ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

অন্ধ ট্রাফিক-নীরব জনপ্রতিনিধি স্থবির রাজধানী

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ৭ জুলাই ২০১৭

অন্ধ ট্রাফিক-নীরব জনপ্রতিনিধি স্থবির রাজধানী

একদা তিলোত্তমা ঢাকা। প্রাণের নগর, রাজধানী শহর। বাংলাদেশের ধমনীর স্পন্দন। কষ্টের শরবিদ্ধ বুকে দেখি জরিপে ঢাকা আজ বসবাস অযোগ্য নগরীর প্রথম সারিতে। কিন্তু কেন? প্রথমেই বলতে হয় শুরু থেকেই অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা এক নগরীর নাম ঢাকা। যেটুকু পরিকল্পনা করা হয়েছে তাও রসাতলে গেছে কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারী আর উদাসীনতায়। নির্মম হলেও সত্য যে, ঢাকা এমন এক নগরী যার নাগরিক স্বার্থ তলিয়ে গেছে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের আবর্তে। এ কথাও অনস্বীকার্য ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠার পেছনে নাগরিক দায়ও কম নয়। জরিপের চিত্রটি প্রতিধ্বনিত পরিবেশবাদীদের কণ্ঠেও। একমত ঢাকাপ্রেমীরাও। দুই কোটি মানুষের এই শহরে নেই পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট।সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটুসম জলযট। যানজট, ফুটপাথে দখলদার। অপ্রতুল উদ্যান, নদী-খাল দখল, যত্রতত্র গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক স্থাপনা। আবাসিক এলাকায় স্কুল-কলেজ আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। গণপরিবহনে নৈরাজ্য। সড়ক দখল আর যেখানে সেখানে পার্কিং যেন ঢাকার নিয়তি। নেই নাগরিক চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাথ। যাও আছে তাও আজ সিন্ডিকেটের দখলে। বায়ু আর শব্দ দূষণে নাগরিক জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। বেপরোয়া ভূমিদস্যুদের উৎপাত বলাই বাহুল্য। নাগরিক সেবাসমূহের বেহালদশা প্রতিদিনের সংবাদপত্রের শিরোনাম। সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। অসহায় সাধারণ নাগরিকের সামনে নেই কোন আশার দ্বীপশিখা। মজার ব্যাপার হলো এই ঢাকা নিয়ে গালভরা কথা বলে চলেছেন সরকারী-বেসরকারী অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। আছে রাজউক, উত্তর-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, বিদ্যুত, পানি, গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা। আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সড়কে ট্রাফিক বিভাগসহ অন্যরা। সরকারী প্রতিশ্রুতি পরিস্থিতির উন্নয়নে ব্যর্থ। নগর পিতাদের শত আশ্বাস আজ বিশ বাঁও জলে। স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকার নেই সমস্যার অন্ত। সব সমস্যার সমাধান একদিনে সম্ভব নয় সেটাও সত্যি। কিন্তু সমাধান সহজেই সম্ভব এমন বিষয়গুলোতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা মনে প্রশ্ন জাগায়। প্রশ্ন জাগে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা আর প্রতিশ্রুতির সততা নিয়ে। ঢাকাবাসী মাত্রই হাজারো সমস্যার মাঝে প্রধান সমস্যা বলে একবাক্যে উচ্চারণ করবেনÑ যানজট। অসহায় নাগরিক ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেনÑ এই বুঝি নিয়তি। কিন্তু তার দীর্ঘশ্বাস কি কাউকে স্পর্শ করে! মনে হয় না। কারণ চিত্র বদলায় না। দিন দিন অবনতি ঘটে পরিস্থিতির। যাদের জন্য এই নগর সেই নাগরিক নিয়তির দোহাই দিয়ে মেনে নেন অরাজকতা। যানজট নিয়ে কর্তৃপক্ষ একই রের্কড বাজিয়ে চলেছেন। তাদের ভাষায়, নেই পর্যাপ্ত রাস্তা, গাড়ির সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, বাড়ছে না সড়ক, যাননিয়ন্ত্রণে লোকবল সঙ্কট, সড়ক দখল, ট্রাফিক আইন না মানা এমন হাজারো বাহানা। যেন সব দায় নাগরিকের। তারা বলেই খালাস কোন দায়িত্ব নেই তাদের; নেই জবাবদিহিতা। পরিস্থিতি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের আন্তরিকতা ব্যর্থ হওয়ার পথে। যানজট নিরসনে সরকারের মেগা প্রজেক্টগুলো কতটা সাফল্য পাবে সেটাও প্রশ্ন। উড়াল সড়ক, মেট্রোরেলসহ সরকারী মেগা প্রজেক্টগুলোর সুফল বঞ্চিত হবে নাগরিকেরা, কর্তৃপক্ষ আর অসৎ জনপ্রতিনিধির চক্রান্তে। আসুন একটু গভীরে আলোকপাত করা যাক। শুরুতেই আমরা বলেছি, সহজেই সমাধানযোগ্য দৃশ্যমান সমস্যার কথা এবং পরীক্ষামূলকভাবে বেছে নিয়েছি দুটি স্থানের চিত্র। এই চিত্র কেবল দুটি স্থানের হলেও এর দেখা মিলবে নগরীর সর্বত্র। প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা, দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা, কিংবা নেপথ্য স্বার্থ পরিস্থিতি কতটা বিষিয়ে তুলতে পারে সে চিত্রটি পরিষ্কার। সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের উপেক্ষা। যেন নাগরিকদের কাছে কোন দায় নেই তাদের। নির্বাচকম-লীর কাছে নেই জবাবদিহিতা। শুধু তাই নয়, আছে সর্বদলীয় এক দালাল চক্র। সরকার বদলায় এরা বদলায় না। রূপ বদলিয়ে চালিয়ে যায় তাদের দৌরাত্ম্য। কোটি টাকার বাণিজ্যিক স্বার্থ নিয়ে এরা জিম্মি করে রেখেছে নগরবাসীকে। এদের প্রভাবের সামনে প্রশাসন পর্যন্ত অনেকটাই অসহায় । অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলে প্রশাসন আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে এলেও থমকে যেতে হয় সুবিধাভোগীদের চক্রান্তে। নগরবাসীকে বাসযোগ্য নগরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জেতা নগর পিতারাও অনেকক্ষেত্রে নীরব। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নীরবতা রহস্যজনক। কেস স্টাডি এক ॥ মগবাজার টু হাতিরপুল মোড় ঢাকা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মগবাজার থেকে বাংলামোটর মোড় পর্যন্ত সড়কটির নাম রাশেদ খান মেনন সড়ক/নিউ ইস্কাটন রোড। মধ্যবিত্তের বাহন রিক্সার জন্য ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিম অংশের অন্যতম প্রধান সংযোগ সড়কও এটি। স্বাভাবিকভাবেই এটি নগরীর ব্যস্ততম সড়ক। যানজট কমাতে নির্মিত হয়েছে ফ্লাইওভার। যা পুরোপুরি চালু না হতেই সক্রিয় দখলবাজরা। ফ্লাইওভারের নিচে স্থান দখল করে শুরু হয়েছে গাড়ি মেরামত কারখানা। এখানে আপনার গাড়িটি পার্ক করুন; পাঁচ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট। মামলা, রেকার ডাকা রীতিমতো দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত! কিন্তু একই স্থানে দাঁড়িয়ে মেরামতাধীন গাড়িগুলো তারা দেখতে পান না। যা সংকুচিত করে তুলছে সড়কটি। দখলবাজদের বেপরোয়া তৎপরতার অনিবার্য পরিণতি দুর্ঘটনা আর জানজট। শিকার নগরবাসী। এবার অপর প্রান্তে আসা যাক। বাংলামোটর মোড়। প্রশাসনের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আপনি যদি কারওয়ান বাজার থেকে এসে বাঁয়ে মগবাজারের পথে মোড় নেন, আপনার চলন্ত গাড়ির গতিরোধ করে একদল কিশোরের চিৎকারÑমামা কাজ করাবেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাস্তার দু’পাশের বাস্তবতাই এই চিৎকারের উৎস। বাংলামোটর মোড় থেকে টিএমসি ভবন পেরিয়ে রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে সারি সারি কার ডেকোরেশনের দোকান। বছরের পর বছর ধরে রাস্তার দু’পাশ দখল করে এরা চালিয়ে যাচ্ছে মেরামত কিংবা গাড়ি সজ্জার কাজ। রাজধানীর অন্যতম প্রধান সড়ক দখলের এই চিত্র পরিস্থিতির নৈরাজ্যকর দিকটি স্পষ্ট করে। এরা এতই বেপরোয়া যে প্রকাশ্য সড়কে চলন্ত গাড়ির গতিরোধ করে ডেকে বেড়ায়Ñ মামা কাজ করাবেন? তা আবার প্রশাসনের সামনেই। এর ফলে সৃষ্ট যানজট আর দুর্ঘটনার অসহায় শিকার কিন্তু সেই সাধারণ নাগরিক। এবার হাতিরপুল প্রান্ত থেকে বীর উত্তম সিআর দত্ত সড়ক ধরে বাংলামোটর লিংক রোড হয়ে বাংলামোটর মোড় পর্যন্ত আসা যাক। হাতিরপুল মোড় থেকে রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক বিপণি বিতান মোতালিব প্লাজা, ইস্টার্ন প্লাজা, নাহার প্লাজাসহ উল্লেখযোগ্য মার্কেট বীর উত্তম সিআর দত্ত সড়কে। পূর্ব-পশ্চিম ঢাকার রিক্সা চলাচলে এ সড়কটি রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই সড়কের দু’পাশজুড়ে সারি সারি টাইলস আর বাথরুম ফিটিংস সামগ্রীর প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি প্রধান টাইলস নির্মাতা বা সিরামিক সামগ্রী নির্মাতার শোরুমও বিদ্যমান। আছে স্যানিটারি ফিটিংস আর টাইলস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের শোরুম। ব্যবসা শত কোটি টাকার। এই ব্যবসায়িক প্রয়োজনে রাজপথ দখল করে দাঁড়িয়ে সারি সারি মিনি ট্রাক। গড়ে উঠেছে রিক্সা-ভ্যান, ঠেলাগাড়ি স্ট্যান্ড। আড়াআড়ি দাঁড়ানো ট্রাকের কবলে অর্ধেক রাজপথ। তার পরও নিস্তার নেই। দিনদুপুরে সড়ক দখল করে চলছে মাল লোডিং-আনলোডিং। কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই; বাণিজ্যিক স্বার্থে জিম্মি নগরবাসী। আর এই বাণিজ্যের পেছনে বাণিজ্যের চিত্রটি কতটা ভয়াবহ তাও পরিষ্কার। এটি পরিষ্কার যে এখানে প্রশাসনের লোকবল সঙ্কট নেই। যা হচ্ছে তা তাদের উপস্থিতিতেই হচ্ছে। রীতিমতো অনুমোদিত। এমনও নয় যে এ অঞ্চলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নেই। এটি উল্লেখ করা বোধকরি অপ্রাসঙ্গিক হবে না পূর্ব-পশ্চিম ঢাকার অন্যতম এই সংযোগ সড়ক ধরে প্রতিদিন চলাচল দশ লক্ষাধিক লোকের। উৎসব পার্বণে এ সংখ্যা দ্বিগুণ। বেপরোয়া দখল বাণিজ্যে নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ নাগরিকের। নষ্ট হয় মূল্যবান কর্মঘণ্টা। অসুস্থ কিংবা নারীদের কথা বাদই গেল। এই মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর শত কোটি টাকার বাণিজ্যিক স্বার্থে জিম্মি আজ নগরের প্রধান সংযোগ সড়ক। জিম্মি নগরবাসী। প্রশাসন এখানে অন্ধ, নীরব জনপ্রতিনিধি পরিণতিতে স্থবির নগরী। গেল বড় নৈরাজ্যের কথা। এবার ছোট নৈরাজ্য প্রসঙ্গে আসি। এই ছোট নৈরাজ্যের সূত্র ধরে বেরিয়ে আসবে বড় নৈরাজ্যের কারণ। বাংলামোটর মোড়। ঠিক মোড়ে দাঁড়িয়ে আপনার কানে ভেসে আসবে রিক্সাচালকের চিৎকার এই মোড়ে মোড়ে! মোড় দখল করে জট পাকানো এই চিৎকারের কারণ শেয়ারে যাত্রী গ্রহণ। পরিণতি যানজট আর দুর্ঘটনা। চোখে পড়ে আরেকটি দৃশ্য, দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ বীরদর্পে বেছে বেছে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সার চাকা ফুটো করছেন। কেন এই বৈষম্য? কারণ জানা গেল অনুসন্ধানে। শেয়ারে মগবাজারের উদ্দেশে যাত্রা। কথা হলো রিক্সাচালকের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের চাকা ফুটো হয় না কেন? তার সহজ জবাব, স্যার আমরা টাকা দেই আমরারে কি কইব? কিভাবে, কত দেয়া হয়? স্যার ডিউটি ট্রাফিকরে দশ, দশ দুই বেলায় বিশ টাকা আর কমিউনিটি পুলিশরে ত্রিশ টাকা। এই টাকা দেয়া রিক্সার সংখ্যা কত? স্যার হইব শতখানেক। দিনে পঞ্চাশ টাকা করে শ’খানেক রিক্সার আদায় পাঁচ হাজার। এই অর্থ যায় কোথায়? আর পাঠক সামান্য রিক্সা প্রতি আদায় পঞ্চাশ টাকা হলে সড়ক দখল করে রাখা গাড়ি আর ট্রাক প্রতি কত আদায় হতে পারে একটু ভাবুন। এবার ভিন্ন চিত্র। নিউ ইস্কাটন রোডে রোজার কারণে ঘিরে রাখা এক ফুটপাথের দোকানে বসে আছি। হঠাৎ করে হন্তদন্ত হয়ে এলেন এক যুবক। এই দোকান বন্ধ কর সিটি কর্পোরেশন আইছে। দোকানদারের মৃদু প্রতিবাদ ভাই টাকা দেই ব্যবসার সময় ডিস্টার্ব! যুবকের উত্তর আরে ওই দেখ কর্পোরেশনের গাড়ি দাঁড়ানো। ম্যাজিস্ট্রেট আইতেছে। আমারে খবর দিছে তাই জানালাম, আগে বন্ধ কর। আশা করি এ ধরনের অভিযানের ফলাফল পরিষ্কার। কারণটাও বোধগম্য। কেস স্টাডি দুই ॥ জিগাতলা টু হাজারীবাগ জিগাতলা মোড় হয়ে সড়কটি চলে গেছে হাজারীবাগ। ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। প্রতিদিন অন্তত পাঁচ লাখ লোকের চলাচল। বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে সারি সারি সিএনজি দাঁড়িয়ে। গন্তব্য হাজারীবাগ। এখনে দাঁড়ানো অর্ধেক সিএনজির নেই নম্বর। যাদের আছে তাদের অনুমোদনও মহানগরীর বাইরে চলাচলের। অথচ সামান্য বিকার নেই চালকদের। যখন ইচ্ছে ঘুরাচ্ছেন, পাল্লা দিচ্ছেন একে অপরের সঙ্গে। পরিণতি যানজট, দুর্ঘটনা আর জনদুর্ভোগ। আছে তাদের নিজস্ব লাইনম্যান। চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল প্রতিদিন দিতে হয় দুই শ’ টাকা। এই অর্থ বণ্টন হয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে প্রশাসন পর্যন্ত। আরেকটু এগিয়ে যাই কাওসার সুইটমিট থেকে ডানে। স্টাফ কোয়ার্টার থেকে শুরু ফুটপাথ দখল। এতটাই বেপরোয়া যে এক ইঞ্চি জায়গা বাদ নেই। গড়ে ওঠা দোকানের পেছনে স্থানীয় যুব নেতার প্রশ্রয়ের বিষয়টিও পরিষ্কার। অসহায় সাধারণ নাগরিক। নির্বিকার প্রশাসন সময় সকাল ১০.৫৪ মি. বাংলামোটর লিংক রোড। রেকার নং ঝালকাঠি শ-১১-০০৩৩ নিয়ে সড়ক দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের সামনে সার্জেন্ট কাওসার। তাকে ঘিরে বেশ জটলা। দালাল শ্রেণীর একজন বললেন আরে ভাই কাগজ আইতাছে। যেন গাড়ির বৈধ কাগজপত্র থাকলেই সড়ক দখল করে রাখা তাদের অধিকার! বিষয়টি জানতে চাইলে সার্জেন্ট কাওসার জানালেন টিআই সাহেব বক্সে আছে উনার সঙ্গে কথা বলুন। বক্সে পাওয়া গেল টিআই দেলোয়ার সাহেবকে। কথাবার্তায় আন্তরিক, তিনি জানালেন টাইলস মার্কেটের সামনে দাঁড়ানো ট্রাকের বিরুদ্ধে তারা প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু আবার দখল হয়ে যায়। দায়িত্বরত এসি আলাউদ্দিন বললেন বাংলামোটর মোড় থেকে নিউ ইস্কাটন রোড দখলের বিষয়টি তারা চিঠি দিয়ে সিটি কর্পোরেশনে জানিয়েছেন। রাস্তাজুড়ে দখল করে গড়ে তোলা মেরামত কারখানার ব্যাপারে তারা অনেকটাই অসহায়। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা সত্ত্বেও তারা পারছেন না সড়কটি দখলমুক্ত করতে। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আছেন নানামুখী চাপে। জিগাতলা নতুন সড়কে দাড়িয়ে থাকা হাজারীবাগ থানার এস আই তাপসের সাথে কথা হল। তিনি জানালেন অভিযান পরিচালনার কথা! স্বাভাবিকভাবেই অসহায় নাগরিক ভাবতে বাধ্য সেই পুরনো দোহাই! যে চেষ্টার কোন ফল নেই তার অর্থ কি? তবে কি দখলবাজরা সরকারের চাইতে ক্ষমতাবান? আমরা তা মনে করি না। বরং চোখ থাকতেই অন্ধ সেজে থাকা প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় ভিন্ন প্রশ্ন দোলা দেয় নাগরিক মনে। জনপ্রতিনিধিগণ কহেন জিগাতলা তথা ঢাকা দক্ষিণের ১৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম। তার কাছ থেকে জানা গেল অবৈধ সিএনজি স্ট্যান্ড আর ফুটপাথ দখল উচ্ছেদে তিনি কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। অনেকটা অসহায় কণ্ঠে বললেন, ‘ভাই, সব কথা বলাও যায় না। এই দখলদার চক্রের হাত অনেক লম্বা।’ পরিস্থিতির কারণে তিনি অনেকটাই অসহায়। হোসেন হায়দার হিরু ঢাকা দক্ষিণের ১৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তিনি জানালেন টাইলস সামগ্রী ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনে সড়ক দখলের বিষয়ে তিনি অবগত। প্রশাসনসহ এ বিষয়ে তিনি ব্যবসায়ীদের আলটিমেটাম দিয়েছেন। তার ভাষায় ট্রাকগুলো গলির মধ্যে রেখে অর্ডার অনুযায়ী দোকানের সামনে মাল লোড করতে বলা হয়েছে। প্রশ্ন উঠে সমস্যার বাস্তব দিক অনুধাবনে তার ব্যর্থতা নিয়ে। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এমন গলিই বা কোথায়? নগরবাসী আলটিমেটাম নয় ফলাফল দেখতে চায়। ফয়জুল মুনির চৌধুরী কাউন্সিলর ওয়ার্ড নং ৩৫ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। তার কাছে পাওয়া গেল অন্য চিত্র। সরাসরি বললেন বাংলামোটর থেকে মগবাজার মোড়ের এই দখল সারা শহরে যানজটের অন্যতম কারণ। তিনি দায়ী করেন মোটর পার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির অবৈধ প্রভাবকে। আর ফুটপাথ দখলে জড়িত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তার নীরবতার কারণ হিসেবে বলেন আমি প্রতিরোধ করতে গেলে সংঘর্ষ অনিবার্য। কাজেই নীরবতা। তিনজন কাউন্সিলরই জানান বিষয়টি সম্পর্কে মেয়র অফিস অবগত।সবকিছুর পরও বলা যায়, বিষয়টি নিয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ায় অনীহা জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের নীরবতার নামান্তর। কাজেই অসহায় নাগরিকের সামনে সমস্যা সমাধানে অন্তহীন অপেক্ষা ছাড়া আপাত বিকল্প নেই বললেই চলে। সমাধান কোন্ পথে শুরুতেই আমরা বলেছিলাম সহজে সমাধানযোগ্য সমস্যা। আমরা তাই মনে করি। হাতিরপুল থেকে বাংলামোটর মোড় দখল করে ট্রাকের সারি টাইলস ব্যবসার স্বার্থে। নগর পিতা, প্রশাসন উদ্যোগ নিতে পারেন এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের মালামাল সরবরাহের কার্যক্রম রাতে পরিচালনা করতে। আমরাও চাই তারা ব্যবসা করুন। সারাদিন অর্ডার সংগ্রহ করে অর্ডার অনুযায়ী রাতে মাল সরবরাহ করতে পারেন। নগর পিতা চাইলেই তা সম্ভব। নগরপিতারা নজর দিতে পারেন ডাস্টবিনের অবস্থানের বিষয়ে। বাংলামোটর মোড় পেরিয়ে অর্ধেক রাস্তা দখল করে রাখা ডাস্টবিন ভুল বার্তা দেয়। যেন সিটি কর্পোরেশন আড়াল দিচ্ছে সড়ক দখলকারীদের। এমন ভাবার কোন কারণ যে নেই তাও নয়। ডাস্টবিনগুলো ফুটপাথের সমান্তরালে স্থাপন করলে কমে আসবে সমস্যা। অবৈধ সিনজি এবং স্থানে স্থানে গড়ে ওঠা সিএনজি স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে চাই জিরো টলারেন্স। দখলবাজদের দৌরাত্ম্যে আজ অতিষ্ঠ ঢাকাবাসী। নাগরিক চিৎকার এখন স্পর্শ করে না কাউকে। শত কোটি টাকার সড়ক দখল বাণিজ্যে বেপরোয়া সিন্ডিকেট। যা কেবল নাগরিক বিড়ম্বনার কারণ নয় অপরাধের অন্যতম উৎস। এই দখল বাণিজ্যে খুন-জখম স্বাভাবিক ঘটনা। মূল দায়িত্ব যে প্রশাসনের, তারা আজ অন্ধ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নীরব। দু’পক্ষের ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ নাগরিক মনে। দু’পক্ষের প্রশ্রয়ে দালাল চক্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মহানগরী ঢাকা। অসহায় সাধারণ নাগরিক। কিন্তু সরকার প্রধান নিজে যেখানে আন্তরিক ঢাকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সেখানে এমন হওয়ার কথা নয়। প্রশ্ন ওঠেÑ প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আর এই দালালচক্রের মিলিত দৌরাত্ম্যে ঢাকার উন্নয়নে মেগা প্রজেক্টগুলো কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে? বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে বলতে হয় সম্ভব নয়। কাম্য নগর কর্তৃপক্ষ আর প্রশাসনের সম্মিলিত আন্তরিক সৎ প্রয়াস। মূল কথা ঢাকাকে বাঁচাতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। বসবাস অযোগ্য এক ইট কাঠের জঞ্জালে পরিণত হোক এই নগর তা আমাদের কারও কাম্য নয়। জনপ্রতিনিধি বা মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন, কথা শেষে সবাই এক সুরে বলেছেন, ভাই এসব লিখে কি হবে! এ লেখা কেবল আমাদের বক্তব্য নয়। এ কথাগুলো ঢাকাবাসীর প্রাণের কথা। সবাই চাই দখলমুক্ত, যানজটহীন ঢাকা। এবং আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই অসহায় নগরবাসীর আর্তনাদ শোনার কেউ না কেউ আছেন। লিখে কিছু না কিছু হবে।
×