারা যায় ২১ জন। ২০১৮ সালে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটে। চলতি বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয় এপ্রিল মাসের শেষ দুই দিন ২৯ ও ৩০ এপ্রিল। এই দুই দিনে বজ্রপাতে মারা যায় ৩২ জন। চলতি বছর (২০১৮) মে মাসের ২ তারিখে মারা যায় ১০ জন। ৩ মে মারা যায় ২০ জন। ৬ মে মারা যায় ৪ জন। ৮ মে মারা যায় ৮ জন। দেখা যাচ্ছে চলতি বছর এপ্রিলের শেষের দুই দিনে বজ্রপাতে মৃত্যু শুরু হয়ে মে মাসে দুই একদিন পরই বজ্রপাতে মৃত্যুর তালিকা বাড়ছে। গত ৮ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে চলতি বছরের মে মাস যে বজ্রপাতের বড় দুর্যোগ নিয়ে এসেছে তা স্পষ্ট। বছরের বাকি মাসগুলোতে আরও কত বজ্রপাত হবে, বজ্রপাতে আরও প্রাণহানী ঘটবে এই শঙ্কা রয়েই যায়। ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ মে দুই দিনে বজ্রপাতে ৫৭ জন মারা যাওয়ার পর ওই মাসের ১৭ তারিখে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। ওই বছর বজ্রপাতে মারা যায় প্রায় ৩শ’ ৫০ জনেরও বেশি। চলতি বছর বজ্রপাতে যে হারে মৃত্যু হচ্ছে তাতে এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বজ্রদুর্যোগ বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন বজ্রমেঘ, বজ্রঝড় ও বজ্রপাত কোন একক প্রতিফলন নয়। এটি আবহাওয়ার অনেক উপাদানের সমষ্টিগত ফল। বিশ্বে বজ্রপাত নির্ণয়ের জন্য পরিচালিত গবেষণা কেন্দ্র ওয়ার্ল্ডওয়াইড লাইটনিং লোকেশন নেটওয়ার্কের এক তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ৮শ’রও বেশি। যা ২০১১ সালে ছিল ৯শ’ ৭৮টি। পরবর্তী বছরগুলো থেকেই তা বাড়তে থাকে। একজন আবহাওয়াবিদ জানান, দেশের কিছু জায়গা বজ্রপাত প্রবণ। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম। গ্রীষ্মে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে সরকার সারাদেশে তাল গাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখ্য, থাইল্যান্ড তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যু হার কমিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় মে মাসের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, চলতি বছর ৩ মে পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৩২ লাখ তালবীজ বপন করা হয়েছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাল গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে এসব তাল গাছ বড় হয়ে বজ্রপাত ঠেকাতে অন্তত ১৪ বছর সময় লাগবে। এর আগে প্রযুক্তি নির্ভর কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আবহাওয়া দফতর বজ্রপাতের আগাম সংকেত জানাতে লাইটেনিং ডিটেক্ট সেন্সর বসানোর উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। দেশের ৮ স্থানে এই সেন্সর বসানো হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, পটুয়াখালী, নওগাঁর বদলগাছি, খুলনার কয়রা ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় স্থাপিত প্রতিটি সেন্সর থেকে এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত মনিটরিং করা যাবে। ঝড় বৃষ্টির সময় কোন জেলার কোন এলাকায় বজ্রপাত হতে পারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে আবহাওয়া বিভাগ। বজ্রপাতের দশ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা এই সংকেত দেয়া যাবে। সূত্র জানায় চলতি বছরের শেষের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তি যাত্রা শুরু করবে।
×