ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আনু মাহ্মুদ

বৈশ্বিক উন্নয়নে ধনাত্মক সঙ্কেত দিচ্ছে ব্রিকস

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৮ অক্টোবর ২০১৭

বৈশ্বিক উন্নয়নে ধনাত্মক সঙ্কেত দিচ্ছে ব্রিকস

চীনের জিয়ামিনে অনুষ্ঠেয় তিন দিনব্যাপী ৯ম ব্রিকস (ইজওঈঝ) সম্মেলন কিছু উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর সমঝোতায় পৌঁছার মাধ্যমে সেপ্টেম্বর ’০৫, ২০১৭ তারিখে সম্পন্ন হয়, যাতে এর নেতারা মনে করেন এ বিষয়ে সমূহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলতে সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে বিশ্বায়নের বৈশ্বিক অবস্থায়। এতদ্ব্যতীত, ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) আর্থ-সামাজিক সমস্যাসমূহ এবং সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনার সঙ্গে নেতৃবর্গ এসব দেশে তাদের সম্ভাবনাময় বাজারে যে সব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে, সে সব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। এই পাঁচটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়নশীল দেশগুলো এবারের বার্ষিক সম্মেলনের শেষের দিকে চীন ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অনুদান প্রদানের ঘোষণা করে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা কার্যক্রমের অনুকূলে, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। সম্মেলনের শেষ দিনে সম্ভাব্য বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলো শীর্ষক বিষয়ের ওপর আলোচনাকালে চীনের প্রেসিডেন্ট জিজিনপিন (ঢরঔরহঢ়রহ) সম্ভাব্য বাজারগুলোর অনুকূলে অনুদান ঘোষণা করেন। এই অনুদানের অর্থ বিবেচিত দেশসমূহের দুর্ভিক্ষ, উদ্বাস্তু সমস্যা, পরিবেশ পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবেলার কার্যক্রমে ব্যবহৃত হবে। এরই প্রেক্ষিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ব্রিকস দেশগুলো বৈশ্বিক আর্থিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্বের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে এবং একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সুব্যবস্থা বিনির্মাণে, যা হবে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত এবং অধিক সমন্বয়মূলক। অন্যান্যের চেয়ে সম্ভাব্য বাজারসমূহ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈশ্বিক আর্থিক প্রবৃদ্ধির (অগ্রগতির) ক্ষেত্রে অধিকতর অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে, এর অবদান হিসেবে ২০১৬ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ৮০ শতাংশ বিবেচনায় নেয়া হয়, যা বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থার প্রাথমিক মেশিন হিসেবে বিবেচিত। চীন এ বছর মিসর, গিনি, মেক্সিকো, তাজিকিস্তান এবং থাইল্যান্ডের মতো পাঁচটি দেশকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং এসব দেশের নেতারা সম্মেলনে আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন। এ সমাবেশে আলোচনাকালে ব্রিকস নেতারা মূল অর্থনৈতিক গ-িতে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে, যার আওতায় রয়েছে- ই-কমার্স সম্পর্কিত একটি সর্বাঙ্গীন টাস্কফোর্স গঠন ই-পোর্ট এবং স্বতন্ত্র মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থার প্রবর্তন করা, যার প্রভাবে আগত বছরগুলোতে ব্লকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে নেতারা মনে করেন। চীনের রেনমিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক ওয়াং ইওই উল্লেখ করেছেন, মার্কিন ডলার ৫০০ মিলিয়নের দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগীতা ফান্ড ব্রিকস-এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে ১২টি দেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে এবং বাংলাদেশসহ সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক বিশেষায়িত দেশসমূহ, যারা মূলধন সঙ্কটের কারণে বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করছে। তাই আশা করা যায়, এই ফান্ড জাতি সংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১৭টি এসডিজি (সাসটেইনাবল ডেভলপমেন্ট গোল) -এর লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে। রেটিং এজেন্সিসমূহ, যার অধিকাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে, তা ২০০৮ সালের পরবর্তী সময় থেকে বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কটের কারণে অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশসমূহ তাদের দুর্বল রেটিংয়ের কারণে সমস্যার সন্মুখীন হয়। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আমরা ব্রিকস-এর আওতায় প্রশংসনীয় রেটিং ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের বিশ্বস্ততা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে। প্রাথমিকভাবে ব্রিকস ২০০১ সালে গঠিত হয় চারটি সম্ভাব্য অর্থনৈতিক দেশগুলোর দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও বিশাল কর্মযোগ্য অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে। এই ধারণা ২০০৬ সালে একটি প্রথাগত সহযোগিতার কাঠামোতে রূপান্তর লাভ করে। এর চার বছর পর ২০১০ সালে সাউথ আফ্রিকা ব্রিকস-এ যোগদান করায় তা ব্রিকস-এ পূর্ণতা পায়। বিগত দশকে ব্রিকস দেশসমূহ তাদের একই ধরনের বিরাজমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধকরণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাদের সামষ্টিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১৭৯ শতাংশে উন্নীত হয়, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ৯৪ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটে এবং শহরের জনসংখ্যা ২৮ শতাংশে বৃদ্ধি ঘটে এ সময়ের মধ্যে গত দশকে ব্রিকস দেশসমূহের এ সব উন্নয়নের প্রভাবে ৩০ লাখ জনগণ বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের অংশীদারিত্বের মূল্যায়ন অব্যাহতভাবে বিরাজ করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে- (১) একে অপরকে সমভাবে বিবেচনায় নেয়া (২) সুলভপ্রাপ্তভিত্তিক সহযোগিতা প্রাপ্তির প্রত্যাশা এবং (৩) বিশ্বের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা। সংঘাত ব্যতিরেকে আলোচনা, সমঝোতা ব্যতিরেকে অংশিদারিত্বে- এই একটি প্রবাদের মাধ্যমে জিজিনপিন সহযোগিতার মূল নীতির সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। এ নীতি ক্রমান্বয়ে সমর্থন অর্জনে সফলতা লাভ করছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ধনাত্মক শক্তি সঞ্চারে সক্ষম হয়েছে। ব্রিকস সম্মেলন ধনাত্মক সঙ্কেত দিয়েছে : পাঁচ জাতির সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস-এর ৯ম সম্মেলন সম্ভাবনাময় বাজারের এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহের সঙ্গে ব্যাপক অংশীদারিত্বের সম্পর্কে একটি ধনাত্মক নির্দেশনা গ্রহণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এই উদ্যোগটি ধনাত্মক হিসেবে বিবেচিত, কেননা, যে সময় বিশ্ব বিপরীতমুখী অনিশ্চয়তার প্রবাহের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে। বিধিবিধান অনুসারে পরিচালিত বৈশ্বিক বাণিজ্য ভবিষ্যতে হুমকির সন্মুখীন হচ্ছে। এ আলোকে সদ্যসমাপ্ত ব্রিকস সম্মেলন শেষে ঘোষিত ’৭১ দফা ঘোষণা’ স্পষ্টতোভাবে প্রো-একটিভ হিসেবে বিবেচিত। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ব্রিকস জাতিসমূহের নেতারা তাদের সমস্যাসমূহ সমাধানের ক্ষেত্রে সমভাবে গুরুত্ব প্রদান করে অগ্রসর হচ্ছে এবং প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তনীয় প্রক্রিয়া ও উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে যা কেবল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে বরং ব্রিকস বহির্ভূত দেশের জন্যও সম্প্রসারণের সুযোগ অব্যাহত রাখছে। এ প্রতিষ্ঠান সুসংগঠিত হওয়ার দশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে ব্রিকস একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ব্লক হিসেবে পরিপক্বতা লাভ করেছে, যা বিশ্বের কতিপয় মূল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় ও সফল উন্নয়নশীল দেশসমূহ, বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় ব্রিকস সদস্য-রাষ্ট্রসমূহের অংশীদারিত্বের পরিমাণ ২০০৬ সালে ১২% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২৩% -এ দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে বাণিজ্যের পরিমাণ ১১% থেকে ১৬%-এ দাঁড়িয়েছে। অধিক সুনির্দিষ্টভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এদের অবদানের পরিমাণ ৫০%। এটি অত্যন্ত উদাহরণমূলক অর্জন হিসেবে বিবেচিত। যদিও আন্তঃ ব্রিকস বিনিয়োগের প্রবাহ এখনও অনুল্লেখযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে, যা ২০০৬ সালের ৭.০% থেকে ১২%-এ পৌঁছেছে। এ সম্মেলনে ব্রিকস নেতারা বিষয়টি এড়িয়ে না গিয়ে বরং তাদের অর্থনীতিসহ একই সঙ্গে স্বল্প উপার্জনকারী দেশগুলোসহ ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে বিনিয়োগের প্রবাহ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। উল্লেখ্য, চীনের প্রেসিডেন্ট জিজিনপিন নবম সম্মেলনে ব্রিকস-এর তিনটি লক্ষ্য তুলে ধরেন, যার আওতায় রয়েছে (১) সমানভাবে একে অন্যকে বিবেচনায় নেয়া এবং অসামঞ্জস্যতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে সর্বগ্রহণযোগ্য পটভূমির প্রত্যাশা, (২) ফলাফলভিত্তিক উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সহযোগিতার মাধ্যমে সকলের জন্য গ্রুপিং সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে এবং (৩) বিশ্বের মঙ্গলের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সদস্য দেশসমূহকে একে অপরকে যথাযথভাবে সহায়তা প্রদান করা। এতদ্ব্যতীরেকে, ব্রিকস নেতারা গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার ‘পারমাণবিক পরীক্ষার’ কঠিনভাবে প্রতিবাদ জানায়। এর নেতারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাস্তবভিত্তিক সন্ত্রাসবিরোধী সমন্বিত ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান ব্যক্ত করেছেন। এ সংক্রান্ত (টঘ)-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কার্যক্রমে সমর্থন দান করে। দুর্নীতির আস্ফালন, অবৈধ অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ, মূলধন প্রবাহের লভ্যাংশের নিরাপত্তার নিশ্চিতকরণ এবং অস্বাভাবিক ক্রস-বর্ডার প্রবাহ ও দাসবৃত্তিজনিত সৃষ্ট ঝুঁকিসমূহ ব্যবস্থাপনার পদক্ষেপ গ্রহণের কার্যক্রমসহ ‘জিয়ামেন ঘোষণা’তে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়সমূহ সন্দেহাতীতভাবে আমদানি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ সম্পর্কিত সর্বমহল মনে করেন, কালবিলম্ব ব্যতিরেকে সহসাই ব্রিকস নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ঘোষিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের পদক্ষেপ জরুরীভাবে গৃহীত হবে।
×