ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে

কোটা আন্দোলনের তিন নেতাকে ডিবির দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৭ এপ্রিল ২০১৮

কোটা আন্দোলনের তিন নেতাকে ডিবির দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন যুগ্ম আহ্বায়ককে প্রায় দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ভিসির বাসভবনে হামলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এক আহ্বায়কের বাবাকে ঝিনাইদহের গ্রামের বাড়ি থেকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তিন আহ্বায়ক একই সঙ্গে মামলা প্রত্যাহার এবং ভিসির বাসভবনে হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। দুই দিনের মধ্যে মামলা প্রত্যাহার না করা হলে ফের আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন তারা। ডিবির হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিন আহ্বায়ক তাদের চোখ বেঁধে টেনে হিঁচড়ে ডিবি পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন। এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। ডিবি বলছে, আহ্বায়কদের বক্তব্য পরষ্পরবিরোধী। কারণ মামলা প্রত্যাহার করা হলে, ভিসির বাসভবনে হামলা এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের ফৌজদারি আইনে বিচার সম্ভব নয়। এ দিকে আগামী ২৪ এপ্রিল কোটা সংস্কারের বিষয়ে শাহবাগে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী হামলার সূত্র ধরে মামলা দায়ের ॥ গত ৮ এপ্রিল রাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রধরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। ওই দিন রাত দেড়টার দিকে পাঁচ শতাধিক লোক ভিসির বাসভবনে ঢুকে ভেতরে সব ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। এক মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকের গাড়িসহ দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ভিসির বাসভবন থেকে টাকা পয়সা স্বর্ণালঙ্কার, মাছ মাংস লুট হয়ে যায়। পরদিন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান দাবি করেন, হামলাকারীরা প্রাণনাশের জন্য এসেছিল। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে আহ্বায়করা বলেন, হামলার সঙ্গে বহিরাগতরা জড়িত। হামলাকারীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের কোন সর্ম্পক নেই। হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তারা। এমন ঘটনায় গত ১১ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় শাহবাগ মডেল থানায় চারটি মামলা দায়ের হয়। মামলাগুলো তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়কদের মুক্তি পাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলন ॥ ডিবি পুলিশের হেফাজত থেকে মুক্ত হওয়ার পর সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে দ্বিতীয় দফায় সংবাদ সম্মেলন করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন যুগ্ম আহ্বায়ক মুহম্মদ রাশেদ খান, নুরুল হক ও ফারুক হোসেন। তারা বলেন, সোমবার বেলা এগারোটায় তারা সংবাদ সম্মেলন করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রধরে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ এবং ভিসির বাসভবনে হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত সব মামলা দুই দিনের মধ্যে প্রত্যাহারের দাবি জানান। অন্যথায় আবার তারা রাজপথে নামার কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলন করে দুপুরে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে একটি রিক্সায় করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আন্দোলনকারী আহত ছাত্রদের দেখতে যাচ্ছিলেন। হাসপাতালের সামনে যাওয়ার পর তাদের রিক্সা থেকে জোর করে নামিয়ে চোখ বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে কালো কাঁচের একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় ডিবি পুলিশ। প্রায় দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের ছেড়ে দেয় ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশ তাদের কী জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তা তারা বলেননি। এমন ঘটনায় তারাসহ কেন্দ্রীয় কমিটি ও সারাদেশের কমিটির নেতৃবৃন্দ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনের ওপর হুমকি নেমে এসেছে। এ অবস্থায় তারা সরকারের কাছে পরিবারসহ কমিটির সব সদস্যের নিরাপত্তার দাবি করেন তারা। ডিবি পুলিশ তাদের কিছু ডিভিও ফুটেজ দেখানোর কথা বলে নিয়ে গেলেও কিছুই দেখায়নি। রাশেদের পিতাকে ঝিনাইদহ সদর থানায় নিয়ে আটকে রেখেছে পুলিশ। তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। রাশেদের পিতার কাছ থেকে জোর করে রাশেদ শিবির করে এবং রাশেদের পিতা জামায়াতের লোক বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়ের চেষ্টা করছে পুলিশ। যদিও পুলিশ এমন দাবি ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। আহত আন্দোলনকারীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করায় এবং যারা নিজ খরচায় ইতোপূর্বে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান আহ্বায়করা। প্রথমবারের সংবাদ সম্মেলনে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার একটি খবরের প্রতিবাদ জানিয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক আহমদ বলেন, দৈনিক ইত্তেফাকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের চার নেতার একজন শিবির বলে যে প্রতিবেদন ছেপেছে, তা মিথ্যা। এ জন্য ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ না করলে মঙ্গলবার দেশের সকল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা-উপজেলা-মহানগরসহ বিভিন্ন জায়গায় ইত্তেফাক বর্জন করার আহ্বান জানানো হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা মুহম্মদ রাশেদ খানের পিতা পুলিশ হেফাজতে ॥ সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জন্য গঠিত ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদের পিতা নবাই বিশ্বাসকে (৪৭) দুপুর আড়াইটার দিকে ঝিনাইদহ সদর জেলার মুরারীদহ গ্রাম থেকে সেখানকার পুলিশ আটক করে। ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি এমদাদুল হক জনকণ্ঠকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, রাশেদের পরিবার অত্যধিক ধর্মভীরু। পর্দানশীল পরিবার। সমাজের লোকজনের সঙ্গে তেমন একটা মেলামেশা করেন না। রাশেদের ছোট দুই বোন রয়েছে। রাশেদ বিবাহিত। ঢাকায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন রাশেদ। রাশেদদের পরিবার প্রগতিশীল নয়। পরিবারটি আওয়ামী বা এ জাতীয় প্রগতিশীল দলের সঙ্গে জড়িত নয়। রাশেদ সর্ম্পকে তথ্য পেতেই তার পিতাকে হেফাজতে রাখা হয়েছে। রাশেদের পিতার কাছ থেকে জোরপূর্বক রাশেদ ছাত্র শিবির করে বা তার পিতা জামায়াত করে এমন জবানবন্দী আদায়ের চেষ্টার অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন থেকে এমন দাবির বিষয়টি একেবারেই ভিত্তিহীন মিথ্যা। রাশেদের পিতাকে আটক বা গ্রেফতার কোনটিই করা হয়নি। ডিবি পুলিশের ভাষ্য ॥ ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন সাংবাদিকদের জানান, কোটা সংস্কারের আন্দোলনের ঘটনায় ভিসির বাসভবনে হামলা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির ঘটনায় দায়ের মামলা চারটি তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। তদন্তে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। হামলাকারীদের শনাক্ত করতে ভিসির বাসভবনের আশপাশের অনেক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই সব ফুটেজে যাদের দেখা গেছে, তাদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। হামলার ঘটনার তদন্তের স্বার্থে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন যুগ্ম আহ্বায়ককে আনা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুপুর আড়াইটার দিকে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের আটক বা গ্রেফতার দেখানো হয়নি। আহ্বায়কের দেয়া তথ্যের সঙ্গে তদন্তে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। যাচাইকৃত তথ্য মোতাবেক ভিসির বাসভবনে হামলা এবং কোটা সংস্কারের আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ভিসির বাসভবনে হামলার বিষয়ে রমনার ডিসি যা বলছেন ॥ ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জনকণ্ঠকে জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে রীতমতো গুজব ছড়ানো হয়েছে। এমন গুজব ছড়ানোর সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। সংঘর্ষের রাতে এক আন্দোলনকারী পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। এমন গুজবের সঙ্গে ভিসি পুলিশকে পরোক্ষভাবে মদদ যোগাচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়। আর তারই জের ধরে ভিসির বাসভবনে হামলার ঘটনাটি ঘটে। যেভাবে হামলা হয়েছে তা প্রতিরোধ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। ঘটনার সময় ভিসির বাংলোতে চারজন পুলিশ দায়িত্বরত ছিলেন। তারা চেষ্টা করেও হামলাকারীদের টলাতে পারেননি। এক পর্যায়ে তারা ভিসির বাসার ভেতরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এ ছাড়া গুজবের জেরে কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফাত জাহান এশা বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হন। এশা এক ছাত্রীর পায়ের রগ এশা কেঁটে দিয়েছে বলে ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতা বিরোধী চক্রটি। শেষ পর্যন্ত এশাকে মারধর ও অপমান অপদস্ত করে হল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। প্রাথমিক তদন্তে ওই ঘটনাও গুজব বলে ধরা পড়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মোট চারটি মামলা করে। মামলাগুলো ডিবি তদন্ত করছে। ভিসির বাসভবনে হামলায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির তদন্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ॥ কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে ভিসির বাসভবনে হামলার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, হামলার সার্বিক বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টির সার্বিক তদন্ত করছে। তাই এ বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। হামলায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় অফিস তদন্ত করছে। তদন্ত শেষে বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাবে। হামলায় ব্যক্তিগত অর্থ সম্পদ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের বিষয়টি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন ভিসি। শাহবাগে মুক্তিযোদ্ধাদের মহাসমাবেশ ॥ কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতা রুখার দাবিতে আগামী ২৪ এপ্রিল শাহবাগে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সোমবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন পরিষদ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, তথাকথিত কোটা সংস্কারের নামে স্বাধীনতা বিরোধীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের অপচেষ্টা রুখতে এই সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে।
×