ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিনহার মন্তব্যে সোচ্চার আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১২ আগস্ট ২০১৭

সিনহার মন্তব্যে সোচ্চার আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা

আরাফাত মুন্না ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রীমকোর্টে বাতিলের রায়কে ঘিরে সর্বত্র চলছে আলোচনা-পর্যালোচনা। রায় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও থেমে নেই। এই রায়কেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সরকারকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি। অন্যদিকে মূল ইস্যুর বাইরে গিয়ে রায়ে প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য হতাশ করেছে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে। আইনীভাবেই রায় মোকাবেলার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সরকারী দলের নেতাকর্মীদের বক্তব্যে চরম ক্ষোভও প্রকাশ পেয়েছে। তর্ক-বিতর্ক থেকে বাদ যায়নি আইন অঙ্গনও। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের উত্তাপ যেন ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রীমকোর্টে বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা গত ১ আগস্ট। ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন ৩৯৫ পৃষ্ঠা। প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ে শাসনব্যবস্থা, সংসদ, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ এসেছে। রায় প্রকাশের পর পর থেকে নিশ্চুপ থাকলেও মূলত, গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে রায় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর সরকারের তরফ থেকেও মন্ত্রীসহ উর্ধতন ব্যক্তিরা সোচ্চার হয়েছেন এবং রায়ের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, রায়ে আদালত অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন। এ জন্যই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যা মোটেও কাম্য ছিল না। অন্যদিকে এ রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছে। রায়ের ফলে সরকার অবৈধ হয়ে গেছে দাবি করে আসছে বিএনপি। গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, প্রধান বিচারপতিকেও সংবিধান মানতে হবে। কারণ, তিনিও আইনের উর্ধে নন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বর্তমান সংসদকে যারা ইমম্যাচিউরড বলেন, তারাই ইমম্যাচিউরড। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বিচারপতিদের হাত এত লম্বা নয়, তারা সংসদে হাত দিতে পারেন। এদিকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আইনমন্ত্রী কোন বক্তব্য না দিলেও আজ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। অন্যদিকে বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলগুলোও ইতোমধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। রায়ে মূল বিষয় বস্তুর বাইরে গিয়ে দেয়া নানা বক্তব্যকে অবাঞ্ছিত বলে আখ্যায়িত করেছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। বুধবার আইন কমিশনের পক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ রায়কে অপরিপক্ব, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এ রায়ে সংবিধানের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা থাকলেও রায় পড়ে মনে হচ্ছে বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বাস করছি। এ রায়ের মাধ্যমে মার্শল ল’ আমলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। রায়ে সংসদ সদস্যদের বিষয়ে মন্তব্যের সমালোচনা করে খায়রুল হক বলেন, সংসদ সদস্যরা ভুল করলে সুপ্রীমকোর্ট সেটা সংশোধন করবে। সেখানে সুপ্রীমকোর্ট (বিচারপতিরা) ভুল করলে আমরা যাব কোথায়? এই রায়ের মাধ্যমে জুজুর ভয় দেখানো হচ্ছে এবং সংসদ সদস্যদের হেয় করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১০ দিনের মাথায় প্রতিক্রিয়া জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রধান বিচারপতির ‘অগ্রহণযোগ্য’ বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়ে বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, প্রধান বিচারপতির রায়ে যে আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য আছে, সেগুলো এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ আমরা নেব। তবে রায়ে সংক্ষুব্ধ হলেও রিভিউ আবেদন করার বিষয়ে সরকার এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার রায় নিয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও কথা বলেছেন। তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, মূল সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদকে কোন আদালত বিচার করার ক্ষমতা রাখে না। সংসদ আইন প্রণয়ন করবে এবং সংবিধান হলো সবার ওপরে। আদালত ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবেন তখনই, যখন সংবিধান সংশোধন হয়। বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের বক্তব্যকে আদালত অবমাননার শামিল দাবি করে তার অপসারণ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরাও পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে। দুই পক্ষের সংবাদ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। অন্যদিকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন খায়রুল হক। এটা আদালত অবমাননার শামিল। তিনি বলেন, সরকার সব প্রতিষ্ঠানের মতো বিচার বিভাগকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। যে কারণে আদালতের রায়ে তারা সংক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার উদ্যোগে শাহবাগস্থ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি বলেন, ‘বাংলাদেশ আর পাকিস্তান এক নয়, বাংলাদেশের মানুষ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনি সাংবিধানিকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, আপনাকে সংবিধান মানতে হবে। আপনাকে সংসদ ও রাষ্ট্রপতিকে মানতে হবে, আপনাকে সংবিধান মেনে কাজ করতে হবে, আপনি সংবিধানের উর্ধে নন।’ বর্তমান সংসদ ন্যায়সঙ্গতভাবে জনগণের ভোটে গঠিত হয়েছে বলে মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘যারা বর্তমান সংসদকে ইমম্যাচিউরড বলেন, তারাই ইমম্যাচিউরড। যারা বর্তমানে বিচারকের আসনে বসেছেন, তারা ইমম্যাচিউরড। নির্বাচনের পর সারা বিশ্ব আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা বিশ্বের সংসদ এই সংসদকে বৈধতা দিয়েছে। এই সংসদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার তাদের নেই।’ বুধবার বিকেলে রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত বিএমএ মিলনায়তনে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সুপ্রীমকোর্টের একটি রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, কারও একক নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়নি। আমি প্রশ্ন করতে চাই, এ দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য আর কে ছিলেন?’ ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আজ যারা বিচারকের আসনে আছেন, তারা এক সময় আমাদের সঙ্গে কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। আজ তারা সবাই ম্যাচিউড আর আমরা হলাম ইমম্যাচিউরড! পৃথিবীর কোন আইনে এসব আছে? আমার কাছে পৃথিবীর সব আইনের বই আছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে এসেছি। আমরা সংবিধান প্রণয়নে কাজ করেছি। অসংখ্য আইন প্রণয়ন করেছি। বর্তমান সংসদের অধীনেই বিচারকদের বেতন বৃদ্ধি হয়েছে, শতাধিক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমান সংসদ সম্পূর্ণ সাংবিধানিক। ইন্টার পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আর একজন বিচারপতি বলেন, এই সংসদ ইমম্যাচিউরড!’ একই আলোচনা সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘জাতির কয়েকজন বেইমান যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে, চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছে, তখন একটি কালো আইন করে হত্যাকারীদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে, তখন কোথায় ছিলেন আদালত? কোথায় ছিলেন সুপ্রীমকোর্ট, কোথায় ছিলেন বিচারপতিরা।’ জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার রাজ্জাক আলীর উদ্ধৃতি দিয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘বিচারপতিদের হাত এত লম্বা নয়, তারা সংসদে হাত দিতে পারেন। এই সংসদ থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয় আর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নির্বাচন করে থাকেন। তাই সংসদ নিয়ে ধৃষ্টতা দেখানোর অধিকার কারও নেই।’ খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতিকে স্বেচ্ছায় সরে যেতে বলেছেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি নিজে থেকে পদ না ছাড়লে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে তার অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করবে সরকারপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন। উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। এক রিট মামলার রায়ে হাইকোর্ট গতবছর ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলে গত ৩ জুলাই আপীলের রায়েও তা বহাল থাকে। গত ১ আগস্ট আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জানা যায়, ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি ধারা পুনর্বহাল করার মধ্য দিয়ে সামরিক সরকারের করা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরিয়ে এনেছে সর্বোচ্চ আদালত। মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।
×