ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গাজী ভাই আমার কে ছিলেন? -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১২ জুন ২০১৭

গাজী ভাই আমার কে ছিলেন? -স্বদেশ রায়

গাজী ভাই আমার কে ছিলেন? আমার ঢাকা শহর, আমার লেখালেখি, আমার সাংবাদিকতা সব কিছুর সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছেন গাজী ভাই যেমন থাকে বংশগতির রক্ত। তাই সচিত্র সন্ধানী সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আমার ও আমাদের অনেকের গাজী ভাই; বাস্তবে আমার কে ছিলেন এ কথা বলা সত্যিই কঠিন। গাজী শাহাবুদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের ও বাংলাদেশের রুচিশীল পত্রিকার একজন সম্পাদকের নাম শুধু নয়, গাজী শাহাবুদ্দিন একটি আশ্রয়ের নাম। শহর মাত্র একটু নিষ্ঠুর হয়, আর সেই শহর যদি হয় রাজধানী শহর। তাই আমরা যারা ছোট ছোট শহর থেকে একদিন ঢাকায় প্রবেশ করেছিলাম তাদের জন্যে এই শহরটির ভেতরে প্রবেশ করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। যে কারণে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভাল রেজাল্ট করে চাকরি নিয়ে চলে যায়, কিন্তু তার সঙ্গে থাকে না ঢাকা শহর। শহরটির ভেতরে অদৃশ্য দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি জগত আছে, যেখানে প্রবেশ করলে মানুষ বদলে যায়, সেটা যন্তরমন্তর ঘর নয়, একটি আধুনিক রুচির ঘর। যে ঘর একটি মানুষকে তৈরি করে তার হাতে তুলে দেয় পৃথিবীর তাবৎ বড় শহরের আধুনিক ওই জগতে প্রবেশ করার চাবিকাঠি। ঢাকা শহরে এই চাবিকাঠি এক সময়ে যে ক’জনের হাতে ছিল তাদের একজন গাজী শাহাবুদ্দিন। আমাদের গাজী ভাই। মিতভাষী এই মানুষটি যে কীভাবে যে কোন বয়সের মানুষকে বন্ধু করে নিতেন, আটকে রাখতেন চিরকালের জন্য ভালবাসার নিগূঢ় বন্ধনে আবদ্ধ আমার মতো একজন কলমজীবীর পক্ষে তা প্রকাশ সম্ভব নয়। সম্পাদক ও মানুষ গাজী শাহাবুদ্দিনকে প্রকাশ করার জন্য অনেক শক্তিশালী কলম দরকার। আর শক্তিশালী কলম হলেই কি প্রকাশ করা যায় গাজী শাহাবুদ্দিন বা আমাদের গাজী ভাই বা মনু ভাইকে? অত সহজ নয়। যারা কালেভদ্রে কোন কোন জাতিতে জন্মান, গাজী শাহাবুদ্দিন তাদের একজন। আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলতেন, এমনভাবে ইতিহাস নির্মাণ করো যাতে ইতিহাসে তোমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া না যায়। গাজী শাহাবুদ্দিন ও তাজউদ্দিন আহমদ একই স্থানের মানুষ। গাজী শাহাবুদ্দিনদের পূর্বপুরুষ দেলদার গাজী ভাওয়ালের রাজাদের কুটিলতার কাছে রাজ্য হারিয়ে কালিগঞ্জে গিয়ে বসতি করেন, আর এই কালিগঞ্জের পাশের কাপাসিয়াতেই তাজউদ্দিন আহমদের জন্ম। দুজনের জগত দুটো, দুজনকে নিয়ে যখনই ভেবেছি, মিল পেয়েছি প্রচুর। যাক সে কথা,গাজী শাহাবুদ্দিন গ্রামের ছেলে নয়, সম্পূর্ণরূপে নাগরিক। পুরানো ঢাকার রোকনপুরে তাঁর জন্ম। তাঁর নানা তখন নাথ ব্যাংকের মালিক। ঢাকা শহরের পাঁচখানা মোটরগাড়ির একখানাতে চড়েই বড় হন গাজী শাহাবুদ্দিন। তাঁর নানার ছিল অনেক ব্যবসা, কিন্তু কোন ব্যবসা গাজী শাহাবুদ্দিনকে কোনদিন টানেনি। আবার তাঁর তরুণবেলায় তাঁর কাকা গাজী গোলাম মোস্তফা শুধু ঢাকা শহরের আওয়ামী লীগের একজন পৃষ্ঠপোষক নন, শেখ মুজিবেরও অন্যতম হাত। রাতেরবেলায় শেখ মুজিব আসতেন তাঁদের বাড়িতে। এই পরিবেশে বসেও রাজনীতি কখনই টানেননি গাজী শাহাবুদ্দিনকে। বরং ছোটবেলা থেকেই যেন কোন এক অদৃশ্য বিধাতা তাকে নির্মাণ করেছিল শিল্প-সংস্কৃতি বিনির্মাণের জন্য। আর শিল্প-সংস্কৃতি বিনির্মাণের জন্যে সব থেকে বেশি প্রয়োজন যে মানুষ তৈরি করা, শিল্পের মানুষ তৈরি করা, রুচিশীল মানুষ তৈরি করা; এ বিষয়টি গাজী শাহাবুদ্দিনকে যেমন অন্তর দিয়ে বুঝতে দেখেছি এমনটি আর কাউকে দেখিনি এই ঢাকা শহরে। আমাদের এই গাজী ভাইয়ের ক্ষমতার উদাহরণ দিতে গেলে আসলে তাঁর জীবনি লিখতে হবে, লেখা হয়ে যাবে আমাদেরও জীবনের অনেকখানি। কারণ, তিরিশ বছরের বেশি তাঁর সঙ্গে আমার শিকড় বাঁধা। সময়ের প্রয়োজনে, কাজের চাপে তাঁর কাছে প্রতিদিনের যাওয়াটা বন্ধ হয়ে যায় ৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে। ধীরে ধীরে উঠে যায় কথাকলির আড্ডাটি, ব্যস্ত ঢাকার সঙ্গে, পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে- নিজের কাজের পরিধি সব মিলিয়ে আর ওই আড্ডা থাকে না। অনেকেই চলে যান পৃথিবী থেকে। গাজী ভাইও কথাকলি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আসেন গাজী ভবনে। তারপরেও আজও যখন কিশোরদের জন্য গল্প বা উপন্যাস লিখতে বসি তখন মনে পড়ে গাজী ভাইয়ের কথা। নিজের ডেরা লক্ষ্মীবাজার থেকে তখন সকালেই বের হতাম, সারাদিন সাংবাদিকতা শেষে সন্ধ্যার আগে বা একটু পরে একবার গাজী ভাইয়ের কথাকলিতে না গেলে মনে হতো দিন আর রাতটি যেন পূর্ণ হয়নি। সেখানে রাত আটটা-নয়টা অবধি কাটিয়ে তারপরে গাজী ভাইয়ের ছোট লাল গাড়িটাতে কখনও কখনও বেরিয়ে পড়তাম তাঁর সঙ্গে অন্য কোন খানে, আরও কোন শিল্প- সংস্কৃতির আড্ডায়। এমনি ধারার জীবনে একদিন বিকেলে এসেছি কথাকলিতে। গাজী ভাই আমাকে দেখেই কাইয়ুম ভাইকে বললেন, ওকে দিয়ে হবে- ওকে দিয়েই লেখাই। আমাকে লিখতে হবে শুনে মনে করেছি কোন প্রবন্ধ হবে হয়ত না হয় রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। কিন্তু গাজী ভাই বললেন একেবারে নতুন এক কথা। বললেন, এখন থেকে আমি সাতদিন তার এই অফিসে থাকব, সালামত আমাকে খাবার এনে দেবে। সাতদিনের ভেতর আমাকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা কিশোর উপন্যাস লিখতে হবে। তিনটি হয়ে গেছে আরেকটি হলে একসঙ্গে চারটি প্রচ্ছদ ছাপা হবে। আমি যতই নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করি, গাজী ভাই আমাকে তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখতে বলেন। তিনি বলেন, তিনি লেখা দেখলেই বুঝতে পারেন । আমাকে ভয় না পেয়ে তখনই পাশের ঘরে পাঠান আরকি? অনেক কষ্টে গাজী ভাইর কাছ থেকে অনুমতি নিলাম ওখানে বসে নয়, বাসায় বসেই লিখে দেব। সাতদিন অফিসে যাবো না। দেখা যাক কি হয়। সাতদিন লাগেনি, পাঁচ দিনেই লিখেছিলাম, নায়ক কিশোরটির নাম পাল্টে দিয়ে কাইয়ুম ভাই বইটির নাম দেন ‘মনুর মাইন’। আজ এ লেখা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, গাজী ভাইর ডাকনাম মনু, কাইয়ুম চৌধুরী আমার উপন্যাসের নাম দিলেন ‘মনুর মাইন’, একি কেবলই কাকতালীয়? মানুষ গাজী ভাইয়ের কথা কখনই কোন একটি লেখায় লেখা যাবে না। কবি ত্রিদিব দস্তিদার ছিলেন গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসার আংশিক অধিবাসী। মাসের বেশিরভাগ দিন ও রাত কখনও কখনও তাঁর কাটত গাজী ভাইয়ের বাসায়। ত্রিদিব দস্তিদারের সকল খাবারের আব্দার সইতে হতো আমাদের ঢাকা শহরের একমাত্র ভাবি- বিথী ভাবিকে। গাজী ভাই আর বিথী ভাবি দুজনের মানবিক দিক বিচার করে কে বড় তা বলতে যাওয়া সত্য ও সুন্দরের মধ্যে পার্থক্য খোঁজার মতো ব্যর্থ চেষ্টা। বিথি ভাবিই রাখত চিরকুমার, ক্ষ্যাপাটে এই কবির যাবতীয় আব্দার। ত্রিদিব দস্তিদার যখন মারা যান তখন আমি জনকণ্ঠের জীবন শুরু করেছি। ভোরবেলায় বেলাল ভাইয়ের ফোনে এই দুঃসংবাদ শুধু পাইনি, ওইদিন বেলাল চৌধুরীর কাছ থেকে প্রথম শিখি কীভাবে সকালে একজন প্রিয় মানুষের চিরবিদায়ের সংবাদ দিতে হয়। সংবাদ পেয়ে জড়ো হই গাজী ভবনে। গাজী ভবনে পৌঁছতে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে গাজী ভাই আমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি বান্ডিল দেন। বুঝতে পারি ত্রিদিবের সৎকারের খরচ। যার সব আব্দার গাজী শাহাবুদ্দিন মিটিয়েছেন তাঁর জীবদ্দশায়; মৃত্যুর পরে তার বৈতরণী পারের কড়িও তিনি দিলেন । গাজী ভাইয়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নীরবে চোখ মুছে ত্রিদিবের সৎকারের কাজে নেমে পড়ি। বিকেল গড়িয়ে লালবাগের শ্মশানে ত্রিদিবের নশ্বর দেহ দাহ করে যখন সুশান্ত মজুমদার দা, গাজী ভাই ও আমি এক গাড়িতে উঠি তখনই কেবল সারাদিনের নীরবতা ভেঙ্গে গাজী ভাই একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুবই নিচু গলায় বললেন, ত্রিদিবটা চলে গেলো। কাল দুপুরে যখন সুশান্তদার ফোন পাই তখন অনেক জ্বর, সেই থেকে এই চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত শরীর নিয়ে বার বার মনে হচ্ছে, গাজী ভাই চলেন গেলেন? মনে হচ্ছে শিশুর মতো চিৎকার করে গাজী ভাইকে জিজ্ঞেস করি, গাজী ভাই আপনি আমার কে ছিলেন? [email protected]
×