ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ॥ মিয়ানমারেই সেফ জোন চায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ॥ মিয়ানমারেই সেফ জোন চায় বাংলাদেশ

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বলয় (সেফ জোন) চায় বাংলাদেশ। মিয়ানমারে সুরক্ষা বলয় গঠিত হলে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বাসস্থান, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সে কারণে সুরক্ষা বলয় গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে দেয়া কোন প্রস্তাবেই সাড়া মিলছে না। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখেছে। তবে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বলয় তৈরির মাধ্যমে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। ইতোমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি ( আইসিআরসি), যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও জার্মানিকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা যেভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন, সেটা কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি চাপও রয়েছে। তবে সেখানে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা চাইছে বাংলাদেশ। এই সুরক্ষা মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই হতে হবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সুরক্ষা বলয় গঠনের মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে। সে কারণেই এই উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। বিশেষ করে জাতিসংঘ ও আইসিআরসি পদক্ষেপ নিলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সুরক্ষা বলয় গঠন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে এখন গণহত্যা চলছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা ও নিযার্তন চালিয়ে আসছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সেখানে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বলয় গঠনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। এর আগে বসনিয়া যুদ্ধে সার্ব বাহিনীর শিকার নিপীড়িতদের রক্ষা করতে এ ধরনের সুরক্ষা বলয় গঠিত হয়েছিল। এ ছাড়া সিরিয়ার শরণার্থীদের রক্ষায়ও আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বলয় গঠিত হয়েছে। গত বছর অক্টোবর থেকে এই পর্যন্ত দুই দফায় রোহিঙ্গাদের ওপর সেখানকার সামরিক বাহিনী নির্যাতন চালিয়েছে। এই হামলায় ঠিক কত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। কেননা রাখাইনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মিয়ানমার। তবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানা গেছে, সেখানে ১০ হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। দুই দফায় তিন হাজার রোহিঙ্গা নাগরিককে হত্যা করেছে মিয়ানমার বাহিনী। বাংলাদেশ মনে করছে, মিয়ানমার সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে। সেখানে জাতিগত নির্মূল অভিযান চলছে বলেও বিভিন্ন পক্ষের অভিযোগ রয়েছে। সে কারণে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে হলে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বলয় গঠন করা জরুরী বলে মনে করছে বাংলাদেশ। এদিকে গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমার সীমান্তে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসীদের হামলার প্রেক্ষিতে দেশটিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিক প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় সীমান্তেও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মিয়ানমারকে সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি দুই দেশের পক্ষ থেকে যৌথ অভিযান চালানোরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে উগ্রবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রতিরোধে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে চায় বাংলাদেশ। তবে মিয়ানমার বাংলাদেশের কোন প্রস্তাবেই সাড়া দিচ্ছে না। মিয়ানমারে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ওই হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে। হামলার পর গত ২৬ আগস্ট এ বিষয়ে মিয়ানমারকে একটি কূটনৈতিক বার্তাও দেয়া হয়েছে। সেই কূটনৈতিক বার্তায় মিয়ানমারকে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। তবে এখনও মিয়ানমারের সাড়া মেলেনি। এদিকে মিয়ানমার হতে নাফ নদীতে আসা মৃতদেহ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ পর্যন্ত ৮৪টি রোহিঙ্গা মৃতদেহ বাংলাদেশে ভেসে এসেছে। এসব মৃতদেহ ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমারকে অনুরোধ করা হয়েছে। তবে এই প্রস্তাবেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সাড়া মিলছে না। সূত্র জানায়, গত ২৪ আগস্ট হামলার পর থেকে এই পর্যন্ত এক লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর আগে গত বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হামলা ও নির্যাতনে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। তবে এখনও প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। এই দফায় সব মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা করেছে জাতিসংঘ। আর সেটা হলে রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। আর রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই সুরক্ষা বলয় গঠন ছাড়া আর কোন পথ নেই। বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে আয়তনে ছোট হওয়ায় মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রবল চাপ নেয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবহিত করা হয়েছে। এরপরও বাংলাদেশ দীর্ঘ তিন দশক ধরে ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। এছাড়া আরও চার লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক এদেশে অবস্থান করছেন। গত অক্টোবর থেকে দুফায় নতুন করে আরও দুই লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
×