ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তান-মিয়ানমার জোগান বাড়িয়েছে অর্থ ও অস্ত্রের

নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রে অশান্ত হচ্ছে পাহাড়

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১০ মে ২০১৮

নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রে অশান্ত হচ্ছে পাহাড়

ফিরোজ মান্না ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে পাহাড় তত বেশি অশান্ত হয়ে উঠছে। নির্বাচন বানচালের মিশন পাহাড় থেকেই বাস্তবায়নের চক্রান্ত শুরু করেছে। গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়ে পাকিস্তান ও মিয়ানমার অস্ত্র ও টাকা দেয়ার পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়েছে। ভারি অস্ত্র এখন পাহাড়ে তৎপর চারটি গ্রুপের হাতেই রয়েছে। মাঝে মাঝে এই অস্ত্র গর্জে উঠে পাহাড়ে। ৩ মে শক্তিমান চাকমা হত্যার মধ্য দিয়ে মিশনের প্রথম ধাপ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। গত ৫ বছরে পাহাড়ে উপজাতি আর বাঙালী মিলে খুন হয়েছে ২২৩। তাদের রক্তে তিন পাহাড় রঞ্জিত হয়েছে। আরও খুনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ওই গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে পার্বত্য এলাকায় একের পর এক অশান্তি সৃষ্টি করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের আইএসআই। পাকিস্তান ইতোমধ্যে মিয়ানমারকে বেশকিছু সামরিক হেলিকপ্টার দিয়েছে। ওসব হেলিকপ্টার দিয়ে গত বছরের আগস্টে (রোহিঙ্গা বিতাড়নের কয়েক দিন) বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী মহড়াও দিয়েছে। পাকিস্তান আগে থেকেই পাহাড়ীদের বন্ধু হিসেবে কাজ করে আসছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাহাড়ীদের বড় একটি অংশ পাকিদের পক্ষ ছিল। সেই ধারাবাহিকতা এখনও বজায় রয়েছে। পাকিস্তানের অর্থ অস্ত্র সবই পাচ্ছে পাহাড়ী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আঞ্চলিক রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল রয়েছে চারটি। জনসংহতি সমিতি জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। দুটি দল থেকে বের হয়ে আরও দুটি রাজনৈতিক দল জন্ম নিয়েছে। জন্ম নেয়া দুটি দলই তাদের কর্তৃত্ব বাড়াতে পাহাড়ে বিভিন্ন সময় আলোচিত বেশকিছু ঘটনা ঘটিয়েছে। বড় মাপের নেতাকে তারা খুন করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। সম্প্রতি শক্তিমান চাকমাসহ ৬ খুনের পর জনসংহতি সমিতি সংস্কারপন্থী (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আলোচনার শীর্ষে চলে এসেছে। পাহাড়ে আতঙ্কের নাম এখন ছোট এই দুটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। মূল গ্রুপ আর উপগ্রুপগুলোর ভয়ে এখন পাহাড়ে সাধারণ পাহাড়ী বাঙালীদের দিন কাটছে। বছরে চার শ’ থেকে সাড়ে চার শ’ কোটি টাকার চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগিও একটি বড় কারণ পাহাড় অশান্ত হওয়ার। মিয়ানমারের সঙ্গে দেশের ৮৫ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। এই সীমানা উন্মুক্ত। পাহাড়ীরা বিশাল এলাকা দিয়ে অবাধে মিয়ানমার যাতায়াত করছে। ওসব দুর্গম এলাকায় টহল দেয়ার মতো কোন রাস্তা নেই। ৮৫ কিলোমিটার এলাকা যদি টহলের আওতায় আনা যেত তাহলে অস্ত্র ও অর্থ যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেত। বিজিবি পক্ষে এত বড় এলাকা টহলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। গোটা সীমানার বেশিরভাগই পাহাড় ও ঘনবনে ঘেরা। সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড়ে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় চিন্তায় পড়েছে। কেন হঠাৎ করে পাহাড় এমন অশান্ত হয়ে উঠছে। সরকারী মহল থেকে বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টি থেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা হচ্ছে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আবার ১২ থেকে ১৪ লাখ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গার চাপ। বিশ্বজুড়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ার জন্য নানা ইস্যু খুঁজে যাচ্ছে মিয়ানমার। ঠিক এমন একটি মুহূর্তে শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু শক্তিমান চাকমাই নয়, পাহাড়ী আরও কয়েকজন মধ্যম সারির নেতাকেও হত্যা করা হলো। এখানে নানা রাজনীতি কাজ করছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয় রয়েছে। এগুলো খুঁজতে গিয়ে শাসক দল অনেক কিছু পেয়েছে। এরপর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা একটা বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩ মে জেএসএস (সংস্কারপন্থী) সমর্থিত নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করে ইউপিডিএফ মূল দলের সন্ত্রাসীরা। পরের দিন বেতছড়ি এলাকায় একই গ্রুপের সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা বর্মসহ জেএসএস সংস্কার গ্রুপের প্রিয় চাকমা, সুজন চাকমা, সেতু লাল চাকমা ও গাড়ি চালক সজীব হাওলাদারকে (বাঙালী) হত্যা করা হয়। শক্তিমান চাকমা ও তপন জ্যোতি চাকমা সামনের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে এলাকায় প্রচার চালায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়। তারা এই দুজনের বিপরীতে অন্যদের প্রার্থী হিসেবে নাম প্রকাশ করেছে। অবশ্য গোয়েন্দা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, পাহাড়ের রাজনীতি নানামুখী। কোন কোন নেতা দেশী-বিদেশী চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করে যাচ্ছে। গোপনে তাদের কাজ হচ্ছে পাহাড়কে সব সময় অশান্ত করে রাখা। আন্তর্জাতিক স্বার্থ রক্ষাই তাদের কাজ। মিয়ানমারের কাছ থেকে বড় ধরনের অর্থ ও অস্ত্রের জোগান পায় তারা। পুরনো বন্ধু পাকিস্তান তো আছেই। এ বছরের এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২৮ পাহাড়ী বাঙালী খুন হয়েছে। অথচ গত বছর খুন হয়েছে মাত্র ১১। কেন এত বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে তা খুঁজে দেখতে গিয়ে মিয়ানমারের সংযোগ খুঁজে পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। মিয়ানমার আর্মিসহ কয়েকটি গ্রুপের পক্ষ থেকে পাহাড় অশান্ত করার বার্তা পাঠানো হয়। এ রকম কিছু বার্তা গোয়েন্দারা উদ্ধারও করেছে। এরপর থেকে পাহাড় নিয়ে গোয়েন্দারা অন্যভাবে হিসাব-নিকাশ শুরু করেছে। জানা গেছে, পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো কোন নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম চালাচ্ছে না। তারা গত কয়েক বছর ধরেই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। পাহাড়ী রাজনৈতিক দলগুলো এসব উন্নয়নের বিরুদ্ধে কাজ করছে। ব্যক্তি স্বার্থে পাহাড়ে তারা যখন যাকে শত্রু মনে হচ্ছে তাকেই লাশ বানিয়ে দিচ্ছে। নিরীহ পাহাড়ী বাঙালী সকলেই এই সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি। আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির অর্থ ভাগাভাগি পাহাড়ে অশান্তির মূল কারণ। পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ৫৫২ ক্যাম্প ছিল। শান্তি চুক্তির পর ২১৮ ক্যাম্প রেখে বাকি সব ক্যাম্প তুলে নেয়া হয়েছে। যেসব এলাকায় ক্যাম্প তুলে নেয়া হয়েছে সেসব এলাকায় এখন খুনের ঘটনা বেশি ঘটছে।
×