ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলের নদীগুলোর পানি কমছে বাড়ছে ভাঙন

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ২৫ জুলাই ২০১৭

টাঙ্গাইলের নদীগুলোর পানি কমছে বাড়ছে ভাঙন

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি কমতে শুরু করার সাথে সাথে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে টাঙ্গাইলের সাত উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকা। টাঙ্গাইল সদর, ভূঞাপুর, মির্জাপুর, কালিহাতী, দেলদুয়ার, গোপালপুর ও নাগরপুর উপজেলায় যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি কমার সাথে সাথে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার ভূঞাপুর স্লুইসগেট পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সাতটি উপজেলায় ভয়াবহ ভাঙনে শতশত বাড়িঘরসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা যমুনা, ধলেশ্বরী ও স্থানীয় নদীগুলোর পেটে চলে যাওয়ায় নদীপাড়ের মানুষের কপাল পুড়ছে। সেই সাথে এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ-বালাই, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব। গত তিন দিনের ভাঙনে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলি এলাকার দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং প্রায় দুই শতাধিক বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া মাহমুদনগর ও কাতুলী ইউনিয়নেও নদী ভাঙনের কারণে সর্বশান্ত হয়েছে শতাধিক পরিবার। আর ওইসব পরিবারের লোকজন আশ্রয় নিয়েছে অন্যের বাড়িতে। তবুও যেন যমুনার করাল গ্রাস তাদের পিছু ছাড়ছে না। তাদের আশ্রয়স্থল সেই বাড়িগুলোও এখন হুমকির মুখে। এ কারণে অনেকেই আগে থেকেই তাদের বাড়িঘর, আসবাবপত্রসহ জীবিকার একমাত্র অবলম্বন তাঁত শিল্পের যন্ত্রপাতি সড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ভূঞাপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্র জানায়, অর্জুনা ইউনিয়নে ৬০৫টি ও গাবসারা ইউনিয়নে ৬৬৯টি পরিবারের বসতভিটা ভাঙনে যমুনার পেটে চলে গেছে। এছাড়া বন্যায় অর্জুনা ইউনিয়নে ৩ হাজার ৪৫২টি পরিবার, গাবসারা ইউনিয়নে পাঁচ হাজার ২০০টি পরিবার, নিকরাইল ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজার পরিবার ও গোবিন্দাসী ইউনিয়নের এক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনে ও বন্যায় ক্ষতিগস্ত পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে নানা রোগ-বালাই। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই সর্দি, জ্বর, আমাশয় সহ পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। কালিহাতী উপজেলায় গোহালিয়াবাড়ী, সল্লা ও দশকিয়া এ তিনটি ইউনিয়নে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মির্জাপুর উপজেলার বহুরিয়া ও ফতেহপুরসহ এবারের বন্যা ও নদী ভাঙনে জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে সাতটি উপজেলার অন্তত: ২৯টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা করণের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি বিধায় তা প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাসস্থান, খাদ্য, ওষুধ ও পানীয়জলের অভাবে ওইসব এলাকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। অসহায় পরিবারগুলোর সাহায্যে সরকারি-বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান এখনও এগিয়ে আসেনি। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ভাঙন কবলিত এলাকায় দেখা যায়, মালামাল সড়িয়ে নেয়ার জন্য ভালো কোন রাস্তা না থাকায় নদীপথে নৌকা নিয়ে ছুটছেন পরবর্তী বাসস্থানের খোঁজে। আবার কেউ কেউ বাড়ি-ঘর ও আসবাবপত্র রেখে দিয়েছেন দূরে কোথাও অন্যের বাড়িতে কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলী এলাকার স্বামী পরিত্যক্তা আখলিমা। গত বছর তার শেষসম্বলটুকু যমুনার পেটে চলে যায়। সেই সাথে তার কপালটাই পুড়তে শুরু করে। পরে তিনি আশ্রয় নেয় জয়নাল আবেদিন নামে এক তাঁত মালিকের বাড়িতে। কিন্তু গত কয়েকদিনের করাল থাবায় জয়নাল আবেদিনের বাড়িটিও হুমকির মুখে। ফলে বাড়ির মালিক সবকিছু ভেঙ্গে প্রায় দুই কিলোমিটর দূরে আরেক জায়গায় ঘর তৈরির কাজ শুরু করেছেন। একই এলাকার নুরুন্নাহার, বাছাতন বেগম, আম্বিয়া আক্তার জানান, গত বছর থেকে এবারের ভাঙনের তীব্রতা অনেক বেশি। গত তিনদিনের ভাঙনে তাদের বাড়িঘর সব নদীর পেটে চলে গেছে। আশ্রয় নিয়েছেন একই এলাকার হাছান আলীর বাড়িতে। তাদের এ দুরাবস্থার সময় এলাকার কোন জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তারা কোন খোঁজ নিতে আসেনি। কোন প্রকার সরকারি সহযোগিতাও তারা পায়নি। ইতিমধ্যেই সদর উপজেলার চরপৌলি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিন্টু মেমেরারিয়ায়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ মসজিদ, মাদ্রাসা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে চরপৌলির বিশাল একটি হাট ও বাজার। এরই মধ্যে বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের প্রতিষ্ঠান অনত্র সরিয়ে ফেলেছে। মুদি দোকানি হজরত আলী জানান, গতবারের তুলনায় এবার বেশি ভাঙন শুরু হয়েছে। অতিদ্রুত ভাঙন রোধ করা না গেলে পুরো ইউনিয়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের মত সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোন জায়গা থাকবে না। জেলার ভারপ্রাপ্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাসুম রেজা প্রধান (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) জানান, বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ১০০ মে.টন জিআর চাল ও নগদ দুই লাখ টাকা তিনটি উপজেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়েছে। বিশেষ বরাদ্দ এলে তা যথানিয়মে বণ্টন করে দেয়া হবে। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ জানান, টাঙ্গাইল সদরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পানি কমতে থাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। অতিদ্রুতই ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
×