ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ৫ মে ২০১৭

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) ফেরি টারমিনাল থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে একটা পুরনো বৃহৎ আকারের মার্কেটের মধ্যে সবার দেখাদেখি আমরাও ঢুকে পড়লাম কৌতূহল মেটানোর অভিপ্রায়ে। কৌতূহল নিবারণ হলো কিন্তু যা কিছু দেখা হলো সেটা একবারে ফেলনার নয়। সারিবদ্ধভাবে তৈরি খাবারের হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে দোকানিরা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে তৎপর। তবে এখানে বসে খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। যে যার পছন্দমতো খাবার নিয়ে চলতে ফিরতে কিংবা কোন সাগর তীরের বেঞ্চে বসে আয়েশে ক্ষুধা মেটানোর এক উত্তম ব্যবস্থা। মর্কেটটার একদিকে খাবারের দোকান আর অন্যদিকে তাজা শাকসবজি মাছ মাংসের দোকান। সুলভমূল্যে স্থানীয় বাসিন্দারা এখান থেকে বাজার করতে প্রতিনিয়ত যে ভিড় জমায় সে চিত্রও চোখে পড়ে। প্রিয়জনের উপহার সামগ্রী, পোশাক পরিচ্ছেদসহ নানান রকমারি দোকানের অভাব নেই এই ছোট্ট মার্কেটটিতে। আমাদের মতো কৌতূহল মেটাতে আসা উইংডো শপিং করার লোকেরও অভাব চোখে পড়ল না। একটু দেখেশুনে কালবিলম্ব না করে বেরিয়ে পড়লাম সত্যিকার দর্শনীয় বস্তুর সন্ধানে। সন্ধান করতে বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। অদূরেই দেখা মিলল হেলসিংকি সিনেট স্কয়ারের, পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। ফিনল্যান্ডের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম, বিনোদন এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। জার্মান স্থাপত্যবিদ ঈধৎষ খঁফারম ঊহমবষ, যিনি বিভিন্ন দেশের রাজপ্রাসাদ, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভবনের নক্সাবিধ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি স্থাপত্যশৈলির এক অনন্য নিদর্শন এই সিনেট স্কয়ারের নক্সা প্রণয়ন করে দক্ষতার আরও একটা নিদর্শন রেখে যান। সিনেট স্কয়ার এবং চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো নিওক্লাসিক্যাল স্থাপত্যবিদ্যার এক অনবদ্য অবদান, যে অবদান ঈধৎষ খঁফারম ঊহমবষ রেখে গিয়েছিলেন ১৮২২ থেকে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের দিকে। হেলসিংকি ক্যাথিড্রাল, সরকারী রাজপ্রাসাদ, হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বিল্ডিং এবং ফিনল্যান্ডের প্রধান জাতীয় গ্রন্থাগার এ সবই তার উদ্ভাবনী প্রতিভার এক একটি নিদর্শন। এসবের মধ্যে হেলসিংকি ক্যাথিড্রাল সব বিতর্কের উর্ধে অন্যতম বিখ্যাত ও ফটোগ্রাফিক স্থাপনা তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ক্যাথিড্রাল ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ১৫০তম জন্মজয়ন্তী পালন করল মহা ধুমধামের সঙ্গে। হেলসিংকির সব থেকে পুরাতন পাথরের বিল্ডিং ঝবফবৎযড়ষস ঐড়ঁংব সিনেট স্কয়ারের দক্ষিণপূর্ব কর্নারে অবস্থিত। সিটি মিউজিয়ামের প্রধান স্থাপনাও সোফিয়ানকাটু মিউজিয়াম স্ট্রিটে অবস্থিত। সিনেট স্কয়ারে আরও যে সকল পর্যটক আর্কষণীয় বস্তুর সমাহারে সমৃদ্ধ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাউন্ড অব দি সিনেট স্কয়ার। এটা হলো ইউরোপিয়ান বাদ্যযন্ত্রের আধুনিক সংস্করণ, যার মন মাতানো সুরের মূর্ছনা শুনতে পাওয়া যায় প্রতিদিন ১৭.৪৯ মিনিটে, আর স্থায়িত্ব মাত্র ৫ মিনিট। এর শব্দতরঙ্গ ভেসে বেড়ায় এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে। সিনেট স্কয়ারের মোহ কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ধীর পদক্ষেপে হাতে হাত ধরে এই স্কয়ারের সব থেকে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী ফিনল্যান্ডের জাতীয় চার্চ অর্থাৎ হেলসিংকি ক্যাথিড্রাল অভিমুখে। অবশ্য বেশিদূর হাঁটার প্রয়োজন হলো না। তবে অধিকসংখ্যক পর্যটকের পদচারণায় এই স্থানটিতে স্বস্তিতে চলতে ফিরতে পারা গেল না। যতটুকু না ধর্মীয় কারণে তার থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এর নির্মাণশৈলি। তাই এত দর্শক সমাগম তদ্বীয় পাদদেশে পাদপ্রদীপের লাগি। অতিব সুন্দর ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ হেলসিংকি ক্যাথিড্রাল ঊাধহমবষরপ খঁঃযবৎধহ ঈযঁৎপয হেলসিংকির আইকন হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। খ্রিস্টানদের সুসমাচার মতবাদ অথবা গসপেলসম্পর্কিত, এক কথায় প্রটেস্টান্টদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে, যিশুখ্রিস্টের ওপর বিশ্বাস রাখলেই আত্মার ত্রাণ হতে পারে তাদের কল্যাণেই এই ধর্মীয় উপাসনালয়ের সৃষ্টি। যে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিখ্যাত আর্কিটেট ঈধৎষ খঁফারম ঊহমবষ উনিশ শতকে রাজপ্রাসাদের আদলে এর নির্মাণকাজ শুরু করে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে শেষ করেন। নির্মাণশৈলির বাহুল্যতা না বলে যদি বলা হয় নান্দনিকতা তবে মনে হয় যথার্থই বলা হবে। এই ধরনের স্থাপনা পৃথিবীর বহুদেশে পর্যটক দর্শকদের মনোরঞ্জন করে চলেছে, আর রাষ্ট্র তার বিনিময়ে আয় করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। জানা অজানার পথে পথে ঘুরতে গিয়ে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরাও। রাত কম তামাশা বেশি, একখানে অধিক সময় ব্যয় করার মতো অবস্থা নেই। কালবিলম্ব না করেই ফিরে চললাম পরের বিষয়টির দিকে। কত অজানাকে জয় করা যায় সেটাই দেখার বিষয়, সেই হোক মোর ব্রত। জীবনের যদি একটা সীমারেখা টানা যেত তবে পরিকল্পনা করে একটা একটা অজানার তালিকা প্রস্তুত করে জয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেত। কিন্তু সেটা তো করার কোন উপায় নেই তাই স্বল্পপরিসরে যতটুকু পারা যায় সাধ মেটানো, সে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এসব আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে আর পথ চলতে চলতে এসে পড়লাম দ্বিতীয় আলেকজান্ডার দি গ্রেট এর ভাস্কর্যের পাদদেশে। এই ভাস্কর্য সিনেট স্কয়ারের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছিল। যদিও এক সময় ভাস্কর্য নিয়ে অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ফিনল্যান্ড স্বাধীন হওয়ার পর বিরুদ্ধবাদীরা এটাকে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, অশ্বারোহনসহ এই ভাস্কর্যকে স্থানান্তরিত করা হবে কিয়াসমা জাদুঘরের সামনে Mannerhimnite Street এ। চলবে...
×