সাইফুজ্জামান ॥ স্টিভেন উইলিয়াম হকিং সিএইচ, সিবিই এফ আর এম ও পিএইচডি। তাত্ত্বিক, পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৪২। পিতা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং (১৯০৫-১৯৮৬) জীববিজ্ঞান গবেষক মা ইসাবেল ওয়াকার (১৯১৫-২০১৩) রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালে ইসাবেল একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল সহকারী হিসেবে কর্মরত থাকার সময় চিকিৎসা গবেষক ফ্রাঙ্কের সঙ্গে তার পরিচয় হয় পরে তারা বিয়ে করেন। হকিং মাতৃ গর্ভে এলে এই দম্পতি অক্সফোর্ডে পাড়ি জমান। হকিংয়ের জন্মের পর পিতামাতা লন্ডনে এসে স্থিত হন।
হইডেটবাইরন হাউজ লন্ডনে হকিংয়ের প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা ঘটে। সেন্ট এ্যালবান, হার্টফোর্ড শেয়ারে পরিবারের সদস্যদের স্থান বদলের কারণে ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হকিংকে মেয়েদের স্কুলে পড়তে হয়। ছোটবেলা থেকে হকিং অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এমন নয়, প্রথাগত লেখাপড়ায় অনীহা ছিলেন। আর দশজন সাধারণ ছাত্রদের মতো তার বেড়ে ওঠা ও দিনযাপন শুরু হয়। ১৯৫২ সালে সেন্ট এ্যালবানস স্কুলেও তাকে এক বছর পড়তে হয়। হকিংয়ের পিতা ওয়েস্ট মিনিস্টার স্কুলে তাকে লেখাপড়া করাতে চেয়েছিলেন বৃত্তি পরীক্ষার দিন হকিং অসুস্থ হয়ে পড়েন। হকিং পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে এ্যালবানসে খেলাধুলা ও আতশবাজি তৈরি ও ফোটানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাতে থাকেন। শিক্ষক তাহতার পৃষ্ঠপোষকতায় উড়োজাহাজ ও নৌকোর মডেল কখনও তৈরি করা, কখনওবা ধর্ম আলোচনা, ইন্দ্রিয় বহির্জগত, ঘড়ি, টেলিফোন বোর্ড ও কম্পিউটার তৈরির মহড়ায় তার সময় ভালই কাটতে থাকে।
নিজ নামে একটি হাউস গঠন ও ধারাবাহিক সহপাঠ তৈরি করে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। স্কুল ম্যাগাজিন প্রকাশ ও জ্ঞানদীপ্ত সাক্ষাতকার প্রদান তার জন্য উল্লেখযোগ্য কর্মযজ্ঞ। ‘আইনস্টাইন’ নামে পরিচিত মহলে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তার পিতা চিকিৎসক হিসেবে তাকে তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগ্রহ ছিল গণিত বিষয়ে। অক্সফোর্ডে গণিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত না থাকায় হকিং পদার্থ ও রসায়ন বিষয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৫৯ সালে বৃত্তি লাভ করেন। এ সময় একাকীত্ব¡ ও বিরক্তির কাছে হকিং সমর্পিত হন। তার কাছে বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ সহজ হাস্যকর মনে হতে থাকে। ধ্রুপদী সঙ্গীত ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনী পাঠ তার একাকীত্ব মোচনে সহায়ক হয়ে ওঠে। বোট ক্লাবে যোগদান করে তিনি ক্রমেই যোগ্য হয়ে ওঠেন। সাহসী হয়ে ওঠার প্রস্তুতিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেতৃত্ব দেয়ার শক্তি ও তার করায়ত্ত হয়। উপস্থাপনা, তথ্য ও তত্ত্বের ব্যবহার যুক্তিতর্কে ক্রমে তিনি ঋদ্ধ হয়ে ওঠেন। ২১ বছর বয়সে লাউ গেহরিগ নামক মোটর নিউরন রোগে স্টিভেন হকিং আক্রান্ত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। শক্তি উৎপাদনকারী যন্ত্রের সাহায্যে তার মতামত আদান প্রদান করতেন। হকিং তত্ত্বাবধায়ক ডেনিশ উইলিয়াম শিয়ামের পরামর্শে পিএইচডি গবেষণা সমাপ্ত করেন। ষাট দশকে হকিং তার বন্ধু রজার পেনরোজের সহযোগে আইনস্টাইনের তত্ত্বের একটি মডেল সৃষ্টি হকেন। ১৯৭০-এর দশকে পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব কোয়ান্টাম মহাকর্ষে এককত্ব তত্ত্বের প্রবর্তন করে। রয়াল সোসাইটির ১৯৭৭৪ সালে হকিং রায়াল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৬৩ সালে জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে তার পরিচয় বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের ২৪ জুলাই জেন ওয়াইরডকে হকিং বিয়ে করেন। জেন ও হকিং লন্ডনে বসবাস করলেও তাদের কনফারেন্স ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার প্রয়োজনে মার্কিন মুল্লুকে যাতায়াত করত। এ সময় নানা সমস্যা সঙ্কটের পাশাপাশি বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় বাড়ি খুঁজে পাওয়ার মতো বিষয় ছিল। হকিং তার শারীরিক অসুবিধাগুলো মানসিক শক্তি বলে ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। অন্ধকার থেকে আলার দিকে তার প্রত্যাবর্তন ও আলোর তৃষ্ণা তাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রেখেছে।
পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের অসামান্য আবিষ্কার পৃথিবীতে তাকে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাতুল্য সম্মান প্রদান করেছে। অনশ্চিয়তার তত্ত্ব কৃষ্ণবিবর থেকে বিকিরিত হচ্ছে কনাপ্রবাহ। বোকেনস্টাইন-হকিং বিবিরন তত্ত্ব অসাধারণ এক উদ্ভাবন। হকিং রয়াল সোসাইটি অব আটিংসের সম্মানীয় ফেলো, পল্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য। তিনি ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক পুরস্কার প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। তার রচিত আ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম সর্বাধিক বিক্রীত গ্রন্থ।
হকিং-এর লেখা উল্লেখযোগ্য বই
কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ( A brief history of Time ১৯৮৮)
কৃষ্ণ গহ্বর শিশু মহাবিশ্ব ও অন্যান্য রচনা (Black Holes and Baby universe and other Essays (১৯৯৩)
দ্য ইউনিভার্স আ নার্টশেল (The Universe in a nutshell ২০০১)
অন দ্য শোল্ডার্স অব জায়ন্টস (On the Shoulders of Gaiants ২০০২)
গড ক্রিয়েটেড দ্য ইিন্টিজার্স, দ্য ম্যাথমেটিক্যাল ব্রেথকস দ্যাট চ্যাঞ্জড হিস্ট্রি (২০০৫)
দ্য ড্রিমস দ্যাট স্টাফ ইজ মেড অফ দ্য মোস্ট আস্টউন্ডিং পেপার্স অব কোয়ান্টাম ফিজিক্স এ্যান্ড হাউ দে শুক দ্য সায়েন্টিফিক ওয়ার্ল্ড (২০১১)
মাই ব্রিফ হিস্ট্রি (২০১৩)
হকিং ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ ক্যামব্রিজে মৃতুবরণ করেন। স্টিফেন হকিং বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ক্যামব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ের ফলিত গণিত এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষনা পরিচালক ও সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল কসমোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭০ সালে তিনি আবিষ্কার করেন পৃথিবী শূন্য থেকে সৃষ্টি’। ‘কৃষ্ণগহ্বরের চার তত্ত্ব’ ও ‘হকিং রেডিয়েশন’ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তিনি অদ্বিতীয়, বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান।
.
তাঁর উল্লেখযোগ্য দশ উদ্বৃতি
আমি এখনও বড় হইনি। আমি এখনও প্রশ্ন করতেই থাকি।
যারা বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বড়াই করেন তারা আসলে হেরে গেছেন।
জীবন এমন এক শক্তি যা আপনাকে পরিবর্তনে স্বীকার করতে শেখায়।
রাগ মানুষের সব থেকে বড় শত্রু। সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে এই ক্রোধ।
যে সমস্ত মানুষরা ভবিষ্যতকে বিশ্বস করেন তারাই রাস্তা পার করার সময় বার বার দু’দিকে তাকান।
কেউ যদি বলে আপনি ভুল করেছেন তাকে বলবেন ভুল করা দরকার। ভুল না করলে আমি আপনি কেউই বেঁচে থাকব না।
মানুষ কথা বলেই সবচেয়ে বেশি সাফল্য লাভ করে। মানুষের ব্যর্থতার কারণও এই আলাপচারিতা। তবে কথা বার্তা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
গত ৪৯ বছর নিয়ে আমার মৃত্যু নিয়ে নানা জল্পনা চলছে। তাই আমি আর মরতে ভয় পাই না।
আপনার শারীরিক বাধা কখনও ভাল কাজে বাধা হতে পারে না। শারীরিক সীমাবদ্ধতার জন্য কখনও অনুতাপ করবেন না। কাজ করার উদ্যমে বৈকল্য থাকা সব থেকে খারাপ।
মাটির দিকে তারিও না; আকাশের দিকে তাকাও। কাজ করতে থাকো। কারণ কাজই জীবনে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। আর যদি কপাল করে জীবনে ভালবাসা পাও তাকে ছুড়ে ফেল না।
স্টিভেন হকিং জীবনযুদ্ধে অংশ নেয়া এক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তিনি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। পারস্পরিক অবিরাম সন্দেহ হিংসা, যুদ্ধ কেড়ে নিচ্ছে মানবিক গুণাবলী; হকিং সৌন্দর্যময় অফুরান প্রাণস্পন্দনে ভরা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে মানুষ কর্মে, সৃজনে উদ্ভাবনে মুখর থাকবে। মানুষের তৈরি পারমাণবিক অস্ত্র, বিস্ফোরণ, কূটকৌশল থেকে দূরে গিয়ে ভালবাসায় বিশ্বের তৈরিতে মনীষী স্টিভেন হকিং তত্ত্ব ও তথ্য অন্তহীন এক প্রেরণা। তার তত্ত্ব কথা পাঠ অন্ধকার থেকে আলোর তৃষ্ণায় জাগিয়ে রাখে। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।