ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৯ মে ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

কাল বৈশাখী পূর্ণিমা। বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা হলো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্রতম উৎসব। এই পুণ্যোৎসব বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হয়। এই পবিত্র তিথিতে বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বোধি বা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন এবং মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। এই দিনে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ স্নান করেন, শুচিবস্ত্র পরিধান করে মন্দিরে বুদ্ধের বন্দনায় রত থাকেন। ভক্তগণ প্রতিটি মন্দিরে বহু প্রদীপ প্রজ্বলিত করেন, ফুলের মালা দিয়ে মন্দিরগৃহ সুশেভিত করে বুদ্ধের আরাধনায় নিমগ্ন হন। বৌদ্ধধর্মের উৎসব হলেও ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সর্বসাধারণের জন্য এই দিনটি সরকারী ছুটি থাকে। দুদিন পর মুসলমানদের বিশেষ পবিত্র রাত; শব-ই-বরাত বা সৌভাগ্য রজনী। শব-ই-বরাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা রাত জেগে ইবাদত করে থাকেন। কিছুটা উৎসবের আবহ থাকে এই রাতে। বাড়ি বাড়ি মিষ্টি, হালুয়া-রুটি আদান-প্রদানের রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। সাধারণত শব-ই-বরাতের পরদিন সরকারী ছুটি থাকে। শুক্রবার এমনিতেই ছুটি। তাই সরকারী নির্বাহী আদেশে বৃহস্পতিবার ছুটি ঘোষিত হলে অনেক ঢাকাবাসী এই সুযোগটিকে কাজে লাগাতে ভুলবেন না। টানা চার দিনের লম্বা অবকাশ মিলবে। ফলে ঈদ মৌসুমের মতোই ঢাকা অনেকটা ফাঁকা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আজ থেকেই ঢাকার পথঘাটের চেহারা বদলাতে শুরু করার কথা। মে দিবসের ছুটিকে কেন্দ্র করে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম দুদিনের জন্য। সত্যি বলতে কি ঢাকার বাইরে গেলে, বিশেষ করে কোন মফস্বল শহর বা প্রত্যন্ত গ্রামে গেলে হাড়ে হাড়ে অনুভব করা যায় আমরা যে শহরে বসবাস করি তার নেতিবাচক দিকগুলো। ঢাকায় জীবন যেমন ভারাক্রান্ত, তেমনি ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ। আবার ঢাকার বাইরে ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে আসার সময়, মানে ঢাকায় প্রবেশের সময়েও দূর থেকে ঢাকার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো বড় হয়ে উঠতে থাকে। ধুলো, ধোঁয়া, যান্ত্রিকতা এবং চড়া শব্দের আধিক্য আমাদের টের পাইয়ে দেয় আমরা প্রত্যাবর্তন করছি কোন মহানগরীতে। দুই মেয়রের দুই বছর মহানগরীর সমস্যা হলো মহাসমস্যা। পাহাড়সমান এইসব মহাসমস্যা দু-দশ বছরে সম্পূর্ণরূপে সমাধান করা সম্ভবÑ এমন অবৈজ্ঞানিক কথা বলতে চাই না। তবে আন্তরিকতার সঙ্গে পূর্ণকালীন কাজ করে গেলে নিশ্চয়ই উঁচু পাহাড় থেকে সমস্যা নামতে নামতে আমাদের গলাসমান হতে পারে। ঢাকার নতুন দুই মেয়র দুই বছরে আন্তরিকভাবে কাজ করতে চেয়েছেনÑ এটা অস্বীকার করা যাবে না। দু’বছরে নিশ্চয়ই কিছু কিছু সমস্যার মাত্রা কিছু অংশে হলেও কমতে শুরু করেছে, এটা মানতেই হবে। সিটি করপোরেশনকেন্দ্রিক টেন্ডার বাণিজ্য বন্ধ করে ক্রয় খাতে স্বচ্ছতা এনে প্রশংসা পেয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক। আর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ, গাবতলীতে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা এবং সর্বশেষ দূতাবাসপাড়ায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। হাজার হাজার বিলবোর্ড অপসারণ করে ঢাকাবাসীকে কিছুটা হলেও খোলা আকাশ দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। আমি থাকি উত্তরায়। উত্তরা এলাকার ১, ৩-১৪ নম্বর সেক্টরের রাস্তা, নর্দমা এবং ফুটপাথ নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গাছ কাটার জন্য সমালোচিত এই মেয়র যদি অভিজাত এলাকার পাশাপাশি অনুন্নত এলাকার দিকে আরেকটু মনোযোগী হতেন তবে তিনি নগরবাসীদের কাছে আরও ভাল নাম্বার আশা করতে পারতেন। তবে ঢাকার গণপরিবহন সংকট আর থাকবে না যদি মেয়র চার হাজার বাস নামানোর চ্যালেঞ্জটিতে সফল হতে পারেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের অন্যতম সফল পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে যানজট নিরসনে পল্টন, মতিঝিল ও গুলিস্তানের রাস্তা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত রাখতে হকার উচ্ছেদ করতে পারাটা। আর ‘জনতার মুখোমুখি জনপ্রতিনিধি’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি নাগরিক দুর্ভোগ জানার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। গত দুই বছরে মেয়রের সফলতার মধ্যে রয়েছে সড়ক মেরামত, ফুটপাথ উন্নয়ন, সড়কে এলইডি বাতি স্থাপন, আধুনিক টয়লেট নির্মাণ, সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ, সৌন্দর্যবর্ধন, নগর ভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা প্রভৃতি। তবে রাস্তা থেকে ময়লা সরানো এবং জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজে এই মেয়রের কাছে নগরবাসীর প্রত্যাশা অনেক বেশি। তাছাড়া পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় মেয়র বিশেষ ভূমিকা রাখুক সেটাও ঢাকাপ্রেমীদের দাবি। প্রবীণ ঢাকাবাসীর আশাবাদ তরুণ বয়স থেকে বিগত ষাট-সত্তর বছর যাবত এই শহরে যারা বসবাস করছেন এমন কোন গুণী ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি যখন ঢাকার ভবিষ্যত সম্বন্ধে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তখন ভাল লাগে। ঢাকা মহানগর সংক্রান্ত একটি গোলটেবিল বৈঠকে বুয়েট এ্যালামনাইয়ের সভাপতি জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাদের আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই শহরে আমি ১৯৫২ সাল থেকে বাস করছি। একাধিক অনুষ্ঠানে আমি বলেছি যে এই মহানগরকে আমি চোখের সামনে মরতে দেখেছি। বাছবিচারহীনভাবে নদীর জায়গা দখল হয়েছে, দূষণ হয়েছে।’ লন্ডনের টেমস নদীর দূষণ ও দূষণমুক্ত করার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী। আমরাও দূষণের হাত থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে পারব।’ বুয়েটেরই একজন অধ্যাপকের বক্তব্যে এমন কিছু সাম্প্রতিক তথ্য উঠে এসেছে যা আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে। নদী, খাল, লেক ও জলাভূমি দূষণ ও দখলের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্য, পানি সরবরাহ, মৎস্য সম্পদ, নৌ চলাচল ও পর্যটনের ওপর। ২০ কিলোমিটার বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতি সেকেন্ডে ৫০ থেকে দেড় হাজার ঘনমিটার পানি-বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ৪১টি জায়গা থেকে এই দূষণ হচ্ছে। পাঁচ ঘনমিটার মল অশোধিত অবস্থায় ফেলে দেওয়া আর পাঁচ হাজার মানুষের উন্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ একই রকম দূষণ ঘটায়। বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম যা বললেন তার সঙ্গে দ্বিমতের কোন সুযোগ নেই। মানুষের শরীরে শিরা-উপশিরা যে কাজ করে, ঢাকার জন্য একই কাজ করে নদী ও খালগুলো। ৫২টি খালের জায়গা নির্দিষ্ট করে গেজেট প্রকাশ করার ওপর জোর দিয়েছেন ওই অধ্যাপক। জীবন সংগ্রামী দুই তরুণীর কথা গত সপ্তাহের টক অব দ্য টাউনের মধ্যে ছিল সহপাঠী ও বন্ধুদের দ্বারা দুই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীর রাতভর ধর্ষিত হওয়ার খবর। ধর্ষণের ভিডিও করে রাখা হয়েছে ধর্ষকদের আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে। এ নিয়ে লেখালেখি করার লোকের অভাব না হওয়ারই কথা। তাই অন্য প্রসঙ্গে যাব। তবে এই ঘটনার দুটি দিক রয়েছে সে বিষয়ে কটি কথা না বললেই নয়। এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের ভিতর পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়বে। সুন্দর বন্ধুতার ভেতর বাসা বাঁধবে কদর্য বিষয় আশয়। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়ালেখা করে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই একটি বড় ক্ষতি। মেয়েদের মনোজগতের সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনা থেকে অভিভাবকরা যদি আরেকটু সতর্ক ও সচেতন হয়। তরুণবয়সী সন্তানদের সামগ্রিক ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা যে কত গুরুত্বপূর্ণ- এটা তারা অনুধাবনে সক্ষম হবেন। তরুণ-যুবকেরা অপরাধে জড়ালে তাদের পারিবারিক পরিচয় অনেক সময় গোপন রাখা হয়। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা বলতে হবে, পরিচয় প্রকাশ বরং সামাজিকভাবে উপকার বয়ে আনতে পারে। এখনও অপরাধে জড়ায়নি এমন সন্তানদের বাবা-মারা লোকলজ্জা ও থানা পুলিশের ঝামেলা এড়াতে অনেকটা বাধ্য হবেন পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে। ঢাকায় বসবাসকারী কিশোরী-তরুণীদের অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। গত সপ্তাহে দরিদ্র দুই তরুণী, যাদের বয়স ছিল আঠেরো, ঢাকার দুটি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এদের একজন গৃহকর্মী, অপরজন গার্মেন্টকর্মী। জীবন সংগ্রামরত ওই দুই তরুণী শেষ পর্যন্ত জীবন পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রত্যেক আত্মহত্যার নেপথ্যে থাকে অনেক হন্তারক। মূলত সামাজিক অব্যবস্থাই অসহায় নিষ্পেষিত তরুণীদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। আবার সামাজিক মানুষই পারে একটু মমতা ও সহায়তা দিয়ে তাদের ধ্বংসের পথ থেকে ফেরাতে। কোন গার্মেন্টকর্মী কিংবা গৃহকর্মী এ লেখা পড়বেন না। কিন্তু ওই দুটি পেশাগত কাজের সঙ্গে যুক্তদের আশপাশে যারা থাকেন, যারা তাদের কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করে থাকেন, তাদের কেউ না কেউ এ লেখা পড়তেই পারেন। সে জন্যেই এখানে বিষয়টির অবতারণা। জীবনের ওপরে তো আর কিছু হয় না। জীবন মহামূল্যবান। একজন মানুষ জীবনটি পায় একবারের জন্যই। তাই মানুষের দায় রয়েছে অপর মানুষের জীবন রক্ষায়; কর্তব্য রয়েছে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কোন মানুষের মনের শুশ্রƒষা করার। আমরা যাদের কাজের মেয়ে বা বুয়া বলি, সেইসব গৃহকর্মীর কাছ থেকে সেবা নিয়ে থাকি অর্থের বিনিময়ে। তাদের মানসিক/শারীরিক পীড়ন থেকে আমরা যেন নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি। অর্থকষ্ট ছাড়াও নানা ধরনের কষ্ট থাকতে পারে একজন গৃহকর্মী, কিংবা বস্ত্রকর্মী তরুণীর। অল্প বয়স বলেই তার বিবেচনাবোধটি থাকবে অপরিপক্ব, অন্যদিকে আবেগ ও অনুভূতি থাকবে তীব্র। তাদের জীবনকে সহনীয় ও স্বস্তিশীল করায় হয়ত আমাদের ভূমিকা নেওয়ার সময় ও আগ্রহ থাকবে না। কিন্তু আমরা যেন তাদের এমন পীড়ন না করি যা তাদেরকে অতল গহ্বরে ফেলে দিতে সক্ষম। এই মহানগরীকে যেন আর কোনো মানুষের আত্মহত্যার গ্লানিতে ভারাক্রান্ত না হতে হয়। সুখবর মাত্র ১১০০ টাকায় ডায়ালাইসিস। ভাবাই যায় না। ঢাকায় কিডনি- রোগীদের কী যে কষ্ট! এরই মাঝে দারুণ একটা খবর পাওয়া গেল। আন্তর্জাতিকমানের ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ‘গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার’ চালু হচ্ছে এ মাসেই। রাজধানীর ধানম-ি-৬ নম্বরে এই সেন্টার চালু হচ্ছে। সেন্টারটি চালু হলে অপেক্ষাকৃত কম খরচে প্রতিদিন ৫০০ কিডনি ডায়ালাইসিস রোগী বিশ্বমানের সেবা পাবে। ২৪ ঘণ্টা চালু থাকা সেন্টারটিতে প্রতিদিন ২৫ দরিদ্র রোগী পাবেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা। বাকি ৩৫০ রোগী পাবেন ১১০০ টাকায়, ১৫০ রোগী পাবেন ১৫০০ টাকায় এবং ধনী বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ৫০ রোগী পাবেন ৩ হাজার টাকায় ডায়ালাইসিস সেবা। এটি সম্পূর্ণ অলাভজনক সেবা প্রতিষ্ঠান বলে জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরউল্লাহ। তিনি বলেছেন, দেশের বৃহত্তম কিডনি সেবা কেন্দ্র হবে এটি। সেন্টারটির সঠিকমান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছেন আইসিডিডিআরবি ল্যাবরেটরির প্রধান ও মাইক্রোবায়োলজি, সংক্রামক রোগ মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। ০৭ মে ২০১৭ [email protected]
×