ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ বাজেট বেপরোয়া অর্থ সংগ্রহের ॥ ফখরুল

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১২ জুন ২০১৭

এ বাজেট বেপরোয়া অর্থ সংগ্রহের ॥ ফখরুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বপ্নকল্পনা ও অলীক আখ্যায়িত করে এই বাজেট প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। জাতীয় সংসদে বাজেট পেশের ১০ দিন পর রবিবার দুপুরে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাজেট প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে আমরা যুগপৎ বিস্মিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছি। বাজেটকে বঞ্চনার বাজেট অভিহিত করে তিনি বলেন, এটি জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য। এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে মানব উন্নয়ন খাত ও কৃষির মতো খাত উপেক্ষিত থেকেছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এতে প্রাধান্য পেয়েছে চোখ ধাঁধানো কিছু মেগা প্রকল্প। যেভাবে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে, ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এগুলোর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তার ফলে এসব প্রকল্পের উপযোগিতা কত দিনে উঠে আসবে এবং আদৌ উঠে আসবে কি না, তাও অনিশ্চিত। বিএনপি মহাসচিব বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এগুলোকে নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এ জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর অর্থের। সেই অর্থের যোগান দেখানোর জন্যই জনগণের ওপরে করের বোঝা চাপিয়ে একটি গাণিতিক হিসেবের বাজেট হিসেবে এ বাজেট পেশ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনের পূর্বে সরকার এসব প্রকল্পকে নির্বাচনী প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। তারা বলতে চাইবে দেশের একমাত্র সার্থক উন্নয়নকারী তারাই। মির্জা ফখরুল বলেন, এ বাজেট বেপরোয়া অর্থ সংগ্রহের বাজেট। রাজস্ব আদায় ছাড়াও বাজেটের বেশকিছু কল্যাণমুখী লক্ষ্য থাকে। এই বাজেট দেখে মনে হচ্ছে কল্যাণমুখী লক্ষ্যগুলো অর্থমন্ত্রীর বিবেচনায় আসেনি। এসব কারণে আমরা আশাহত এবং ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন সংসদে যেখানে কোন জবাবদিহি নেই, সেই সংসদে এ বাজেট পেশ করা হয়েছে। এখানে সরকারের দায় কোথায়? জনগণের কাছে সরকারের কোন দায়বদ্ধতা নেই বলেই এই বঞ্চনার বাজেট জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। মির্জা ফখরুল বলেন, বাজেটে প্রস্তাবিত ১৫ ভাগ ভ্যাট দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ। উচ্চহারে ভ্যাট আহরণের ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে, মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ ভয়ানক দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে। ব্যাংকে আমানতকারীদের জমানো আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এতে ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয় আসতে পারে। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ এবং বৈদেশিক সূত্র থেকে সম্পদ আহরণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম হয়েছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য বাজেটের যে আকার প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি অর্থায়নের জন্য দেশী এবং বিদেশী সূত্র থেকে কাক্সিক্ষত মাত্রায় সম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। ফখরুল বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বৈদেশিক সূত্রের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণে ৮০ ভাগ বৃদ্ধি ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক সূত্রগুলো যে ঋণ বা অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি করে তা দক্ষতার অভাবে পুরোমাত্রায় ছাড় করানো সম্ভব হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো শুরু করাই সম্ভব হয় না। সুতরাং প্রস্তাবিত বাজেটে এই সূত্রের ৮০ ভাগ প্রবৃদ্ধি একেবারেই অসম্ভব, কল্পনা করাও কঠিন। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বাজেট প্রণয়নকারীরা নিছক হিসেবের অঙ্ক মেলাতে গিয়ে তাদের পছন্দসই সংখ্যাটি বসিয়ে দিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ঘাটতি অর্থায়নের মাধ্যমে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষ করে মেগা-উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চলেছে সরকার। বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এগুলো বাস্তবায়িত করতে না পারার অজুহাতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে প্রকল্পগুলোর ব্যয় ৫ থেকে ৯ গুণ বেশি। এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির। মির্জা ফখরুল বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি ঘটিয়ে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের চমক দেখানো হয়েছে। সরকার পরিসংখ্যানজনিত বিভ্রাট ঘটিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোর সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। প্রশ্নবিদ্ধ জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা এক ধরনের আত্মতুষ্টিজনিত রোগে ভুগছেন। প্রশ্ন হলো, এ সরকারের দাবিকৃত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যাচ্ছে কোথায়? সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদনটি ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল ২০১৩ সালে দেশ থেকে ৭৮ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১৪ সালেই দেশ থেকে ৭২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ২০১৪ সালের পাচারের এই পরিমাণটি জিডিপির প্রবৃদ্ধির ৪ ভাগ-এর মতো। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৭ ভাগ-এর মধ্যে যদি ৪ ভাগ বাইরে পাচার হয়ে যায় তাহলে দেশের অর্থনৈতিক লেনদেনে কীভাবে প্রবৃদ্ধির প্রভাব লক্ষণীয় হবে? বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিদেশে দেশের এত বিরাট অঙ্কের টাকা চলে যাচ্ছে অথচ সরকার একেবারেই নীরব। রহস্যজনকভাবে বিশাল অঙ্কের এই টাকা ফিরিয়ে আনার কোন সরকারী উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ব্যাংকে লুটপাট সরকারের পাশের লোক না হলে কেউ করতে পারে না। এ অর্থলোপাট ও অর্থপাচারের কোন ঘটনার বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা আজও নেয়া হয়নি, যা রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার। বাজেটের আকার বড় করা হলেই ভাল বাজেট হয় না মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, অতীতের বাজেটগুলোর ভাগ্যে যা ঘটেছে অর্থাৎ আয়ের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া এবং একই সঙ্গে ব্যয়ের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া প্রস্তাবিত বাজেটের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে চলছে বলে সরকারের শ্লোগানের জবাবে তিনি বলেন, উন্নয়নের মহাসড়ক খানাখন্দকে ভরা। এর ওপর দিয়ে চলতে গেলে পদে পদে দুর্ঘটনার আশঙ্কা। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেনÑ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ। মির্জা ফখরুল বলেন, টাকার অঙ্কের দিক থেকে এই বাজেট বাংলাদেশের জন্য সর্বকালের বৃহত্তম বাজেট। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি, এই বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এ বাজেটকে দুর্নীতিবান্ধব বাজেট হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)। তারা বলছে, সাধারণ মানুষের করের অর্থে দুর্নীতিগ্রস্ত জালিয়াতিতে জর্জরিত রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন ব্যাংকিং খাতের অনৈতিক পুনর্মূলধনীকরণ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে ড. আবদুল মঈন খান বলেন, মূল অর্থনীতি পারফর্ম করছে না বলেই প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বেশি ট্যাক্স আদায় করছে।
×