ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভা

পদ্মা সেতুর আরও দুটি স্প্যান এখন মাওয়ায় ॥ ৬৬ পাইলের নক্সা অনুমোদন

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২০ মে ২০১৭

পদ্মা সেতুর আরও  দুটি স্প্যান এখন মাওয়ায় ॥ ৬৬ পাইলের নক্সা অনুমোদন

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মা সেতুর আরও দুটি স্প্যান মাওয়ায় পৌঁছেছে। মাওয়ার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে স্প্যান দুটি নামানো হচ্ছে গত দু’দিন ধরে। এবারের স্প্যান দুটি এসেছে ৬ নম্বর মডিউলের ‘ই’ এবং ‘এফ’ নম্বর। পদ্মা সেতুর মোট ৪১ স্প্যান প্রয়োজন। এগুলো সাতটি মডিউলে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি মডিউলে ‘এ’ থেকে ‘এফ’ পর্যন্ত ছয়টি করে। তবে ৭ নম্বর মডিউলে শুধু ডি নেই। তাই ৭ নম্বর মডিউলের পাঁচটি স্প্যান। এই ৫ স্প্যান (সুপার স্ট্রাকচার) ইতোমধ্যেই মাওয়া পৌঁছে গেছে। এছাড়া ১ নম্বর মডিউলের এফ আগেই এসে পৌঁছেছে। সব মিলিয়ে আটটি স্প্যান এখন মাওয়ার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে। এর মধ্যে দুটি জোড়া লাগানো হয়েছে। আরও তিনটি স্প্যানের জোড়া লাগানোর কাজ শেষ পর্যায়ে। ৪১ স্প্যানের সবই তৈরি হচ্ছে চীনে। এর একেকটি স্প্যানের ওজন প্রায় ৩ হাজার টন। তাই খ- খ- আকারে মাদার ভেসেলে সমুদ্রপথে চীন থেকে আনা হচ্ছে। এই স্প্যানের ২০ তৈরি করা হয়েছে। বাকি বারোটি চীন থেকে পর্যায়ক্রমে মাওয়ায় আনা হবে। আর এই ২০টি স্থাপন করতে করতে বাকি ২১ স্প্যানও তৈরি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এদিকে পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের তিন দিনব্যাপী সরেজমিন সভা শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সভা শুরু করে শুক্রবারও দিনভর চলমান ছিল জাজিরা প্রান্তের সার্ভিস এরিয়া-২ সভাকক্ষে। সভার ফাঁকে ফাঁকে বিশেষজ্ঞ প্যানেল শুক্র ও বৃহস্পতিবার সরেজমিন নির্মাণ কাজও পরিদর্শন করেছে। নানা কারণেই সভাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেতুটি যখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছে তখন এই সভা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সফল সমাধানসহ সেতুর গুণগত মান ঠিক রেখে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এই দলের দেশী-বিদেশী সব বিশেষজ্ঞই অর্থাৎ ১১ জনই অংশ নিচ্ছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিশেষজ্ঞ দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্যানেলের প্রধান প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। সভা শেষ করে প্যানেল গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে শনিবার ফিরবে। দলটি ড্রইং ও ডিজাইনের নানা সমস্যার সমাধান দিয়ে চলেছে। এদিকে সেতুর পাইল স্থাপনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ কোন চ্যালেঞ্জ না থাকলেও হ্যামারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সর্বপ্রথম জার্মানি আনা ২৪শ’ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটিই ভাল সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ের আনা ২ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার হল্যান্ডের হ্যামারটি সম্প্রতি বিকল হয়ে গেছে। এছাড়াও ১ হাজার কিলোজুলের আরেকটি হ্যামারও রয়েছে। কিন্তু উচ্চ ক্ষমতার হ্যামারের এখন বিশেষ প্রয়োনীয়তা দেখা দিয়েছে। তাই ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার আরেকটি জার্মানির হ্যামার দ্রুততম সময়ের মধ্যে মাওয়ায় পৌঁছার কথা রয়েছে। এটি সিঙ্গাপুর থেকে মাওয়ায় আনা হচ্ছে। এছাড়া পুরোপুরি ইনট্যাক্ট নতুন আরও একটি জার্মান হ্যামার আগামী সেপ্টেম্বরে মাওয়ায় আসার কথা রয়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৩৬ শ’ কিলোজুল ক্ষমতার। পদ্মায় বেশি গভীরে পাইল স্থাপনের কারণেই এত উচ্চ ক্ষমতার হ্যামারটি আনা হচ্ছে। এদিকে হল্যান্ড ২৬শ’ কিলোজুল ক্ষমতার আরও একটি হ্যামার দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এটি আগামী বছরের জানুয়ারিতে মাওয়ায় পৌঁছার কথা। এদিকে জাজিরা প্রান্তের ভায়াডাক্টের কাজ আরও এগিয়েছে। ১৯৩ পাইলের মধ্যে ১০০তম পাইলটি স্থাপন হয়েছে শুক্রবার। এছাড়া মেন ব্র্রিজের পাইল স্থাপনের কাজও চলছে। তবে একটি হ্যামার বিকল থাকায় কিছুটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অবশ্য নতুন হ্যামার এলে তা ওভারকাম করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। এদিকে মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টের ৩৭ পিয়ারের মধ্যে ১৭২ পিলার। এরমধ্যে ১৭ পিয়ারের ৬৬ পিলারের অনুমোদন মিলিছে। গত ১৭ মে সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এই অনুমোদন দিয়ে কাজ শুরু করার অনুমতি সংবলিত পত্র দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের। পাইলগুলোর গভীরতা প্রায় ৭০ থেকে প্রায় ৮০ মিটার পর্যন্ত। জাজিরা প্রান্তের ভায়াডাক্টের কাজ শেষেই মাওয়া ভায়াডাক্টের কাজ শুরু হবে। এদিকে জাজিরা প্রান্তের মূল সেতুর সর্বশেষ ৪২ নম্বর পিলারের ১৬ পাইলই স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু মাওয়া প্রান্তের এক নম্বর পাইলটির কাজ শুরু যাচ্ছে না। মাওয়ার পুরনো ফেরিঘাটের কাছে পদ্মাতীরের এই পিলারে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই লোড টেস্ট করা হচ্ছে। এই টেস্ট সম্পন্ন হওয়ার পরই চূড়ান্ত ডিজাইন অনুমোদন দেয়ার কথা। সেতুটির অন্যান্য ধাপের কাজেরও যথাযথ অগ্রগতি রয়েছে। নদী শাসনের কাজও চলছে পুরোদমে। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (সড়ক ) সৈয়দ রজব আলী জানিয়েছেন, মাওয়া প্রান্তে এ্যাপ্রোচ সড়ক টোলপ্লাজাসহ শতভাগ সম্পন্ন হয়ে গেছে। অপরপ্রান্তে জাজিরায়ও এ্যাপ্রোচ সড়ক ৯৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। অর্থাৎ সেতুর আগেই এ্যাপ্রোচ ও সংযোগ সড়ক সম্পন্ন হয়েছে। যা যথাসময়ে সেতুটি জনগণের জন্য খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। শীঘ্রই পদ্মা সেতু দৃশ্যমান করতে সব রকম চেষ্টা চলছে। জাজিরা প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলার নদী থেকে ওপরদিকে উঠতে শুরু করেছে। এই দুই পিলারের কাজ শেষ হলেই প্রথম স্প্যানটি স্থাপন করা হবে। ১২৮ মিটার দীর্ঘ এই পিলারে এর আগে নিচের অংশ সম্পন্ন হয়েছে। সব পরিপূর্ণ হওয়ার পর উপরের অংশের কাজ শুরু হয়েছে। তাই এই পাইলটি দূর থেকেই এখন দৃশ্যমান। নতুন নতুন সফল্যের খবর আসতে শুরু করেছে পদ্মা সেতু থেকে। সেতুর ৪২তম পিলারের ষোলটি পাইল স্থাপন হয়েছে সবার আগে। মূল সেতুর এটিই সবচেয়ে বেশি পাইলের পিলার। সর্বশেষ ৪২তম পিলারে পাইল সবার আগে শেষ করে একটি বড় চ্যালেঞ্জে সফলতা আসছে। ৮০ মিটার দীর্ঘ এবং তিন মিটার ব্যাসের এসব পাইল এখন খুঁটি ওঠানোর উপযোগী হয়েছে। মাওয়া থেকে শুরু হয়ে ৬ দশমিক ১৫ মিটার দীর্ঘ সেতুটি পদ্মা পার হয়ে যেখানে শেষ হয়েছে ওই পিলারটিই ৪২তম। প্রায় ছয় মাস ধরে এই পিলারটির কাজ চলছে। প্রথমে তিনটি পাইল স্থাপন করে সাড়ে ৪ হাজার টন লোড দিয়ে ৪৫ দিন ধরে টেস্ট করে সফলতা আসে। নদীর মাঝের ৪০ পিলারের ২৪০ ও দু’পারে ২টি পিলারের আটাশটিসহ মূল সেতুর মোট ২৬৮ পাইল স্থাপন করা হচ্ছে। নদীতে ৫৮ এবং তীরের এই ১৬টি মিলে এখন পর্যন্ত মোট পাইল স্থাপন হয়েছে ৭৪। এছাড়া দেড়কিলোমিটার করে উভয়প্রান্তে তিন কিলোমিটার সংযোগ সেতুর (ভায়াডাক্ট) জন্য আরও হচ্ছে ৩৬৫ পাইল। এর মধ্যে মাওয়া অংশে ১৭২ এবং জাজিরা অংশে ১৯৩ পাইল রয়েছে। জাজিরা অংশের ১০০ পাইল ইতোমধ্যেই স্থাপন হয়েছে।
×