ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রামের প্রাণপুরুষ

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

চট্টগ্রামের প্রাণপুরুষ

নিভে গেছে দীপশিখা। যে শিখার আলোয় প্রজ্জ্বলিত হতো মানুষ। পাহাড়, নদী, সাগরবিধৌত অঞ্চলে তার কর্মের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠত। জ্বলজ্বল করে জ্বলত তার নামের পতাকা। গণমানুষের ভাষা জানতেন তিনি। বলতেন কথা তাদেরই ভাষায়। তাদের পাশে সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় সংগ্রামে-আন্দোলনে, দাবি-দাওয়া আদায়ে সর্বাগ্রে তিনিই যেতেন কাফেলা নিয়ে এগিয়ে। কর্মীবান্ধব, জনবান্ধব, দেশপ্রেমিক নেতার আসনটি ছিল তার একচ্ছত্র। সেবকের হাত তুলে তিনি দাঁড়াতেন অসহায়, নিরন্ন মানুষের পাশে। লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত জনতার জয়গান গেয়েছেন। শোষিত মানুষের একতার জয়ধ্বনি তুলেছেন। মেহনতি মানুষের দাবি অর্জনের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা, গণমানুষের আরাধ্য পুরুষ হিসেবে ছিলেন সব সময় অগ্রসারিতে। তার দীপ্তিতে আলোকিত হয়ে উঠেছিল কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বীর চট্টগ্রাম’। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকায় ছিলেন দীপ্রমান। বহুবার কারাবরণ করেছেন, সহ্য করেছেন নির্যাতন। কিন্তু কখনও আপোস করেননি। পুরো জীবনটাই তার কেটেছে বিপ্লবে-সংগ্রামে, চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বপ্ন পূরণে। সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল সারাজীবন ছিলেন মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক। মানুষই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান, বিশেষ করে চট্টগ্রামের অবহেলিত মানুষ। গণমানুষের অন্তরে তাই থাকবেন চিরদিন বেঁচে এক মহৎ মানুষ হিসেবে। জীবন্ত কিংবদন্তি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর এই প্রস্থান, মানে চলে যাওয়া নয়, বরং বারবার তিনি ফিরে আসবেন চাটগাঁর মানুষের প্রাণে, জীবনকর্মে। জনগণকে হৃদয়ে ধারণ করেই তিনি রাজনীতি করেছেন। মানসিক দৃঢ়তাই তার প্রধান গুণ। নৈতিক অবস্থান থেকে নিজেকে কখনও করেননি বিচ্যুত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে নিজেকে সব সময় রেখেছেন সামনে, সবার আগে। ভালবাসতেন নিজ জন্মভূমি চট্টগ্রামের মানুষকে। হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা তার অভিধানে ঠাঁই পায়নি কখনও। আজীবন আঞ্চলিক রাজনীতি করলেও সবকিছু ছাপিয়ে জাতীয় নেতার মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। অর্থাৎ একজন আঞ্চলিক নেতা হয়েও জনতার আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রে অবস্থান নিতে পেরেছিলেন। প্রতিনিয়ত লড়াই, সংগ্রাম আর নির্যাতন সয়ে সয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত, অপরিহার্য নেতা। একজন সফল রাজনীতিক হিসেবে পরিণত হয়ে ওঠা মহিউদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। শত নির্যাতনের মুখেও নতি স্বীকার করেননি তিনি। কৌশল অবলম্বন করে মুক্ত হয়ে তিনি যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালান হয়। সামরিক আইনে সাজা ভোগের পর ভারতে চলে যান সঙ্গীদের নিয়ে। পরিকল্পনা করেন সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে তিনি আওয়ামী লীগ কার্যালয়কে দখলমুক্ত করে দিয়েছিলেন সাহস ও শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে। চট্টগ্রামের আকাশ-বাতাসজুড়ে তার নাম প্রকম্পিত হতো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মৃত্যুর পরও তা অব্যাহত থাকবে। বলেছিলেনও তিনি গত বছর ডিসেম্বরে জন্মদিনে, ‘টিল ডেথ, আই উইল ড্যু ফর দ্য পিপল অব চিটাগাং, চট্টগ্রামের মানুষকে আমি ভালবাসি।’ এই ভালবাসা ছিল নিখাদ। এ জন্যই ঢাকায় হাসপাতালে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রামে যান। আর সেই চট্টগ্রামেই নিলেন শেষ বিদায়। তিন তিনবারের সফল মেয়র হিসেবে চট্টগ্রামকে অন্য মফস্বল থেকে আধুনিক উন্নতমানের নগরীতে পরিণত করেছেন। শিক্ষার বিস্তারে গড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হাজীদের সেবার মাধ্যমে হজ কাফেলা চালিয়েছেন তিনি প্রথম। স্যাটেলাইট টিভি স্টেশনও ছিল তার স্বপ্ন পূরণের আরেকদিক। স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থাপন করেছেন ক্লিনিক। চট্টগ্রামের গণমানুষের নেতা আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সহচর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামের মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণে তার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়। একজন সম্পন্ন রাজনীতিক হিসেবে তিনি থাকবেন চিরজাগরূক। চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষ তার নাম স্মরণ করবে শ্রদ্ধার সঙ্গে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রয়াণে সমগ্র জাতির মতো গভীর শোকাহত আমরাও। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
×